হাওরের যোগাযোগ ব্যবস্থার উন্নয়ন ও শস্য বীমা চালুর দাবি
নেত্রকোনা থেকে সোহেল রানা
১৭ ডিসেম্বর ২০১৯ রোজ মঙ্গলবার বারসিক, গোবিন্দশ্রী তলার হাওর কৃষক সংগঠন ও উচিতপুর আলোর দিশারী যুব সংগঠনের উদ্যোগে মদন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার সম্মেলন কেন্দ্রে ‘হাওরের ফসল সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থাপনার উন্নয়ন’ শীর্ষক এক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। বারসিক’র সহযোগি সমন্বয়কারী শংকর ¤্রং এর সঞ্চালনায় সম্প্রসারণ কৃষি কর্মকর্তা রায়হানুল হকের সভাপতিত্বে মতবিনিময় সভায় প্রধান অতিথি হিসেবে অংশগ্রহণ করেন উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা ওয়ালীউল হাসান। এছাড়াও উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা, প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসার (পিআইও), গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান, উপজেলা খাদ্য গোডাউন কর্মকর্তা, হাওরাঞ্চলের কর্মরত বিভিন্ন এনজিও প্রতিনিধি, শিক্ষক, গণমাধ্যম কর্মী যুব ও কৃষক প্রতিনিধিসহ মোট ২৬ জন অংশগ্রহণ করেন।
মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণকারী গোবিন্দশ্রী ও মদন সদর ইউনিয়নের কৃষক-কৃষাণী ও যুব প্রতিনিধি হাওরাঞ্চলে বোরো মৌসুমের ফসল সংগ্রহ, সংরক্ষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ ও যোগাযোগ ব্যবস্থার ক্ষেত্রে বিভিন্ন সমস্যা তুলে ধরে এর প্রতিকারে উদ্যোগ গ্রহণের জন্য বিভন্ন দাবি- দাওয়া তুলে ধরেন। অংশগ্রহণকারীরা জানান, বর্ষায় হাওরের গোপাটের রাস্তাগুলো (হাওরের মধ্যিখানের কাঁচা রাস্তা) ৬/৭ মাস পানিতে ডুবে থাকায় অধিকাংশ স্থানে ভেঙ্গে যায়, ফলে বোরো ধান পাকলে হাওরের প্রত্যন্ত এলাকার ধান পরিবহন করে বাড়ি আনা কষ্টকর হয়ে পড়ে। গোপাটের ভাঙ্গা রাস্তায় ট্রলিতে ধান পরিবহন খরচ বেড়ে যাওয়ায় উৎপাদন খরচও বেড়ে যায়, সে তুলনায় কৃষকরা ধানের তেমন মূল্য না পেয়ে প্রতিবছর ব্যাপক ক্ষতির সম্মূখীন হচ্ছে। অনেকে ধান চাষ করে ঋণগ্রস্ত হয়ে কৃষি পেশা ছেড়ে শহরে গিয়ে অন্য পেশায় নিয়োজিত হচ্ছে। ফলে অনেক কৃষি জমি পতিত থাকার আশঙ্কা করছেন কৃষকরা। অংশগ্রহণকারীরা বোরো মৌসুমে হাওরের অধিকাংশ ধান যেসব গোপাটের রাস্তায় পরিবহন করা হয় সেসব রাস্তা আসন্ন বোরো মৌসুমের ধান সহজে পরিবহনের জন্য (গোবিন্দশ্রী ও মদন সদর ইউনিয়ন) দ্রুত সংস্কার করার দাবি জানান। মতবিনিময় সভায় অংশগ্রহণকারীরা যেসব দাবি তুলে ধরেন সেগুলো হল-
মদন সদর ইউনিয়নের মিনি কক্সবাজার খ্যাত উচিতপুর থেকে হাওরের দিকের রাস্তা সংস্কার ও উন্নয়ন করা, উচিতপুর ব্রীজ সংলগ্ন বেরিবাঁধটি মাটি কেটে উঁচু করে ছোট পরিবহন (ভ্যান বা অটো) চলাচলের উপযুক্ত করে তোলা, কুলাউটি স্কুল থেকে কয়ার বিলের রাস্তাটি মাটি কেটে সংস্কার করে পরিবহন চলাচলের উপযোগি করে তোলা। সদর ইউনিয়নের বাশরী ঈদগাঁ থেকে গোপাটের রাস্তাটি মেরামত করা, সরকারীভাবে সকল কৃষকদের নিকট থেকে সরসরি ধান কেনার উদ্যোগ নেয়া, হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য শস্য বীমা চালু করা, কৃষকদের জন্য পেনশন স্কিম চালু করা, রাইস হারভেস্টিং মেশিন হাওরাঞ্চলের কৃষকদের জন্য সহজলভ্য করা, আধুনিক কৃষি সম্পর্কীত তথ্য ও কৃষি বিভাগের সেবাসমূহ সকল শ্রেণীর কৃষকদের জন্য সহজলভ্য করা এবং উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তাদের মাঠ পরিদর্শনের হার বৃদ্ধি করা, হাওরাঞ্চলে (গোবিন্দশ্রী) ফসল সংরক্ষণের জন্য গোডাউন নির্মাণ করা এবং ধান ফসলের ন্যায্য মূল্য নিশ্চিতকরণ।
