কুমার জনগোষ্ঠীর স্বপ্নের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের তিন বছরের পথচলা
আটপাড়া, নেত্রকোনা থেকে রিকু রানী পাল ও মো. আলমগীর
আজ থেকে তিন বছর পূর্বে ২০১৫ সালের জুন মাসে যাত্রা শুরু হয় কুমার সম্প্রদায়ের শিক্ষা থেকে পিছিয়ে পড়া শিশুদের মধ্যে শিক্ষার আলো জ্বালাতে বাখরপুর শিশুশিক্ষা কেন্দ্র। ইতিমধ্যে পূর্ণ হয়েছে বাখরপুর শিক্ষা কেন্দ্রের তিন বছর পথচলা। এই তিন বছরে বাখরপুর কুমার সম্প্রদায়ের অভিভাবকরা শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের সফলতার আলো দেখতে পাচ্ছেন। কুমার সম্প্রদায়ের শিশুরাসহ সকল অভিভাবকরা স্বপ্ন দেখতে শুরু করে যে, তাদের সন্তানরাও সমাজের বিত্তশালী পরিবারের শিশুদের মত শিক্ষা ও সৃজনশীলতায় সত্যিকারের শিক্ষা অর্জন করে সমাজে প্রতিষ্ঠিত হবে, দেশের উন্নয়নে অবদান রাখবে।
তিন বছর আগেও বাখরপুর কুমার পাড়ার কুমার শিশুরা প্রতিবছরই প্রাথমিক পর্যায় থেকেই বিভিন্ন সামাজিক ও পারিবারিক কারণে শিক্ষা থেকে ঝরে পড়ত। পড়াশুনা ছেড়ে পরিবারের আয়বৃদ্ধিমূলক কাজে যুক্ত হয়ে যেত। শিক্ষা থেকে শিশুদের ঝরে পড়ার উল্লেখযোগ্য কারণগুলোর মধ্যে ছিল- ক্লাসের প্রতিদিনের পড়া দিতে না পাড়ায় সহপাঠীদের নিকট নিজেদের অবহেলার পাত্র মনে করে শিক্ষার প্রতি তাদের অনিহা চলে আসে, বিদ্যালয়ের কোন ধরণের অনুুষ্ঠান ও পরীক্ষায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হতে পারবেনা ভেবে কুমার শিশুরা সব সময় নিজেদের আড়াল করে রাখত। নিজেদের স্বাস্থ্য ও পরিস্কার পরিছন্নতা সম্পর্কে তারা ছিল অসচেতন। পাঠ্য বইয়ের বাইরের জ্ঞান সম্পর্কে তারা ছিল অজ্ঞ। সমাজের অন্যান্য সম্প্রদায়ের জনগোষ্ঠীর নিকট তারা পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠী বলে বিবেচিত ছিল। কিছু স্বার্থপর বিত্তবান জনগোষ্ঠী কুমার শিশুদেরকে কিছুই পারেনা বলে হেয় প্রতিপন্ন করত।
২০১৫ সালের ১লা জুন বারসিকের সহযোগিতায় কুমার পাড়ার একজন আগ্রহী স্নাতকোত্তর পড়ুয়া কুমার শিক্ষার্থী রিকু রানী পাল এর উদ্যোগে শুরু হয় বাখরপুর শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের। নিজেদের একটি অতিরিক্ত ঘরে তিনি কুমার শিশুদের নিয়ে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের পাঠদান কার্যক্রম শুরু করেন। এখানে মূলত কুমার শিশু শিক্ষার্থীদেরকে, যারা সরকারি প্রাইমারি স্কুলে পড়াশুনা করে তাদেরকে প্রতিদিনের পড়া বুঝিয়ে ও শিখিয়ে দেয়া হয় এবং পাশাপাশি বাহ্যিক বিষয়েও শিক্ষা দেওয়া হয়। শিশুবান্ধব পরিবেশে এই শিক্ষা কেন্দ্রে শিশুদের পরিবেশ ও প্রাণবৈচিত্র্যের সাথে মানুষের যে সম্পর্ক, সেসব বিষয়েও শিক্ষা দেয়া হয়। এখানে প্রতিদিনের স্কুলের পড়া প্রতিদিন যত্নসহকারে আদায়ের ব্যবস্থা নেয়া হয়।
শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটি শুরু করার পর থেকে কুমার সম্প্রদায়ের শিশুরা স্কুলের পড়ায় দিন দিন উন্নতি করতে থাকে। শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে নিয়মিত পাঠ নেয়ার পর থেকে বাখরপুর কুমার শিশুরা প্রতিবছরই প্রাথমিক শিক্ষা সমাপনী পরীক্ষায় সফলতার সাথে উত্তীর্ণ হচ্ছে। অনেক কুমার শিশু শুধুমাত্র জিপিএ ৫ পেয়েই কৃতকার্য হচ্ছে না, পাশাপাশি প্রাথমিক শিক্ষা বৃত্তিও লাভ করছে। বিগত তিন বছরে এই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের ৫জন কুমার শিশু শিক্ষার্থী জিপিএ-৫ এবং দুইজন সাধারণ শিক্ষা বৃত্তি পেয়েছে। কুমার শিশু শিক্ষার্থীরা এখন স্কুলের বার্ষিক ক্রীড়া প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে প্রথম/দ্বিতীয় স্থান পেয়ে বিজয়ী হচ্ছে।
