উপকূলীয় বাঁধ রক্ষায় গাছ ও ঘাস যৌথ রোপন

শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে মফিজুর রহমান

বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ ও দূর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রাণলয় ঘোষিত জলবায়ু পরিবর্তন ও প্রাকৃতিক দূর্যোগে সবচেয়ে ঝূঁকিপূর্ণ জনপদ উপকূলীয় সুন্দরবন সংলগ্ন উপজেলা শ্যামনগর। আর শ্যামনগর উপজেলার সবচেয়ে জলবায়ু ঝূঁকিপূর্ণ জনপদ দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরা ও পদ্মপুকুর। এক কথায় বৈশ্বিক জলবায়ু পরিবর্তনে পৃথিবীর সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্থ জীবন্ত যাদুঘর এ দুটি দ্বীপ ইউনিয়ন। যার চর্তুদিক নদী দ্বারা বেষ্টিত। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে নানা ধরনের সমস্যা তৈরী হচ্ছে। যেমন-ঝড়, বন্যা, জলোচ্ছ্বাস, ঘূর্ণিঝড়, নদী ভাঙ্গনের মতো ভয়াবহ প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঘন ঘন দেখা দিচ্ছে। ফলে দরিদ্র মানুষই সব চেয়ে বেশী ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে। কারণ উপকূলীয় এলাকার দরিদ্র মানুষ নদীর পাড়ে ও অন্যান্য ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে বসবাস করে।

এই দুটি ইউনিয়নের একটি নিয়মিত সমস্যা হচ্ছে বেড়ি বাঁধ নষ্ট হয়ে যাওয়া। যার ফলশ্রুতিতে বর্ষা মৌসুমে বেড়ি বাঁধ ভেঙে গিয়ে জনপদে নদীর পানি প্রবেশ করে জীবন ও জীবিকা প্রভূত ক্ষতি সাধন করে থাকে। অন্যদিকে তীব্র লবণাক্ত এবং উষ্ণতার কারণে বেড়ি বাঁধে কোন গাছ লাগালেও টিকতো না। স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের একটি মোটা টাকা খরচ হতো এই বেড়ি বাঁধগুলো সংস্কার করার জন্য।

কিন্তু এই এলাকার সংগ্রামী এবং অভিযোজনে পটু মানুষ কি হাত গুটিয়ে বসে থাকতে পারে? না। তাইতো এই বেড়ি বাঁধ ক্ষয় এর একটি সমাধানও বের করে ফেলেছে তারা। গাছ এবং ঘাস এর যৌথ সমন্বয় ঘটিয়ে বেড়ি বাঁধকে রক্ষা করছে ক্ষয় থেকে। বাঁচিয়ে প্রতি বছরের সংস্কারের খরচ। গরু ছাগলের জন্য তৈরি হয়েছে খাদ্য। সর্বোপরি এলাকার ধু-ধু ফাঁকা রাস্তা গুলো ভরে উঠেছে সবুজে।

তরুণ প্রজন্ম এবং বারসিক কার্যক্রমে উদ্বুদ্ধ হয়ে জলবায়ু সমস্যা মোকাবেলায় নদীর চর বনায়নে স্বেচ্ছাশ্রমে বৃক্ষরোপণ অভিযান শুরু করেছে। শ্যামনগর উপজেলার প্রাকৃতিক দূর্যোগ ঝূঁকিপূর্ণ জনপদ পদ্মপুকুর ইউনিয়নের পাখিমারা গ্রামের পরিবেশ বন্ধু নামে খ্যাত জাকির হোসেন এই কার্যক্রমের একজন উদ্যোক্তা। জাকির তার এলাকায় বিভিন্ন মানুষকে সম্পৃক্ত করে বিভিন্ন রাস্তায় স3মাজিক বনায়ন শুরু করে। কিন্তু লবণাক্ততার কারণে মাটি ক্ষয় হয়ে যেতে থাকে।  জাকির হোসেন বলেন, “ কয়েক বছর আগে সামাজিক বন বিভাগ থেকে চারা সংগ্রহ করে এলাকার বিভিন্ন রাস্তায় গাছ লাগানোর চেষ্টা করছি। লবণাক্ত এলাকা হওয়াই খরার সময় রাস্তার সাইডের মাটি ঠোসা ঠোসা (ধুলো ধুলো) হয়ে যায়। পরবর্তীতে বৃষ্টি শুরু হলে মাটি ধুয়ে যায় এবং রাস্তা ভেঙ্গে যায়। প্রতি বছর রাস্তায় মাটি দিতে সরকারের অনেক টাকা খরচ হয়। আমরা স্থানীয় জনগোষ্ঠী মিলে পরীক্ষা মূলকভাবে ২০১৫ সালে চেয়ারম্যান ঘাট থেকে কামালকাটি গ্রামের অনাদীর বাড়ির সামনে পর্যন্ত রাস্তার দুই ধার দিয়ে গাছ এবং ঘাস লাগাই।” রাস্তায় গাছ এবং ঘাস হওয়ার ফলে একদিকে যেমন প্রাণী সম্পদের খাদ্যের উৎস্য তৈরী হয়েছে। তেমনি সরকারের হাজার হাজার টাকার সংস্কার খরচ বেঁচে যাচ্ছে।

