দুবলার চরের রাস উৎসব-ব্যস্ত সময় পার করছেন দর্শনার্থীবৃন্দ
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
বঙ্গোপসাগরের পাড়ে সুন্দরবনের দুবলার চরের আলোরকোলে অগ্রহায়ণ মাসের ভরা জোয়ারের পূর্ণিমা তিথিতে শুরু হয় ঐতিহ্যবাহী রাস উৎসব। দুবলার চরের এই রাস উৎসব প্রায় ২০০ বছরের পুরানো একটি ঐতিহ্য। সনাতন ধর্মাবলম্বীদের তিন দিনব্যাপী আলোর কোলের এই উৎসবকে ঘিরে কয়েক লাখ দেশী বিদেশী দর্শনার্থীর সমাগম ঘটে।
সুন্দরবনের আলোর কোলের এই রাস উৎসব নিয়ে কথিত আছে, ১৯২৩ সালে ঠাকুর হরিচাঁদের অনুসারী হরি ভজন নামে এক হিন্দু সাধু এই মেলা শুরু করেছিলেন। তিনি চব্বিশ বছরেরও বেশি সময় ধরে সুন্দরবনে গাছের ফল-মূল খেয়ে অলৌকিক জীবনযাপন করতেন। অন্য একটি মতে, হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের অবতার শ্রীকৃষ্ণ শত বছর আগের কোনো এক পূর্ণিমা তিথিতে পাপমোচন এবং পুণ্যলাভে গঙ্গা স্নানের স্বপ্নাদেশ পান।। সেই থেকে শুরু হয় রাসমেলার। আবার কারও কারও মতে, শারদীয় দুর্গোৎসবের পর পূর্ণিমার রাতে বৃন্দাবনবাসী গোপীদের সঙ্গে রাসনৃত্যে মেতেছিলেন শ্রীকৃষ্ণ। এ উপলক্ষেই দুবলার চরে পালিত হয়ে আসছে রাস উৎসব।
আবার আব্দুল জলিলের সুন্দরবনের ইতিহাস গ্রন্থ থেকে জানা যায়, বিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় দশকে ফরিদপুর জেলার ওড়াকান্দি গ্রামের জনৈক হরিচাঁদ ঠাকুর স্বপ্নাদিষ্ট হয়ে পূজা পার্বণাদি ও অনুষ্ঠান শুরু করেন দুবলার চরে গিয়ে। তারপর থেকে মেলা বসছে। লোকালয়ে এই মেলা নীল কমল নামে পরিচিত। সবশেষে মুক্তিযোদ্ধা মেজর অব জিয়াউদ্দিন এই রাস উৎসবকে পূর্ণাঙ্গভাবে ও বৃহৎ পরিসরে আয়োজন করেন। বনের ভেতরের আটটি পথ দিয়ে মেলায় এসেছে বিভিন্ন ধর্মের উৎসুক লোকজন। এই রাস মেলাকে ঘিরে গোটা সুন্দরবনে নেওয়া হয়েছে নিছিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। দুবলার চরের রাস মেলার রূপকার মুক্তিযোদ্ধা মেজর অব জিয়াউদ্দিনের জীবনী নিয়ে একটি তথ্যচিত্র প্রদর্শণী করার মধ্য দিয়ে শুরু হয় রাস উৎসব। পরের দিন (২২ নভেম্বর) শ্রী কৃষ্ণের রাসলীলা ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠিত হয়।
এবছর ২০১৯ সালে সুন্দরবনের দুবলার চরের রাস উৎসবকে ঘিরে ব্যস্ত সময় পার করছেন দর্শানার্থী, পূর্ণার্থী ও মাঝি মাল্লারা। এবছর ১১, ১২ ও ১৩ নভেম্বর ২০১৯ তিন দিনব্যাপী রাসমেলা অনুষ্ঠিত হবে। আগামী ১১ নভেম্বর সোমবার সকাল ৯টার সময় স্থানীয় ফরেষ্ট এর রেঞ্জ অফিস থেকে পাশ পারমিট সংগ্রহ করে সকল নৌযান একযোগে আলোর কোলের উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। এই রাস মেলাকে ঘিরে গোটা সুন্দরবনে নেওয়া হয়ে থাকে নিশিদ্র নিরাপত্তা ব্যবস্থা। সাতক্ষীরার শ্যামনগরের মুন্সিগঞ্জ, কলবাড়ী, চুনকুড়ি, বুড়িগোয়ালিনী, নওয়াবেকীসহ বিভিন্ন এলাকায় সুন্দরবনের রাস উৎসবকে ঘিরে স্থানীয়দের মধ্যে ব্যস্ততা দেখা যায়। আর মাত্র কয়েকদিন বাকি থাকায় ছোট বড় বোর্ডগুলো সংস্কার ও সুসজ্জিতকরণ এবং শেষ মুহুত্বের কেনাকাটা ও সাজগোছের মধ্য দিয়ে ব্যাস্ত সময় পার করছেন স্থানীয় এলাকাবাসী ও সকল দর্শনার্থীবৃন্দ।
প্রতিবছরের ন্যায় বারসিক, সুন্দরবন স্টুডেন্ট সলিডারিটি টিম, সিডিও এবং উপজেলা জনসংগঠন সমন্বয় কমিটি যৌথভাবে তিনদিনব্যাপি ‘সুন্দরবন উপকূল-বৈচিত্র্য সুরক্ষায় প্রবীণ-নবীন সংহতি’ শীর্ষক এক কর্মসূচির আয়োজন করছে। এ সময়টাতে সুন্দরবনের দুরবলারচরে রাসমেলায় আগত পূণ্যার্থী, দর্শনার্থী, পর্যটক, বনবিভাগ, গণমাধ্যম, প্রশাসন, স্থানীয় সরকার ও অন্যান্য পেশাজীবী জনগণের মাঝে সুন্দরবন ও উপকুল সুরক্ষার মূল সুর পৌছে দেওয়ার জন্য উক্ত প্রচারাভিযান পরিচালনা করা হবে।
সুন্দরবনের আলোর কোল দ্বীপেই বসে সুন্দরবনের সবচেয়ে বড় উৎসব রাসমেলা। কয়েক লাখ দেশী বিদেশী পর্যটকদের উপস্থিতিতে প্রতি বছর কার্তিক-অগ্রহায়ণ মাসের ভরা পূর্ণিমা তিথিতে তিন দিনব্যাপী উদযাপিত হয়। আগামী ১৩ নভেম্বর বুধবার পূর্ণস্নানের মধ্য দিয়ে শেষ হবে সুন্দরবনের দুবলার চরের রাস উৎসব।