বাংলাদেশের সফলতম ফিঞ্চ ব্রিডার মানিকগঞ্জের দিনার
আব্দুর রাজ্জাক, মানিকগঞ্জ ॥
বন্যেরা বনে সুন্দর, শিশুরা মাতৃক্রোড়ে। এই কথার সূত্রে অনেকেরই ধারণা পাখিরা শুধু বনেই মানানসই। অথচ পৃথিবীতে এমন কিছু পাখি রয়েছে যেগুলো খাঁচাতেই বেশি মানানসই। তার মধ্যে অন্যতম ফিঞ্চ পাখি। প্রকৃতিতে ৩-৪ বছর বাঁচলেও; খাচায় এরা বাঁচে ৭-১০ বছর। টিয়ের মতো দেখতে ছোট প্রজাতির এ পাখিটি নানা রঙ এর হয়। সারাদিন পাখির কিচিরমিচির শব্দে মুখরিত হয় চারদিক।
ইট কাঠের এই শহরে পাখির ডাক শুনে ঘুম থেকে জাগার সৌভাগ্য আমাদের অনেকেরই হয় না। আজকাল শহরে তেমন একটা পাখি দেখাই যায় না। গ্রামাঞ্চলের ঘরের কোনায় যে কয়টা দেশীয় পাখি দেখা যেত তাও আজ অনেকটাই বিলুপ্তির পথে। আমরা সবাই পাখির এই অভাবটা বেশ অনুভব করি। পাখির গুনগুনিয়ে গান করা কিংবা উড়াউড়ির দৃশ্য আমাদের মনকে যেন প্রকৃতির আরো নিবিড়ে নিয়ে যায়। ষড়ঋতুর এই দেশে ঋতুর পরিবর্তনের সংবাদ এই পাখিই আমাদের প্রথম জানান দেয়।
আচ্ছা কল্পনা করুন, যানবাহনের হর্নের শব্দে বাঁধা রুটিন মাফিক জীবনটা যদি শুরু হয় যান্ত্রিকতার বিপরীতে প্রকৃতির ছোঁয়ায়. . .। আমাদের ঘুম ভাঙে যদি পাখির মিষ্টি গানে। আর এটাই যদি হয় মনের ইচ্ছে। তাহলে আমরা বারান্দা বা বাসার ছাদে ইচ্ছে করলেই প্রাকৃতিক পরিবেশ তৈরি করে বিভিন্ন কেসিং বার্ড (খাঁচার পাখি) পালন করতে পারি। যা নিমিষেই আমাদের অবসাদ বা বিষন্নতা দূর করে এনে দিবে এক মানসিক প্রশান্তি।
পাখির প্রতি ভালোবাসা আর মমত্ববোধের টানে আমাদের দেশে সৌখিন পাখি পালকরা অনেক প্রজাতির পাখি পালন করে থাকেন। যেমন বাজরিগার, ডাভ, জাভা, লাভ বার্ড, ফিঞ্চ ইত্যাদি। এদের মধ্যে ফিঞ্চ প্রজাতি হিসেবে পাখি-প্রেমিদের মাঝে ভীষণ জনপ্রিয়। রঙ-বেরঙের এবং বিচিত্র বৈশিষ্টের খাঁচার পাখি মানুষের শখ পূরণের পাশাপাশি হয়ে উঠছে বিনোদন, মানসিক প্রশান্তি লাভ আর অর্থনৈতিক উন্নয়নের অন্যতম একটি উৎস। বর্তমানে শুধু পাখি পালনই নয়, বিভিন্ন প্রজাতির পাখির উৎপাদন করছেন এদেশের ব্রিডাররা। বিগত কয়েক বছরে এই সেক্টর অনেকটাই এগিয়ে গেছে দেশ। খাঁচার পাখি হিসেবে বাজেরিগার, ফিঞ্চ, থেকে শুরু করে লাভবার্ড, ককাটিল, জাভা, টারকুইজিন, রোজেলা, কনিউর, ইন্ডিয়ান রিংনেক প্যারোট, লরি ও লরিকিট, বিভিন্ন রকমের ঘুঘু, আফ্রিকান গ্রে প্যারোট, কাকাতুয়া, ম্যাকাও পর্যন্ত বহু প্রজাতির পাখি বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে।