4বনায়ন রক্ষা কমিটির সভাপতি মো: শফিউল আযম বলেন, “গাছের চারা রোপনের পর অতিরিক্ত বৃষ্টির শুরু হলে ভেড়ি বাঁধের রাস্তার মাটি ভেঙ্গে যাচ্ছিল এবং গাছের গোড়ার মাটি সরে যেয়ে গাছ পড়ে যাচ্ছিল। তখন আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ আলোচনা করতে থাকি কি ভাবে এটা রোধ করা যায়? আলোচনার এক পর্যায়ে রাস্তার দুই ধার দিয়ে ঘাস লাগানোর কথা উঠে আসে। ঘাস লাগালে যেমন মাটি ক্ষয় রোধ হবে তেমনি অতিরিক্ত খরার সময় রোদের তীব্রতায় লবণের হাত থেকে গাছ গুলো কিছুটা হলেও রক্ষা পাবে।” তিনি আরো বলেন, “আমরা নিজেরা স্বেচ্ছাশ্রম দিয়ে প্রায় এক কিলোমিটার ওয়াপদা বেড়ি বাঁধের রাস্তার দুই ধার দিয়ে ঘাস লাগানোর সিদ্ধান্ত গ্রহন করি এবং ঘাস লাগাই। ঘাস তৈরী হওয়ার ফলে রাস্তা ভাঙ্গন রোধ হয়েছে এবং ঘাস এলাকার গরু-ছাগলের খাবারের চাহিদা মিটছে।”

প্রাক্তন ইউপি সদস্য মো: আশরাফ হোসেন বলেন, “আমি যেহেতু পূর্বে ইউপি সদস্য ছিলাম- তাই আমি জানি এই এলাকার রাস্তা সংস্কারের কত বেশি টাকা লাগে। বেড়ি বাঁধের রাস্তায় গাছ ও ঘাস লাগানোর পূর্বে প্রতি বছর রাস্তার দুই ধার দিয়ে মাটি দিতে খরচ হতো প্রায় ৯৮০০০ টাকা (চেয়ারম্যান ঘাট থেকে দক্ষিণ পাখিমারা শেষ সীমানা ইবাদুল সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত)। কিন্তু ২০১৬ সালে চেয়ারম্যান ঘাট থেকে পাখিমারা ইবাদুল সাহেবের বাড়ি পর্যন্ত দুই এক স্থানে ছাড়া কোথাও মাটি দেওয়া লাগে নি। তাতে দেখা যায় সরকারের অনেক টাকা কম খরচ হয়েছে। তাই গাছ ও ঘাস গুলো যাতে নষ্ট না হয় তার জন্য ইউনিয়ন পরিষদ থেকে সব ধরনের সহায়তা করা হয়েছিল এবং বর্তমান চেয়ারম্যান ও সেটা অব্যাহত রেখেছেন।”

6
বিধবা অনামিকা মন্ডল বলেন “ওপদা রাস্তায় ঘাস হওয়ার ফলে আমি ভেঁড়া পালন করতে পারছি। আমাদের এলাকা লবণ পানির ঘের হওয়ার ফলে মাঠে কোন প্রকার ঘাস হয় না। নিজের খাবার সংগ্রহ করতে যেখানে হিমশিম খেতে হয় সেখানে ছাগল/ভেড়ার খাদ্য কিনে পোষা সম্ভব হয় না। এখন সারা বছর ভেড়া পালন করছি এবং বিক্রি করে আর্থিক ভাবে লাভবানও হচ্ছি।”

প্রতিকূল পরিবেশে টিকে থাকা এবং সেই প্রতিকূল পরিবেশকে অনুকূল করে নেয়া মানুষের স্বাভাবজাত বৈশিষ্ট্য। আর সেটি যদি হয় উপকূলীয় এলাকার জনগোষ্ঠী। তাহলে সেটি হতে পারে এক অনুকরণীয় দৃষ্টান্ত। এই উদ্যোগটি যদি সমগ্র ইউনিয়নে ছড়িয়ে দেয়া যায় তাহলে প্রাকৃতিক দূর্যোগে জনপদ এবং জানমালের ক্ষতির পরিমাণ অনেকাংশেই কমে যাবে।

happy wheels 2

Comments