লবণে ক্ষতি হচ্ছে ঘরবাড়ি-গৃহস্থালি উপকরণ
সাতক্ষীরা,শ্যামনগর থেকে চম্পা মল্লিক
শ্যামনগর উপজেলার মুন্সিগঞ্জ ইউনিয়নের সিংহড়লী গ্রামে ২০ জন জনগোষ্ঠীর উপস্থিতিতে সম্প্রতি একটি আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভাটি শুরু করেন বারসিক কর্মকর্তা চম্পা মল্লিক। এখানে আলোচনার বিষয়বস্তু ছিল ঘরবাড়ি, গৃহস্থালী উপকরণ, কৃষিজ সামগ্রী ও অবকাঠামোতে লবণাক্ততার প্রভাব। এই আলোচনা সভা থেকে সিংহড়তলী গ্রামের ঘরবাড়ি, গৃহস্থালী উপকরণ, কৃষিজ সামগ্রী ও অবকাঠামোতে লবণাক্ততার যে প্রভাব পড়ে তার বাস্তবতা প্রকাশ পায়।
অংশগ্রহণকারীরা বলেন, ‘আমাদের এলাকায় পাকা ঘর ও আধাপাকা ঘর খুবই কম। কাঁচা ঘর সবচেয়ে বেশি। আর এই ঘরগুলোর ধরণ সাধারণত, বাঁশের বেড়া, গোলপাতার ছাউনী, মাটির দেয়াল, তক্তার বেড়া, খড়ের ছাউনী, এ্যাডবেষ্টার ও টিনের ছাউনীর হয়। কিন্তু এই এক এক ধরনের ঘরগুলোতে লবণাক্ততা এক একভাবে ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। যেমন-টিন জং ধরে যাচ্ছে, এ্যাডবেষ্টারের নাটগুলো জং ধরে নষ্ট হয়ে সেখান থেকে ঘরে জল পড়ছে, মাটির ঘরের মেঝে শুকাচ্ছে না, সবসময় স্যাঁতসেঁতে ভাব, সিমেন্টের খুঁটিগুলো নোনা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অন্যদিকে পাকা ঘরগুলো ৪/৫ বছর ভালো থাকার পরে আস্তে আস্তে নোনা ধরা শুরু হচ্ছে। এগুলো ও নোনা ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে।’ তারা আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকায় যত ধরনের ঘরবাড়ি আছে, এর মধ্যে মাটির ঘর সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে।
অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে দেবকী রানী (৩৫) বলেন, ‘সংসারে ব্যাবহারের বিভিন্ন জিনিস যেমন-দা, বটি, তালাচাবি, রান্নার সরঞ্জাম এগুলোতে লবণ ভীষণ প্রভাব ফেলছে। সব কিছু তো ক্ষতি হচ্ছে তবে উদাহরণ দিয়ে যদি বলি সেক্ষেত্রে দেখা যায়, আগের বটিগুলো অনেক বছর ব্যবহারের পর ও তেমন কিছু হতো না, মাঝে মধ্যে শুধু ধার করালেই হতো, কিন্তু এখন নতুন একটা বটি কিনলে দ্ইু বছরের বেশি যাচ্ছে না।’ এছাড়া ও অংশগ্রহণকারীরা সকলেই জানান, হাঁড়ি, কড়াই, স্টিলের থালায় প্রথমে ফুট ফুট কেটে উঠে তারপর সেখান থেকে পরবর্তিতে ছিদ্র বের হচ্ছে। এভাবে সবকিছু নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তবে লবণাক্ততায় সবচেয়ে বেশি নষ্ট হচ্ছে লোহার জিনিসগুলো যেমন- তালাচাবি, বটি, দা, কুড়াল,খোন্তা, কোদাল, নিংড়েন, কাচি, আংড়া প্রভৃতি।
অংশগ্রহনকারীদের মধ্যে রুক্কুনী (৬০) বলেন, ‘আগে এই এলাকা সম্পূর্ণ মিষ্টি এলাকা ছিল। ধান চাষ হতো এখানে। সেদিনের সেই অবস্থার সাথে আজকের অবস্থার কোন মিল নেই। প্রায় প্রতিটা বাড়িতে তখন গরু, ছাগল, হাঁস, মুরগি, ভেড়া ছিল। সেই সময় গোবর দিয়ে ঘর লেপলে চকচক করতো, কি সুন্দর দেখাতো, আর অনেক দিন থাকতো। কিন্তু এখন নোনা ধরে সব শেষ হয়ে যাচ্ছে। আগে যে এসব ছিল তা এখনকার ছেলেমেয়েরা বিশ্বাস ও করে না।’
তাদের মধ্যে থেকে নিরাঞ্জন মন্ডল (৬৫) বলেন, ‘নদীভাঙ্গন, চিংড়ি ঘের হতে হতে আমাদের এলাকা সম্পূর্ন লবনে পরিণত হতে যাচ্ছে। তাই ধান চাষ তো পুরোপুরি বন্ধ হয়ে গেছে। এখন আমাদের প্রত্যেকের ভিটাতে যার যেটুকু জায়গা আছে তাতে সবজি লাগানোর চেষ্টা করি। আর এগুলো লাগাতে আমাদের যেসব যন্ত্রপাতি লাগে তা হল- কোদাল, নিংড়েন, কাচি, আংড়া। কিন্তু এগুলো লবণে জং ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। অতিরিক্ত লবণ হওয়ায় কিছুই ভালো থাকছে না। দালানগুলো নোনা ধরে বালি ঝরে পড়ছে, এছাড়া ও কালভার্ট ও ¯øুইজ গেটগুলো প্রথমে নোনা ধরে বালি ঝরে পড়তে পড়তে যখন লোহা বেরিয়ে যায়, তখন সেগুলো জং ধরে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে এবং শেষ পর্যন্ত নষ্ট হয়ে ভেঙে যাচ্ছে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের এলাকার প্রায় সকল বাড়িগুলো ওয়াবদার রাস্তার পাশ দিয়ে। আর এই ওয়াবদাই হলো আমাদের প্রধান রাস্তা। কিন্তু এই রাস্তায় এত নোনা ধরে যে, তখন আমাদের ঘরে থাকার অবস্থা থাকে না। একটু বাতাস হলেই প্রচুর পরিমাণ এই নোনা ধুলো উড়ে আসে আমাদের ঘরবাড়িসহ সকল জায়গায়। তখন ঘরের সকল জিনিসপত্র ধুলোয় সাদা হয়ে যায়। এরকম কঠিন অবস্থার ভিতর দিয়ে বাঁচতে হয় আমাদের। তাই সরকারের কাছে আমাদের একটাই দাবি! তিনি যদি আমাদের ওয়াবদার রাস্তাটা ভালোভাবে বাঁধতেন, এবং আমরা অসহায় মানুষেরা পুরোপুরি কাঁচা ঘরের হাত থেকে যদি কোনভাবে মুক্তি পেতাম।’