পাখি ভিত্তিক বিভিন্ন জার্নালের তথ্য-উপাত্ত মারফত জানা গেছে, এদের মূল আবাসস্থল দক্ষিণ গোলার্ধ। দক্ষিণ গোলার্ধের সব স্থানেই হয়তো এদের দেখা যায়, তবে কিছু উপ-পরিবার সব স্থানে পাওয়া যায় না। যেমন একটি উপ-পরিবার কেবল নিওট্রপিক অঞ্চলে দেখা যায়, একটি দেখা যায়, শুধু হাওয়াই দ্বীপপুঞ্জে এবং আরেকটি উপ-পরিবার শুধুই প্যালিআর্কটিক অঞ্চলে পাওয়া যায়। অবশ্য ফ্রিঞ্জিলিডি পরিবারের বাইরেও কিছু প্রজাতিকে সাধারণভাবে ফিঞ্চ নামে ডাকা হয়।
এত পাখির ভিড়ে সবচেয়ে ছোট যেটি সেটি হল ফিঞ্চ, পৃথিবীর সবচেয়ে ছোট খাঁচার পাখি। এই ফিঞ্চের অনেকগুলো নতুন এবং বিরল প্রজাতি ব্রিডিং করাতে সক্ষম হয়েছেন ফিঞ্চ সোসাইটি অব বাংলাদেশ এর হেড অফ এডমিন মানিকগঞ্জের আবদুল হান্নান দিনার (ইউবি দিনার)।
শুরুর কথা
দিনারের পাখি পোষার হাতেখড়ি হয়েছিল তার বাবার আব্দুর রউফ এর হাতে। ছোটবেলা থেকেই তারও শখ হয় নতুন পাখি পালন করবেন। পাখি পালার প্রতি তার আগ্রহ দেখে তার বাবা তাকে যথেষ্ট সুযোগ করে দেন। তবে দিনারের ফিঞ্চ বিপ্লবের কাহিনী বেশি দিনের না। এই তো বছর পাঁচেক আগের কথা। এর আগেও তিনি যথেষ্ট পাখি পুষেছেন কিন্ত ব্যাপক আকারে ফিঞ্চের ব্রিডিং শুরু করেছেন ঐ পাঁচ বছর আগে থেকেই। তার বর্তমান ফিঞ্চের কালেকশন দেখলে যে কারোরই চোখ কপালে উঠতে বাধ্য। স্থানীয় বাজারের পাশাপাশি দেশের বাইরে থেকে ইম্পোর্ট করা বেশ কিছু ফিঞ্চও আছে তার কাছে। সেই শখ থেকে দিনার মানিকগঞ্জ সরকারি দেবেন্দ্র কলেজ থেকে মাষ্টার্স শেষ করে ২০১২ সাল থেকে শখের বসে পাখি পালন শুরু করেন।
আবদুল হান্নান দিনার জানান, বাংলাদেশের পরিবেশ ফিঞ্চ পাখি উৎপাদনের জন্য খুবই ভালো। শুধু দরকার যথেষ্ট ধৈর্য্য, জ্ঞান, অভিজ্ঞতা এবং পাখির প্রতি ভালোবাসা। সেই সাথে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম কমানো, এ্যাভিয়ান সাপ্লিমেন্টের সরবরাহ, পাখির এবং পাখির খাবারের দাম নিয়ন্ত্রণ করা এবং স্থিতিশীল রাখা।
