একটি কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা শিখন কেন্দ্র ও আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ

একটি কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা শিখন কেন্দ্র ও আন্তঃসম্পর্ক বিশ্লেষণ

সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
গোয়াল ভরা গরু, পুকুর ভরা মাছ আর গোলা ভরা ধান এটি ছিল গ্রামীণ কৃষিবাড়ির মূল উপাদান। গ্রামে গ্রামে এ ধরনের বাড়িগুলো ছিল গ্রামের মানুষের নানামুখী জ্ঞান চর্চা কেন্দ্র। এই কৃষিবাড়িগুলোতে কৃষি কাজের সকল উপকরণই ছিল কৃষকের নিজস্ব। কৃষি বাড়িতেই উপকরণগুলো সংরক্ষিত থাকতো। এই উপকরণ বিনিময়ের মধ্য দিয়ে একে অপরের সাথে কৃষি, পরিবেশ, পরিবার, সমাজ, সংস্কৃতি, নানাধরনের সামাজিক আচার অনুষ্ঠান নিয়ে আলোচনা হতো। পরিবার ও সমাজে পারষ্পারিক সম্প্রীতি, জ্ঞান বিনিময়, বীজ বিনিময়, লোকায়ত চর্চা, স্থানীয় সম্পদ, বিনিময়ের মাধ্যমে তৈরি হতো বহুমূখী সম্পর্ক। এই সম্পর্ক ছিল একে অপরের সাথে নির্ভরশীলতার। কিন্তু কোম্পানি নির্ভরতা ও বাজার নির্ভরশীলতা, কৃষকের নিয়ন্ত্রণহীন কৃষিব্যবস্থায় কৃষক হারিয়েছে কৃষির সেই চিরায়ত সংষ্কৃতি। তবে এখনো অনেক কৃষক আছেন যারা এই কৃষকের নিজস্ব চর্চা, সংষ্কৃতি পারষ্পারিক আন্তঃসম্পর্ক নির্ভর কৃষি কাজ করে থাকেন। নিজের বাড়িকে গড়ে তুলেছেন অন্যদের জন্য শিখন কেন্দ্র। এমনই একজন কৃষক হচ্ছেন সিংগাইর উপজেলার কাস্তা গ্রামের কৃষক স্বপন কুমার রায়।


স্ত্রী এবং এক ছেলে নিয়ে খুব ছোট একটি পরিবার। এসএসসি পাশ করার পর বাড়তি আয়ের জন্য পাড়ি জমিয়ে ছিলেন বিদেশে। কিন্তু তার বিদেশ ভাগ্য ভালো না হওয়ার ফেরে আসেন বাংলাদেশে। পারিবারিক স্বচ্ছলতা ফেরাতে চলে যান ঢাকা শহরে। পরিবহন বিভাগে গাড়ি মেরামত ও গাড়ি চালানোর কাজ করেন। পরিবহনের কাজে ভালো করলেও সেখানে তার মন বসেনি। তার ইচ্ছা জাগে নিজে কিছু করার। তাই ২০১৪ সালে চাকুরি ছেড়ে গ্রামে চলে আসেন। স্বপন কুমার কৃষি পরিবারের সন্তান হওয়ায় কৃষি কাজের অভিজ্ঞতা ছিল তার। সেই অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে শুরু করেন কৃষিকাজ। নিজের জমিতেই কৃষি কাজ করেন তিনি। ৩০ শতাংশের বসতবাড়ি, ২০ শতাংশের পুকুর, ৫টি গরু ও ১০ টি মুরগি নিয়ে ১১০ শতাংশ মাঠের জমিতে পরিকল্পিতভাবে শুরু করেন কৃষি কাজ। কৃষিই এখন প্রধান পেশা তার। পারিবারিক পুষ্টি, অর্থনৈতিক নিরাপত্তা ও গ্রামের মানুষের পারষ্পারিক সম্পর্ক ও নির্ভরশীলতাকে ভালোবেসে কৃষিকাজ করে থাকেন তিনি। নিজের যতটুকু জমি আছে সেটুকু চাষ করেই কৃষিতে ভালো আয় হয় তাঁর। তাঁর পরিকল্পিত কৃষি কাজ দেখে গ্রামের ভিতরে একটি সমৃদ্ধ কৃষিবাড়ি হিসেবে পরিচিতি পেয়েছে। বাড়ি ও কৃষি জমির সঠিক ব্যবহার করেছেন। বৈচিত্র্যময় কৃষি ফসল, ফলের গাছ, ওষুধি গাছ দিয়ে সাজিয়েছেন বাড়িটি। যে কারো জন্য বাড়ি হতে পারে একটি কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা শিক্ষা কেন্দ্র।


