কেমন চলছে ভাষা শহীদ রফিক স্মৃতি গ্রন্থাগারটি
আব্দুর রাজ্জাক, ঘিওর (মানিকগঞ্জ) ॥
মাঘ মাসের শেষের দিক, তবুও শীতের তীব্রতা অনেকটাই কম। খুব সকালেই রওনা হলাম। উদ্দেশ্য পারিল গ্রাম। যে গ্রামের সন্তান ভাষা শহীদ রফিক উদ্দিন আহমেদ। মানিকগঞ্জের এই উজ্জ্বল নক্ষত্রই বায়ান্নর ভাষা আন্দোলনের প্রথম শহীদ। মানিকগঞ্জ থেকে বাসে সিংগাইরের ঋষিপাড়া মোড়। এরপর রিকশা যোগে ৩ কিলোমিটার দূরেই পারিল গ্রাম। দু’ধারে শস্য ক্ষেত আর সবুজ পত্র পল্লবে ঘেরা, যেন পটে আঁকা এক ছবির গ্রামখানি। ঝকঝকে রোদ্যজ্জ্বল গ্রামটি এখন শহীদ রফিক নগর হিসেবে পরিচিত। ভাষা শহীদ রফিকের স্মৃতিকে ধরে রাখতে ২০০৮ সালে জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তার জন্মভূমি রফিক নগর এলাকায় প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে গ্রন্থাগার ও জাদুঘর। এলাকাবাসীর দীর্ঘদিনের এই স্বপ্ন বাস্তবায়ন হয়েছে ঠিকই কিন্তু নেই আর নেই উচ্চারণ ছাড়া সেখানে আর কিছুই নেই।
সরজমিন সিংগাইরের পারিল গ্রাম অর্থাৎ রফিক নগরে প্রতিষ্ঠিত ভাষা শহীদ রফিক গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে গিয়ে দেখা যায়, কেউ বই পড়ছে কেউ পত্রিকা আবার কেউ গল্প গুজব করে সময় কাটাচ্ছে। ছোটদের পাশিপাশি দূরদূরান্ত থেকে দর্শনার্থীরাও ছুটে আসছেন রফিক নগরের এই ছোট্ট গাঁয়ে। মায়ের ভাষার জন্য যিনি আত্মাহুতি দিয়ে বাংলা ভাষাকে প্রতিষ্ঠা করেছেন সেই শহীদ রফিকের জন্মভূমির ধুলো মাটিতে পা রাখতে পেরে অনেককেই ধন্য হয়ে যায়। অনুভূতি ব্যক্ত করেন ভিন্ন ভিন্নভাবে। গ্রন্থাগার ও জাদুঘরের সামনে শহীদ রফিকের যে ছবির ম্যুরাল রয়েছে তার সঙ্গে রফিকের বাস্তবের ছবির কোনো মিল না থাকায় ক্ষোভ রয়েছে এলাকার মানুষের। ফলে দীর্ঘ ১০ বছর ধরে এই ম্যুরাল নিয়ে চলছে আলোচনা-সমালোচনার ঝড়।
শুধু শহীদ রফিকের ম্যুরালই নয় শহীদ রফিক গ্রন্থ্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে রফিকের কোনো স্মৃতি সংরক্ষণে রাখা হয়নি। গ্রন্থাগারে শহীদ রফিকের জীবনী নিয়ে স্বল্প আকারের শুধুমাত্র একটি বই সংরক্ষণে রাখা হলেও অন্যান্য ভাষা শহীদকে নিয়ে লেখা কোনো বই সেখানে নেই। যার ফলে সেখানকার নতুন প্রজন্ম বায়ান্নর ভাষা আন্দোলন সম্পর্কে তেমন অবগত হতে পারছে না বলেও অভিযোগ রয়েছে অগনিত পাঠকদের।
সেখানে গিয়ে কথা হয় নানা বয়সী এবং নানা পেশার মানুষের সঙ্গে। ঢাকার মোহাম্মদপুর এলাকার বাসিন্দা ওয়ালিদ জাহান আকাশ ও তার পরিবারের ৩ সদস্য। ওয়ালিদ জানালেন, ‘আমি সুযোগ পেলেই পরিবার নিয়ে ছুটে আসি শহীদ রফিক নগরে। এসেই ছুটে যাই ভাষা শহীদ রফিক গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে।’
পারিল গ্রামের মো. ফিরোজ নামের এক ব্যবসায়ী জানালেন, শহীদ রফিকের গ্রামে জন্ম নিয়ে আমি গর্বিত। দেশের যে প্রান্তেই যাই সেখানে গর্ব করে বলতে পারি আমি শহীদ রফিকের গ্রামের মানুষ। দুঃখের বিষয় হচ্ছে শহীদ রফিক গ্রন্থাগারে ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসের ওপর তেমন কোনো বই নেই। এছাড়া নামেই জাদুঘর, সেখানে ভাষা শহীদ রফিকের যেসব স্মৃতি রয়েছে তার কোনোটিও সংরক্ষণে রাখা হয়নি। শুনেছি শহীদ পরিবারের কাছে শহীদ রফিকের হাতে বুনানো রুমাল, কলম, ম্যাট্রিকের সনদ, নকশি কাঁথা রয়েছে। সেগুলো যদি জাদুঘরে সংরক্ষণে রাখা হতো তাহলে নতুন প্র্রজন্ম সেগুলো দেখতে পারতো।