ঢাকায় কাটাবনের মতো প্রায় সব বিভাগীয় শহরেই পাখির বাজার গড়ে উঠেছে। কোথাও কোথাও পাখির হাট বসে। পাড়া-মহল্লায় পাখির দোকান চোখে পড়ে। বিভিন্ন বয়সের লক্ষাধিক মানুষ পাখি পালনের সঙ্গে জড়িত। ছোট ছোট বাচ্চাদের থেকে শুরু করে কিশোর, যুবক বিভিন্ন বয়সের শিক্ষার্থীরা এমনকি অবসরপ্রাপ্তরাও বাদ যাননি এই নেশা থেকে। গৃহবধূরা ঘর সামলান, আবার পাখিও পালন করেন। এছাড়া অনলাইনেও চলে পাখি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য আদান-প্রদান এবং বেচাকেনাসহ যাবতীয় সকল কিছু। সঠিক পদ্ধতিতে ধৈর্য সহকারে ফিঞ্চ পালন করে উন্নত দেশগুলোর মত সুষ্ঠুভাবে সবরকম ফিঞ্চের ব্রিডিং এ সফল হয়ে বিশ্ব দরবারে বাংলাদেশকে পরিচিত করা সম্ভব বলে জানিয়েছেন আবদুল হান্নান দিনার।
বিরল প্রজাতির পাখির সংগ্রহশালার বর্তমান অবস্থা
বর্তমানে তার নিকট প্রায় ২৫ প্রজাতির ফিঞ্চ রয়েছে, যেগুলো সংখ্যা শতাধিক। এদের মধ্যে রয়েছে করডোন ব্লিউ, পার্পল গ্রেনাডিয়াার, ওয়াক্সবিল, প্যারাডাইজ ওয়াইডাহ, মাস্কড গ্রাস ফিঞ্চ, বিভিন্ন ধরনের জেব্রা, গোল্ডিয়ান, আউল, স্টার, প্যারোট, বেঙ্গলীজ ফিঞ্চ ইত্যাদি। এদের মধ্যে বেশ কিছু বাংলাদেশে একমাত্র দিনারই ব্রিডিং করাতে সক্ষম হয়েছেন, যেমন- ST Helena Waxbill/ Orange Cheeked Waxbill/ Purple Grenadier/ Crested Pearl Begolis Finch/ Chestnut Bengolis Finch/ Strawberry Finch |
ব্যাবসায়িক দিক
পৃথিবীর ছোট্ট পাখিদের মধ্যে অন্যতম ফিঞ্চ। ঋরহপয শব্দটির অর্থ ছোট আকারের গানের পাখি। বৈজ্ঞানিক নাম Taeniopygia guttata। এ পাখি খুব অল্প জায়গায় স্বল্প খরচে পালন করা যায়। এই পাখির খাবার ও রক্ষণাবেক্ষণ খরচও তুলনামূলক খুব কম। সঠিক রক্ষণাবেক্ষণ ও পরিচর্যা করলে প্রতি তিন মাস অন্তর প্রতি জোড়া পাখি থেকে ৩ থেকে ৬টি বাচ্চা পাওয়া যাবে। প্রতিবছর এই পাখি বিষয়ক অনলাইন কেন্দ্রিক বিভিন্ন গ্রুপ সারা দেশে কম করে হলেও ২৫ থেকে ৩০ লক্ষ টাকার ফিঞ্চ পাখি দেশের বিভিন্ন ফিঞ্চ পালকদের নিকট বিক্রি করেন। পাখির জন্য প্রতি মাসে গড়ে খরচ হয় তাদের ৫ থেকে ৬ হাজার টাকার মতো। প্রজাতিভেদে একেকটি ফিঞ্চ পাখির দাম ৫শ’ টাকা থেকে ৪০ হাজার টাকা পর্যন্তও আছে।
কোথায় পালন করবেন
