বিষ খাইলে মরে একজন আর বীজ খাইলে মরে হাতো (সবাই) গোষ্ঠী

সীমা আক্তার ও সুমন তালুকদার এর সহযোগিতায় রনি খান

সিন্ধু সভ্যতার নীল নদের তীর থেকে ভারতীয় উপমহাদেশ হয়ে সারা দুনিয়ায় কৃষির যে জয়রথ তার সাথে মানুষের টিকে থাকার গল্পটি নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে। এর সাথে জড়িয়ে আছে নানান চড়াই-উৎরাই, সংগ্রাম আর বিজয়ের গল্প। অন্ন কিংবা বস্ত্র, বাসস্থান কিংবা চিকিৎসা সমস্যা যাই হোক না কেনো, কৃষিজ্ঞান মানুষের বিপদের দিশা হয়ে বারবার আশ্রয় দিয়েছে। মানুষের সভ্যতা এক জায়গায় স্থির থাকেনি। কখনো মেসোপটোমিয়া আবার কখনো মহেঞ্জোদারোতে উড়েছে মানুষের বিজয়ের রথ। ভোলগা থেকে গঙ্গা অথবা সিন্ধু থেকে পদ্মা সব জায়গাতেই মানুষ তার বিজয়ের স্বাক্ষী রেখে গিয়েছে আর রেখে গিয়েছে তার পরিচয়ের নিশান- ‘বীজ’। ‘বীজ’ সূত্রে মানুষের পরিচয় শুধুমাত্র বিচ্ছিন্ন ‘মানুষ’ হিসেবে নয়, বরং তার ভূগোল, তার সংস্কৃতি, তার খাদ্যাভ্যাস, তার আচার সবকিছু মিলিয়ে সামগ্রিক ‘মানুষ’ হিসেবে।

মানুষের এই গল্পগুলোই উঠে আসে কখনো নৃতাত্ত্বিক গবেষণায়, কখনো বা প্রতœতাত্ত্বিক গবেষণায় আবার কখনো বা মানুষের মুখে মুখে লোককথায়। এই সমস্ত উৎস থেকেই আমরা জানতে পারি ‘বীজ’ মানে শুধু ‘বীজ’ নয়। বীজ মানে একটি জাতীর ঐতিহ্যের যোগসূত্র, তার বহমানতার প্রতীক, কখনো কখনো তার আত্মপরিচয়। বীজ, বীজের বিনিময় প্রথা, বীজ সংরক্ষণ পদ্ধতি ও জ্ঞান এবং কৌশলই একটি জাতির সমৃদ্ধি নিশ্চিত করে। একই সাথে নিশ্চিত করে আগামী প্রজন্মের জন্য সুরক্ষিত পৃথিবীর। ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট বিবেচনায় নিলে দেখা যাচ্ছে, বীজ বিনিময় এবং সংরক্ষণের পুরো প্রক্রিয়াটির সাথেই নিবিড়ভাবে জড়িয়ে আছে নারী। তবে এ ভূখন্ডের প্রেক্ষাপটে এ প্রক্রিয়াটি আরো গভীর, আরো সমৃদ্ধ, আরো শক্তিশালী। বিশেষ করে নেত্রকোনা অঞ্চলে বীজ বিনিময় এবং সংরক্ষণের এই গল্প অনেক পুরোনো এবং সংহত। বীজ বিনিময়ের এই সংস্কৃতিকে ধারণ করেই হাওর অঞ্চলের কৃষি ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে, বীজ সংরক্ষণের প্রায়োগিক জ্ঞানের কারণে এই হাওর অঞ্চলেই তৈরি করা হয়েছে দুনিয়ার প্রথম গভীর পানির ধান গবেষণা প্রতিষ্ঠান। এভাবে এ অঞ্চলে গ্রামীণ নারীর বীজ বিনিময়ের আদি সংস্কৃতিই আমাদের সমৃদ্ধ আন্তঃনির্ভরশীল সামাজিক বন্ধনকে দৃঢ় করেছে, গড়ে তুলেছে রূপকথার মতো আশ্চর্য সুন্দর এক সামাজিক সম্পর্কের কিংবদন্তি। এ অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় শস্য-ফসলের চাষ, বৈচিত্র্যময় বীজ ভান্ডার, গাছ-মাছ, মাটি ও মানুষ মিলেই সহ¯্র বছর ধরে গড়ে তুলেছে এই বৈচিত্র্যময় হাওর-পাহাড় ভূগোল আর সমৃদ্ধ সাংস্কৃতিক বন্ধন।