রফিক নগর এলাকার স্কুল শিক্ষার্থী নাহার, ইলমা, রুবাইয়েত হোসেন জানালো, ভাষা শহীদ রফিক আমাদের গ্রামের অহংকার। যাকে নিয়ে আমরা গর্ব করি। এখানে আমরা অনেক ধরনের বই পড়ি। কিন্তু ভাষা আন্দোলন ও অন্যান্য শহীদদের নিয়ে লেখা বই নেই। এ কারণে পাঠকসংখ্যা ও দর্শক সংখ্যা কমে যাচ্ছে। পাঠাগার ও জাদুঘরের কথা শুনে দূরদূরান্ত থেকে পাঠক ও দর্শনার্থী এসে হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন।
জানা যায়, প্রয়াত সংসদ সদস্য ও শিল্পমন্ত্রী শামসুল ইসলাম খানের সার্বিক সহযোগিতায় ও সে সময়ের ইউএনও আশরাফ আলীর পৃষ্ঠপোষকতায় ১৯৯৫ সালে সাংস্কৃতিক মন্ত্রণালয়ের অর্থায়নে উপজেলা চত্বরে টিনের ঘরে রফিক স্মৃতি পাঠাগারের কার্যক্রম চালু করা হয়। দীর্ঘদিনের নাজুক অবস্থা কাটিয়ে পাঠাগারে নিজস্ব তহবিলের ৩ লাখ টাকা ও সরকারি অনুদান দিয়ে ২০০৬ সালে সে সময়ের ইউএনও দেলোয়ার হোসেন উপজেলা চত্বরে পাঠাগারের একতলা পাকা ভবন নির্মাণ করেন। ২০০৮ সালের ১৫ মে বাংলাদেশ সরকারের অনুমতিক্রমে ভাষাসৈনিক রফিক উদ্দিন আহমদের স্মৃতিকে চিরজাগ্রত রাখতে তাঁর জন্মস্থান সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের ‘পারিল’ গ্রামের নাম পরিবর্তন করে রফিকনগর নামকরণ করা হয়েছে এবং সেখানে এক বিঘা জায়গার ওপরে গড়ে উঠেছে শহীদ রফিক উদ্দিন আহমদ গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘর। উল্লেখ্য, এই এক বিঘা জায়গাটি দান করেন লে. কর্নেল (অব.) মজিবুল ইসলাম (পাশা)। জাদুঘরটি উদ্বোধন করেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এর অধ্যাপক আনিসুজ্জামান, এবং এই মহৎ উদ্যোগ গ্রহণ করেন তৎকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকারের স্থানীয় সরকার, সমবায় ও পল্লী উন্নয়ন উপদেষ্টা আনোয়ারুল ইকবাল। বেসরকারি সংস্থা প্রশিকা শহীদ রফিক জাদুঘর স্থাপন করে ভাষাশহীদ রর্ফিকের নিজ বাসভবনে। রফিকের বেশকিছু দুর্লভ ছবি রয়েছে এখানে। এছাড়া বাংলা একাডেমি, বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্র এবং প্রশিকাসহ বিভিন্ন সংগঠন থেকে দেওয়া প্রায় ১২ হাজারের মতো বই রয়েছে এ জাদুঘরে।
শহীদ রফিক গ্রন্থাগারের লাইব্রেরিয়ান মো. ফরহাদ জানান, এই গ্রন্থাগারে প্রায় ১২ হাজার বই রয়েছে। এখানে শহীদ রফিকের অল্প কিছু জীবনী নিয়ে শুধুমাত্র একটি বই আছে। তবে ভাষা শহীদদের ওপর লেখা বই নেই। শহীদদের নিয়ে গবেষণাকেন্দ্রিক বইগুলো থাকলে নতুন প্রজন্ম জানতে পারতো ভাষা আন্দোলনের প্রকৃত ইতিহাস। প্রতিদিনই শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ পাঠাগারে এসে জানতে চায় ভাষা শহীদদের ওপর লেখা বই কেন সংরক্ষণে আনা হচ্ছে না। আমরা কোনো উত্তর দিতে পারি না। কর্তৃপক্ষকে অসংখ্যবার বলা সত্ত্বেও কোনো কাজে আসছে না।
মানিকগঞ্জ জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান বীর মুক্তিযোদ্ধা অ্যাডভোটেক গোলাম মহীউদ্দিন বলেন, ‘সরকার শহীদ রফিকের নামে তার নিজ গ্রামে জাদুঘর প্রতিষ্ঠা করেছে। জেলা পরিষদের পক্ষ থেকে তার বসতবাড়িতে শহীদ মিনার নির্মাণ করা হয়েছে। ভাষা আন্দোলনসহ গুরুত্বপূর্ণ আরো বই যেন পর্যাপ্ত থাকে, সে বিষয়ে অবশ্যই জরুরি পদক্ষেপ গ্রহণ করা হবে। শহীদ রফিকের স্মৃতি হিসেবে নকশিকাঁথার রুমাল, ম্যাট্রিকের সনদ, কলমসহ আরো যা আছে সেগুলো শহীদ রফিকের পরিবারের ছোট ভাইয়ের কাছে রয়েছে বলে আমাকে জানানো হয়েছে। পরিবারের সঙ্গে কথা বলে সেই স্মৃতিগুলো গ্রন্থাগার ও স্মৃতি জাদুঘরে রাখার কাজটিও আমরা করবো।’
এদিকে শহীদ রফিকের পৈতৃক ভিটায় বসবাস করছেন শহীদ রফিকের ভাবী গুলেনার বেগম। বয়সের ভারে তিনি এখন ভালোমতো চলাফেরা করতে পারেন না। তবে আক্ষেপ করে তিনি বলেন, ‘ফেব্রুয়ারি মাস এলেই আমাদের কথা সবার মনে পড়ে। বছরের বাকিটা সময় কেউ খোঁজও নেয় না।’