প্রকৃতিতে ফিঞ্চ ৩-৪ বছর বাঁচলেও খাঁচায় পর্যাপ্ত যতœ নিয়ে এদেরকে ৭ থেকে ১০ বছর পর্যন্ত বাঁচানো সম্ভব। এদের দৈহিক গঠন অনেকটা আমাদের চড়–ই পাখির মত, প্রজাতিভেদে বিভিন্ন রঙ এর হয়ে থাকে। দিনারের মতে, আকারে খুব ছোট হওয়ায় বাসার এক কোণে, সিঁড়িঘরে, বাড়ির ছাদে অথবা বারান্দায় ছোট্ট পরিসরে অনায়েসেই এই পাখি পালন করা যায়। উন্নত জাতের বা মিউটেশনের পাখি পালনের মাধ্যমে ভালো কোয়ালিটি সম্পন্ন বাচ্চা পাওয়ার কথা জানালেন তিনি। পাখির খাবারসহ পাখি সংক্রান্ত নানা জিনিসের চাহিদার তাগিদে রাজধানীর কাপ্তান বাজারসহ বিভিন্ন স্থানে গড়ে উঠেছে পাখির মার্কেট। অনলাইনের পাশাপাশি এসব মার্কেটেও চলে বেচাকেনা। নতুন বা পুরাতন সব ধরনের ফিঞ্চ পালকদেরকে তথ্যগত সব ধরনের সহায়তা দিচ্ছে ফিঞ্চ সোসাইটি অব বাংলাদেশ।
দি ফিঞ্চ সোসাইটি অব বাংলাদেশ
অনলাইনে ফিঞ্চ কম্পিটিশন আয়োজনের পাশাপাশি ফিঞ্চ পালকদেরকে যথাযথ দিকনির্দেশনা দিয়ে অনেক দিন ধরেই সাহায্য করে আসছে “দি ফিঞ্চ সোসাইটি অব বাংলাদেশ” নামক ফেসবুক ভিত্তিক গ্রুপটি। এর হেড অফ এডমিন আবদুল হান্নান দিনারের পাশাপাশি জুনায়েদ ইসলাম, চিন্ময় সেন, সানজীদ ইসলাম, মাসরিকুল ইসলাম সবাই একসঙ্গে কাজ করছেন ফিঞ্চ সেক্টরকে আরো এগিয়ে নিয়ে যেতে এবং মানুষকে বন্য পাখি পালনে নিরুৎসাহিত করে খাঁচার পাখির প্রতি আগ্রহী করতে।
পাখির প্রতি ভালোবাসা খারাপ নেশা থেকে দূরে রাখতে পারে তরুণ প্রজন্মকে
“দি ফিঞ্চ সোসাইটি অব বাংলাদেশ” এর প্রধান প্রতিপাদ্য বিষয় হলো, পাখির প্রতি ভালোবাসা খারাপ নেশা থেকে দূরে রাখতে পারে তরুণ প্রজন্মকে। তাই আপনার সন্তানকে একজোড়া পাখি কিনে দিন। এটি তাকে মানষিক প্রশান্তি দেওয়ার পাশাপাশি অন্যান্য খারাপ নেশা থেকেও দূরে রাখবে। পাখির ওড়াওড়ি, ডাকাডাকি, খাওয়া-দাওয়া, ডিম পাড়া, ডিম ফোটানো, বাচ্চাকে খাইয়ে বড় করে তোলা এসবই খুব উপভোগ্য হবে আপনার সন্তানের সুস্থ বিনোদনের জন্য।
পাখি পোষার ইতিহাস বহু প্রাচীন। মিশরের ফারাও থেকে শুরু করে রাজধিরাজেরাও পাখি পুষতেন। কখনো শখে আবার কখনো চিঠি আদান-প্রদানের জন্য। সরকারি পৃষ্ঠপোষকতায় উন্নত জাতের পাখি বিদেশে রপ্তানি করে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন সম্ভব বলে মনে করেন ফিঞ্চ পালকরা। পড়াশোনা, চাকুরির কিংবা গৃহিনীরা গৃহ কর্মের পাশাপাশি ফিঞ্চ পাখি পালনের মাধ্যমে স্বনির্ভর হতে পারে। এতে করে আমাদের দেশীয় বন্য পাখি পালনের প্রতি নিরুৎসাহিত হয়ে মানুষ ধীরে ধীরে খাঁচার পাখির প্রতি আগ্রহী হয়ে উঠবে।