সাম্প্রতিক পোস্ট

নাচোলের রুক্ষ মাটিতে কালো সোনার ছোঁয়ায় ফিরছে মাটির প্রাণ, খরচ কমছে কৃষকের

বরেন্দ্র অঞ্চল থেকে মোঃ শহিদুল ইসলাম
স্থানীয় উপকরণ ব্যবহার করে কৃষক সংকটকালিন সময়ে নিজের সমস্যাগুলো সমাধান করে থাকেন। করোনা মাহামারি কেটে উঠতে না উঠতেই সারাবিশে^ যুদ্ধের দামামার কারণে জ¦ালানির সংকট, একইসাথে রাসায়নিক কীটনাশকের অপ্রতুলতা ও অত্যাধিক দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষকের উৎপাদন খরচ বেড়ে গেছে দ্বিগুণের থেকে বেশি। বৈশি^ক সংকটগুলো যখন একটি গ্রামের মানুষগুলোকেও সমস্যায় ফেলে দেয়, তখন স্থানীয় মানুষ নিজের জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং স্থানীয় সম্পদ ব্যবহার করে সংকটগুলো কাটিয়ে উঠার চেষ্টা করেন। তেমনই একটি দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন খরাপ্রবণ উচ্চ বরেন্দ্র অঞ্চল হিসেবে খ্যাত চাঁপাইনবাবগঞ্জের নাচোল উপজেলার কৃষকরা।
শুরুটা ২০১৭ সাথে। পরীক্ষামূলকভাবে ১০টি চারিতে প্রায় দুই হাজার কেঁচো দিয়ে ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন করতে থাকেন বারসিক’র কৃষি গবেষক রায়হান কবির রঞ্জু (৪৬)। তিনি লেখাপড়া করেছেন দশম শ্রেণী পর্যন্ত। কৃষি ও কৃষকের জ্ঞান অভিজ্ঞতাগুলো বিনিময় এবং নিজ থেকে কৃষির বিভিন্ন সমস্যাগুলো সমাধানে প্রতিনিয়িত কাজ করে চলেছেন রায়হান কবির রঞ্জু। তাঁর নিজস্ব অভিজ্ঞতা দিয়ে দিনে দিনে তিনি ভার্মিকম্পোস্ট সার তৈরি, ব্যবহার এবং ফলাফল নাচোল এলাকার কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিয়েছেন। যার ফলে দিনে দিনে এই এলাকায় কৃষকদের মধ্যে ভার্মিকম্পোস্ট সার তৈরি, ব্যবহার এবং উৎপাদন বেড়েছে।


প্রত্যক্ষ মাঠ পর্যবেক্ষণে দেখা যায়, ওই এলাকায় প্রায় একে একে ১৫টি গ্রামে প্রায় ২১ জন কৃষক-কৃষাণী এই ভার্মিকম্পোস্ট উৎপাদন করছেন। উৎপাদনকারি কৃষকদের তথ্য মতে জানা যায়, প্রতিমাসে প্রায় ১৪ হাজার কেজি ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন করে থাকেন কৃষক-কৃষাণীরা। বর্তমান প্রতিকেজি ভার্মিকম্পোস্ট সারের বাজার মূল্য ১৪ টাকা হারে মোট মূল্য দাঁড়ায় এক লাখ ছিয়ানব্বই হাজার টাকা। তাঁরা নিজে ব্যবহার করছেন এবং অতিরিক্ত এসব ভার্মিকম্পোস্ট সার বিক্রি করে আয় করছেন। পর্যক্ষেণে জানা যায়, অতিরিক্ত জৈবসার বিক্রি করে প্রত্যেকজন কৃষক প্রতিমাসে প্রায় গড়ে দুই হাজার টাকার বেশি আয় করছেন। যা তাঁদের পারিবারিক স্বচ্ছলতার দিকগুলোতে অন্যতম ভূমিকা পালন করছে।