কৃষকদের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করে গণমাধ্যম কর্মী মোতাহার হোসেন, শিক্ষক ইসমাইল হোসেন ও মাজহারুল ইসলাম খোকন জানান, এসব রাস্তা সংস্কার ও মেরামতের জন্য প্রতিবছর বরাদ্দ থাকলেও সে বরাদ্দগুলো সঠিকভাবে খরচ হয় না। তাই তারা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার নিকট এসব রাস্তা সংস্কার ও মেরামতের দাবিী জানান।
অনুষ্ঠানের প্রধান অতিথি উপজেলা নিবাহী কর্মকর্তা ওয়ালীউল হাসান আধুনিক চাষাবাদ পদ্ধতির ব্যবহার ও পরিবেশসম্মত উৎপাদন পদ্ধতি সম্পর্কে হাওরাঞ্চলের কৃষকদেরকে প্রশিক্ষিত করতে বারসিকসহ সংশ্লিষ্ট বিষয়ে কর্মরত সকল এনজিওদেরকে প্রয়োজনে কৃষি বিভাগের সহযোগিতা নিয়ে কাজ করার আহবান জানান। তিনি বলেন, ‘হাওরের একমাত্র ফসল বোরো ধান কাটার সময় এগিয়ে আসলে কৃষকরা যেমন দুশ্চিন্তায় থাকেন এই ভেবে যে, কখন বৃষ্টি হয়ে আগাম বন্যা আসে, তেমনি প্রশাসনও তখন দুশ্চিন্তা করে এবং সৃষ্টিকর্তার নিকট প্রার্থনা করেন যেন বৃষ্টি না হয়।’ ধানের ন্যায্য মূল্য সম্পর্কে তিনি বলেন, ‘হাওরের ধান ফসলের অধিকাংশ ব্যবসায়ীই অন্য জেলার মিল মালিকরা। হাওরাঞ্চলে অটো রাইসমিল স্থাপনের জন্য নেত্রকোনার ব্যবসায়ীদেরকে উৎসাহিত করা গেলে কৃষকরা ধানের ন্যায্য মূল্য পেতে সক্ষম হবেন।’ হাওরাঞ্চলের পরিবেশ উন্নয়নে তিনি পানি সহনশীল বৃক্ষ (হিজল, করচ ইত্যাদি) রোপণ এবং গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নে সরকারের স্থাপন করা নতুন গুচ্ছগ্রামে হাওর উপযোগি বনায়নের জন্য বারসিক এর প্রতি আহবান জানান।
ধানের ন্যায্য মূল্য সম্পর্কে বলতে গিয়ে সম্প্রসারণ কৃষি কর্মকর্তা রায়হানুল হক বলেন, ‘কৃষি ক্ষেত্রে উৎপাদন খরচ কমিয়ে উৎপাদন বাড়াতে পারলেই কৃষকরা ফসলের ন্যায্য মূল্য পাবেন। যতদিন পর্যন্ত কৃষকরা উৎপাদন খরচ কমাতে না পারবেন ততদিন তারা ন্যায্যমূল্য থেকে বঞ্চিতই থেকে যাবেন। কারণ বাজার মূল্য নির্ধারণ করেন ধানের মিলের মালিক ও ব্যবসায়ীরা।’ তাই তিনি সকলকে অতিমাত্রায় রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে পরিমিত ব্যবহার করা, জৈব সার ও বালাইনাশকের ব্যবহার বৃদ্ধি করতে হবে। তিনি যে কোন কৃষি ফসলের বীজ রোপণ বা বপনের পূর্বে বীজ শোধন করে চাষ করলে এবং লগো ও লাইন পদ্ধতিতে ধান রোপণের পরামর্শ দেন। বীজ শোধন করে রোপণ/বপন করলে অনেক রোগ থেকে ফসল রক্ষা পাবে। লাইন ও লগো পদ্ধতিতে ধান রোপণ করলে জমিতে পরিমিত আলো-বাতাস চলাচল করতে পারবে, ফলে ফসল যেমন ভালো হবে তেমনি রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ কম হবে এবং উৎপাদন খরচ কমবে। উৎপাদন খরচ কম হলে বাজারে ফসলের মূল্য বেশি না হলেও কৃষকরা ক্ষতিগ্রস্ত হবে না। তিনি ইউনিয়নের দায়িত্বে থাকা উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তার পরামর্শ নিয়ে চাষাবাদের পরামর্শ দেন।
মতবিনিময় সভায় আরও আলোচনা করেন উপজেলা যুব উন্নয়ন কর্মকর্তা আব্দুল আহাদ, উপজেলা প্রজেক্ট ইমপ্লিমেন্টেশন অফিসার শওকত জামিল, গোবিন্দশ্রী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান এ.কে.এম. নূরুল ইসলাম, বারসিক’র অহিদুর রহমান প্রমূখ।