নিভা রাণী পাল এগিয়ে যাওয়ার শক্তি

নেত্রকোনা থেকে মো. অহিদুর রহমান

হাতের ছোঁয়ায় মাটি হয়ে উঠে শিল্প। আমাদের গ্রাম বাংলায় আজো মাটি দিয়ে খুব নিপুণ হাতে তৈরি হয় নানান ধরণের প্রয়োজনীয় সামগ্রী। খুবই সস্তা কিন্তু এই পরিবেশবান্ধব শিল্পকে টিকিয়ে রেখেছে আমাদের দেশের কুমার সম্প্রদায়। বর্তমানে প্লাস্টিক আর স্টিলের জামানায় মাটির তৈরি হস্ত শিল্প হুমকির মুখে পড়লেও এ থেকে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখেন নিভা রাণী পাল।
নেত্রকোনার পালপাড়ায় বংশ পরম্পরায় প্রতিযোগিতার বাজারেও দ্রারিদ্রতার সাথে সংগ্রাম করে আজও রক্ষা করে চলেছেন নিজেদের পূর্ব-পুরুষদের পেশা। তাদের হাতেই প্রতিদিন তৈরি হয় হাড়ি, পাতিল, ঢাকনা, পুতুল, শোপিচসহ নানান ধরণের পণ্য।

কুমার সম্প্রদায়ের খোঁজ নিতে গেলে দেখা যায়, সমাজে আজও তারা মাথা উচুঁ করে দাড়াঁতে পারেনি। বর্তমান আধুনিক যুগের সাথে তাল মিলিয়ে দ্রুততার সাথে পরিবর্তীত হচ্ছে আমাদের জীবনধারা, অভ্যাস, নিত্য প্রয়োজনীয় আসবাবের আদল, রঙ ও স্থায়িত্ব। সেগুলো পরিবেশবান্ধব কিনা তাও দেখার ফুসরত নেই আধুনিক মানুষের। আমাদের দেশে এখন আর আগের মতন কদর নেই কুমারদের। এছাড়া মাটি নেই, বাজারে জিনিসের দাম নেই, মেলার আয়োজন নেই এমনকি কেনার লোকও নেই। এরকম সার্বিক সংকটে নিমজ্জিত কুমার সম্প্রদায় ও তাদের পেশা।

dsc04339
তাহলে কোথায় যাবে নিভা রাণীরা? তবে অনেকের ভেতর ব্যতিক্রম নিভা রানী। প্লাস্টিক, পলিথিনের, স্টিলের রাজ্য থেকে নিজেদের  পেশার ঐতিহ্যকে রক্ষা, সমাজে নিজেদের সম্মানের জায়গায় প্রতিষ্ঠিত করতে তার উদ্যোগ সাড়া ফেলেছে পাল পাড়ার সাধারণ মানুষের মধ্যে।

পরিবারের অসচ্ছলতা, সমাজে নিম্ন শ্রেণী হিসেবে তাদেরকে বিবেচনা করায় তাদের মেয়েদের লেখাপড়ায় সুযোগ ও উৎসাহ কোনটাও পাননি বিধায় নিভা রাণী তেমন লেখাপড়া তেমন করতে পারেননি। কুমার পরিবারে জন্ম হওয়ায় পুঁথিগত বিদ্যা না পেলেও শৈল্পিক শিক্ষা এবং সমাজে একত্রে থাকার মন মানসিকতা পেয়েছেন। বিয়ে হয় কুমার পরিবারে আর এখন তিনি ৬ সন্তানের জননী। তার পরিবার থেকে পাওয়া শৈল্পিক শিক্ষা বিবাহিত জীবনের জীবিকায়নের পথকে আরো সুগম করে। সন্তানদের ভরণপোষণ, লেখাপড়া, বিয়ে, স্বামীর সাথে সাথে অর্থনৈতিক কাজে মাটির উপকরণ তৈরি করে সহযোগিতা করেন। তিনি বলেন, “আমাদের পেশা দিন দিন ঝুঁকির মধ্যে পড়ে গেছে। বর্তমানে মাটি পাওয়া যাচ্ছে না, প্লাস্টিকের উপকরণে বাজার ভরে গেছে, মেলা কমে গেছে, জিনিসের দাম কম। তবুও আমাদের বাঁচতে হবে, আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে বাঁচাতে হবে”।

dsc06463
একসময় কুমার নারীদের নিয়ে গড়ে তোলেন মাটিই জীবন কুমার নারী সংগঠন। নারীদের জীবনমান উন্নয়নের জন্য প্রতিমাসে আলোচনায় তাদের সমস্যার কথা এনে তা সমাধানের চেষ্টা করেন। পালপাড়ার শিশুদের শিক্ষার উন্নয়নের জন্য একটি শিশু শিক্ষা ও স্বাস্থ্যকেন্দ্র গড়ে তোলেন। সেখানে ২১ জন পিছিয়ে পড়া শিশু শিক্ষা, স্বাস্থ্য সংক্রান্ত বিষয়, সাংস্কৃতিক চর্চা, পরিবেশ রক্ষায় শিশুদের সচেতন করে তোলার জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। তিনি নারীদেরকে সঞ্চয়ে উৎসাহী করছেন। বর্তমানে তাদের জমানো টাকার পরিমাণ ৩৫০০০/(পয়ত্রিশ হাজার) টাকা। তাদের উদ্দেশ্য জমানো টাকা দিয়ে মাটি উপকরণ বানানোর জন্য স্প্রে মেশিন ও উন্নত মানের মেশিন ক্রয় করবেন যাতে সহজে উপকরণ তৈরি করা যায়। তিনি ইউনিয়ন পরিষদে যোগাযোগ করে তিনটি পরিবারের জন্য সোলার প্যানেল আদায় করেছেন।

এক কথায় এই পালপাড়ায় মানুষের জীবনমান পরিবর্তন ও তাদের পেশা রক্ষার জন্য তিনি রাত, দিন কাজ করে যাচ্ছেন। এখন নিভা রাণী পালপাড়ার মানুষদের সামনে একজন উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত আর এগিয়ে যাবার শক্তি।

happy wheels 2