বেসরকারি উন্নয়ন গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক মানুষের বীজ বিনিময়ের এই প্রক্রিয়াকে শ্রদ্ধা করে এবং একই সাথে প্রাকৃতিক ও সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্যে সমৃদ্ধ একটি আন্ত:নির্ভরশীল সমাজ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। তারই ধারাবাহিকতায় নেত্রকোনা জেলার মদন উপজেলায় হাওরাঞ্চলের উপযোগী বীজ সংরক্ষণ ও সম্প্রসারণে কাজ করে যাচ্ছে। তারই ধারাবাহিকতায় মদন উপজেলার তলার হাওর কৃষক সংগঠণ এবং হাওর বীজঘর ব্যবস্থাপনা কমিটি’র উদ্যোগে মদন উপজেলার গোবিন্দ্রশ্রী ইউনিয়নের খালাসিপাড়া গ্রামে বীজ বিনিময়ের এক কর্মসূচি পালন করা হয়। কর্মসূচিতে ইউনিয়নের ৬টি গ্রামের ৩২টি পরিবারের কৃষাণ-কৃষাণীরা ১৪টি স্থানীয় জাতের বীজ বিনিময় করেন। বারসিক কর্মকর্তা সুমন তালুকদার জানান, প্রতিবছর হাওর বীজঘর ব্যবস্থাপনা কমিটি’র মাধ্যমে বিনিময়কৃত বীজ এলাকার অন্য কৃষকদের মধ্যেও সম্প্রসারিত হয়। হাওর বীজঘর ব্যবস্থাপনা কমিটি’র তত্ত্বাবধায়ক হাওর কৃষাণী পিয়ারা আক্তার বলেন, ‘গত কয়েক বছর ধইরা বাজারের বীজ কিইন্যা আমরা ক্ষতিগ্রস্থ অইতাছি। প্রায় প্রত্যেক বছরই আগাম বন্যা অওনের ডর থাকে। এই লাইগ্যা আগাম ধান করণ লাগে। কিন্তু বাজারের ধানের বীজ আগাম ফলে না। রোগবালাই অয়। আমরার আতো (কাছে) বীজ না থাকলে আমরার বিহইদো ফরন লাগে। এই লাইগ্যা আমরা এই হাওর বীজ ঘর বানাইছি। আমরা এই হানতে (এখান থেকে) বীজ দেই, নেই। এইডা আমরার লাইগ্যা খুব ভালা।’
স্থানীয় কৃষকরা বীজ বিনিময়ের এই প্রক্রিয়াকে আরো সমৃদ্ধ করতে চান। তারা বিশ^াস করেন ভালো বীজ মানে ভালো ফসল। কোম্পানি বীজের তুলনায় তারা তাদের নিজেদের হাতের বীজকে বেশি বিশ^াস করেন। নেত্রকোনার কলমাকান্দা উপজেলার ভেলুয়াতলী গ্রামের কৃষক আব্দুল মোতালেব যেমন বলেন, ‘বিষ খাইলে মরে একজন, বীজ খাইলে মরে হাতোগোষ্ঠী (সবাই)।’ এভাবেই লোকায়ত জ্ঞান আর সর্বপ্রাণবাদের সম্মিলনে গড়ে উঠেছে হাজার বছরের হাওরের লোক সংস্কৃতি। এই সংস্কৃতি চাইলেই উপেক্ষাও যেমন করা যায় না তেমনি ধ্ববংসও করা যায় না।

happy wheels 2

Comments