অন্যদিকে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে নৈতিক শিক্ষার ফলে কুমার শিশু শিক্ষার্থীদের মনোবল বৃদ্ধি পেয়েছে। তাদের মন থেকে সকল ভ্রান্ত ধারণা অনেকটা দূর হয়েছে, এখন আর তারা নিজেদেরকে সমাজের নিচু জাতের সন্তান মনে করেনা। তারা এখন আত্মবিশ্বাসে বলিয়ান হয়ে গড়ে উঠছে। তারা এখন ভাবতে পারছে যে, তাদেরও অন্যান্য সম্প্রদায়ের শিশুদের মত প্রতিভা রয়েছে, তারাও পারবে সত্যিকারের শিক্ষায় শিক্ষিত হয়ে সম্মানের সাথে সমাজে মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে। আর এর জন্য তাদের প্রয়োজন শুধুমাত্র আত্মবিশ্বাস ও সামান্য সহযোগিতার। কুমার জনগোষ্ঠীর শিশু ও অভিভাবকরা মনে করেন যে, সমাজের সকল জাতি, ধর্ম ও পেশার মানুষই সমান। তাই কেন তারা উন্নয়ন থেকে নিজেদের পিছিয়ে থাকবে। কুমার শিশুরা ছবি আকঁতে পারে, গান গাইতে পারে, পড়তে পাড়ে, বিভিন্ন প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণ করে বিজয়ী হতে পারে। শিশুরা মনে করে যে, তারা শিল্পীর সন্তান। তাদের সকলের বাবা-মা শিল্পী, তাই তাদের পেশাকে নিচু করে দেখার কোনো কারণ থাকতে পারে না। ইচ্ছা করলেই যে কেউ মাটি দিয়ে কোনো জিনিস তৈরি করতে পারবে না। মাটি দিয়ে কোন জিনিস তৈরি করা কঠিন, আর সেই কঠিন কাজটি তাদের বাবা-মা অবলীলায় করছেন এবং তা থেকে আয় হয় তা দিয়েই তাদের জীবিকা নির্বাহ করছে।
কুমার সম্প্রদায়ের শিশুদের এতদূর পর্যন্ত এগিয়ে আসাকে বারসিকের সহযোগিতায় প্রতিষ্ঠিত বাখরপুর শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের মূল অবদান বলে মনে করছে কুমার পাড়ার শিশু ও অভিভাবকগণ। বর্তমানে অভিভাবকদের অনেকেই শিশুশিক্ষা কেন্দ্রটিকে স্থায়ীভাবে প্রতিষ্ঠিত করতে আগ্রহ প্রকাশ করছেন। কুমার শিশুদের পরিবেশ ও সমাজের সাথে তাল মিলিয়ে চলতে, মানসিকভাবে গড়ে উঠতে শিশুশিক্ষা কেন্দ্র খুবই গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে। অভিভাকরা আরও মনে করেন যে, সমাজের পিছিয়ে পড়া যেসব জনগোষ্ঠীর শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও পরিবেশ সম্পর্কে সচেতনতার অভাব রয়েছে, সেইসব সমাজের কোমলমতি শিশুদের অজ্ঞতা থেকে তুলে এনে উজ্জ্বল ভবিষ্যতের স্বপ্ন দেখার সুযোগ করে দিতে পারে এধরণের শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে। কারণ বারসিক যে নিয়মে শিশুশিক্ষা কেন্দ্রে পরিচালনা করে সেখানে শিশুরা অনায়াসে তাদের মনের কথা শিক্ষিকার কাছে প্রকাশ করতে পারে। শিশুশিক্ষার্থী ও পাঠদানকারী শিক্ষকের মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ো তোলা গেলেই শিশুদের বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ সৃষ্টি হবে বলে মনে করেন কেন্দ্রটির পাঠদানকারী রিকু রানী পাল।
শিশুরা তাদের মনের কথা ও ইচ্ছার কথা শিক্ষকের নিকট প্রকাশ করতে পারে ফলে শিক্ষক ও শিশু শিক্ষার্থীর মধ্যে বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক গড়ে ওঠে। শিশুরা শিক্ষার প্রতি আকৃষ্ট হয়। শিশুবান্ধব শিক্ষার পরিবেশ না থাকলে যুগের পর যুগ এভাবেই পিছিয়ে থাকবে স্বপ্ন চারি অনেক শিশুই। সুশীল সমাজ একটু সহযোগিতার হাত বাড়িয়ে দিলেই সমাজের সকল পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির শিশুরা সমানভাবে বেড়ে ওঠার সুযোগ পাবে। বর্তমান সরকার যে গওঝঝওঙঘ ২১ হাতে নিয়েছেন সে লক্ষ্যে পৌছাতে হলে অবশ্যই দেশের সকল পিছিয়ে পড়া ও অবহেলিত জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার জনগোষ্ঠীকে সকল বিষয়ে সমান অধিকার ও সুযোগ দিতে হবে। কোন জাতি বা পেশার জনগোষ্ঠীকে বাদ দিয়ে সত্যিকারের উন্নয়ন সম্ভব নয়। সমাজের সচেতন স্বেচ্ছাসেবী ও শিক্ষানুরাগী জনগোষ্ঠী এবং সরকারি ও বেসরকারি সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানসমূহ কুমার সম্প্রদায়ের শিশুদের জন্য প্রতিষ্ঠিত শিশুশিক্ষা কেন্দ্রের মত অন্যান্য পিছিয়ে পড়া জনগেষ্ঠীর শিশুদের জন্য শিক্ষার সুযোগ করে দিতে সহযোগিতার হাত প্রসারিত করে এগিয়ে আসবেন বলে আশা করি। জাতি, ধর্ম, বর্ণ ও পেশার ভেদাভেদ না করে সকলকে সমান সুযোগ ও সমান অধিকার দিয়ে এবং পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সেবা নিশ্চিত করা হলেই এসডিজি অর্জন সম্ভব হবে। আমাদের এদেশটি সত্যিকারের একটি উন্নত দেশ হিসেবে গড়ে উঠবে।