এলাকার কৃষকদের সাথে মতবিনিময় এবং প্রত্যক্ষ পর্যবেক্ষণে জানা যায়, এলাকাটিতে প্রায় দুই হাজারের বেশি কৃষক কৃষাণী এই জৈবসার ব্যবহার করছেন, যার জমির পরিমাণ প্রায় ২০ হাজার বিঘা। এলাকার মানুষ এই ভার্মিকম্পোস্টকে কালোসানা হিসেবে অখ্যায়িত করেছেন। এই প্রসঙ্গে চৌড়া পাড়ার কৃষক মোঃ হাবিব ( ৪৫) বলেন, ‘এই কালোসানার জন্য আমাদের রুক্ষ মাটিতে এখন অনেক সুন্দর ফসল হয়। আমাদের এলাকা খরাপ্রবণ, পানির অভাব, এই ভার্মিকম্পোস্ট সার দিলে মাটি ভেজা ভেজা থাকে, রসালো থাকে, পানি কম লাগে, মাটির জীবন যেন আরো ফিরে পায়।’ উল্লেখ্য যে, মোঃ হাবিব ১২০টি চারিতে ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন। তিনি নিজের জমিতে ব্যবহার করে অতিরিক্তগুলো বিক্রি করেন। তিনি জানান, ভার্মিকম্পোস্ট ব্যবহার করে তিনি প্রতি মৌসুমে প্রায় দশ হাজার টাকার বেশি সাশ্রয় করেন। অন্যদিকে ফসলে উৎপাদন ভালো হয়।


এলাকার কৃষকদের তথ্য মতে জানা যায়, ভার্মিকম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে ফলের বাগানে ফলে উৎপাদন বেশি হয়, পুষ্ট শরীর এবং খেতে বেশি সুস্বাদু হয়। আবার রোগ পোকার আক্রমণ কম হয় ভার্মিকম্পোস্ট সার ব্যবহার করলে। এলাকাটিতে বড়ই, পেয়ারা, ধানী ও সবজির জমিসহ সকল ধরনের ফসলে ভার্মিকম্পোস্ট সার ব্যবহার করছেন কৃষকরা।


মাটির গুণাণ এবং আবহাওয়ার কারণে বরেন্দ্র অঞ্চলটি বাংলাদেশের অন্যান্য অঞ্চল থেকে আলাদা বৈচিত্র্য বহন করে। অনাবৃষ্টি খরাসহ মাত্রারিক্ত ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলনের কারণে এখানে পানির সমস্যা লেগেই থাকে। পানির অভাবে চাষাবাদ ব্যাহত হয়। অন্যদিকে বৈশি^ক সংকটের কারণে কৃষি উৎপাদনে ব্যবহৃত উপকরণে দাম বেড়ে যাওয়ায় কৃষক স্থানীয় উপকরণ এবং দক্ষতা, অভিজ্ঞতাগুলো ব্যবহার করে সমস্যার সমাধান করছেন, যা স্থায়িত্বশীল পরিবেশবান্ধব উন্নয়নে অন্যতম অবদান রাখছে। একদিকে রাসায়নিক কীটনাশকের ব্যবহার কম হবার কারণে স্থানীয় পরিবেশ প্রতিবেশ ভালো থাকছে অন্যদিকে কৃষকের আয় বৃদ্ধিসহ ফসল উৎপাদন বৃদ্ধি পাচ্ছে। কৃষক রায়হান কবির রঞ্জুর অভিজ্ঞতা এবং দক্ষতাগুলো দিনে দিনে এই এলাকায় ছড়িয়ে পড়ায় এলাকাটিতে ভার্মিকম্পোস্ট সার উৎপাদন ও ব্যবহার দিনে দিনে বৃদ্ধি পাচ্ছে। অন্যদিকে খরাপ্রবণ বরেন্দ্র অঞ্চলের খরা মোকাবেলায় অভিযোজন কৌশল হিসেবে ভার্মিকম্পোস্ট সার ব্যবহার করে ফলাফল ভালো পাচ্ছেন।

happy wheels 2

Comments