কৃষিকে জ্ঞান ও চর্চাকে সম্মান ও শ্রদ্ধা করে বারসিক। তাই কৃষকের নিকট থেকে শিখন অভিজ্ঞতা অর্জনের জন্য ৩ মার্চ থেকে ৭ মার্চ বারসিক’র আয়োজনে অনুষ্ঠিত কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা, জলবায়ু নায্যতা ও খাদ্য সার্বভৌমত্ব প্রশিক্ষণ ও কর্মশালায় অংশ হিসেবে ৩য় দিন স্বপন কুমার রায়ের বাড়িটি প্রশিক্ষণ কর্মীদের মাঠ শিখন অভিজ্ঞতার জন্য নির্ধারণ করা হয়। একটি কৃষি প্রতিবেশবিদ্যা চর্চা কেন্দ্রের প্রাথমিক শিখনের জন্য বারসিক কর্মকর্তা শাহীনুর রহামান, গাজী শাহাদাত হোসেন বাদল, আছিয়া আক্তার, সঞ্জিতা কির্ত্তুনিয়া, ঋৃতু রবিদাস, ফিরোজা সরকার ৭ জন প্রতিনিধি বাড়িটি পর্যবেক্ষণ করেন। সকাল ৯.০০ টা স¦পন কুমার রায়ের সাথে পরিচিতি হওয়ার মধ্য দিয়ে সারাদিনের কার্যক্রম অবহিত করা হয়। সারাদিন বাড়িটিতে অবস্থান করে পর্যবেক্ষণের মাধ্যমে স্বপন কুমার রায়ের চর্চাগুলো জানা ও বিশ্লেষণ করার চেষ্টা করা হয়। কৃষক স্বপন কুমার রায় বাড়িটি তার চর্চা সম্পর্কে বিভিন্ন তথ্য প্রদান করেন। প্রতিনিধি দল বাড়িতে উৎপাদিত সকল ফসল নিজেরাই তুলে সংগ্রহ করে নিজেইরাই রান্না করেন এবং বাড়িটির কৃষিপ্রতিবেশ বিদ্যা চর্চাগুলো জানার চেষ্টা করেন।


বাড়ির চারপাশ সরজমিনে পর্যবেক্ষণ এবং কৃষক স্বপন কুমার রায়ের দেওয়া তথ্য মতে, তার বাড়ির পাশে পালানি জমিতে রয়েছে সাদা ডাটা, লাল ডাটা, লালশাক, পালংশাক, ফুল কপি, বাধা কপি, মটর শাক, ডাবরি, কাচা মরিচ, শিম, বেগুন, দেশীলাউ, চালকুমরড়া, মিষ্টিকুমড়া, গাজর, টমেটা, শসা, মুলা, গোলআলু, কচু, গাছআলু, বেলআলু, করলা, ঢেরস, সাজনা, পুইশাক, ২৬ ধরনের সবজি, ব্রী-৮৮, ৯৮, বিনা ২০ ব্ল্যাক রাইচ, সুশীল, বাবুই, ভজন, কালোমানিক, ডেপো, কোলোজিরা ১০ ধান নারিকেল, কামরাঙ্গা, কাঁঠাল, সুপারি, আম, পেয়ারা, জাম্বুরা, আশফল, বেল, আমড়া, কলা, আখ, বড়ই, জাম, সবেদা নোনা ফল, আতা ফলসহ ১৭ জাতের ফল গাছ, শিমুল, মেহগনি, ইপিল ইপিল, ইউক্যালিপটাস, রয়না জগডুমুর, বাঁশ, ৭ ধরনের বনজ গাছ, গাদাফুল, রাম তুলসিগাছ, নিম, লেবু, তুলসি, অর্জুন, জিগা, পাথরকুচি ৮ ধরনের ওষুধি গাছ, এবং কৃষিউপকরণের মধ্যে, লাঙ্গল, মই, জোয়াল, কোদাল, কাস্তে, খন্তা, ইটামুগুর, আচড়া, নাড়ি, টুনা, চালনা, কুলা, দড়ি, ধামা, কাঠা, সের, পট, নিরানি, বীজ, বেড়, মাটির কোলা, নলকুপ, মাড়াই মেশিন, পাওয়াট টিলার, জৈবসার, জৈববালাই নাশক ব্যবহার এর তথ্য পাওয়া যায়। এছাড়ার জমির প্রতি ইঞ্চি মাটির রয়েছে সুষ্ঠু ব্যবহার। বাড়ির চারি দিকে রয়েছে আদা হলুদের চাষ।

তথ্য সংগ্রহের পর স্বপন কুমার তার স্ত্রী ও সন্তানের উপস্থিতিতে ব্রাউন পেপারে বাড়িটির চিত্র অংঙ্কন করে আন্তঃসম্পর্ক ও আন্তঃনির্ভরশীলতা বিশ্লেষণ করা হয়। বিশ্লেষণে দেখা যায়, তার বাড়িটি একটি কৃষিপ্রাণবৈচিত্র্য সমৃদ্ধ বাড়ি। বাড়িটি পরিদর্শনের মধ্যে দিয়ে স্বপন কুমার রায় কিভাবে কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা, চর্চা করছেন সেই সেই চর্চাগুলো সম্পর্কে স্টাফ পর্যায়ে বিশ্লেষণ সক্ষমতা বৃদ্ধি ও অভিজ্ঞতা অর্জন ও একটি কৃষিপ্রতিেিবশবিদ্যা চর্চা কেন্দ্রর সীমাবদ্ধতাগুলো চিহ্নিত করা হয়। তাছাড়া জলবাযূ নায্যাত্যা, খাদ্য সার্বভৌমত্ব নিশ্চিতকরণে ও বাড়িটির বাস্তুতন্ত্রের সাথে বিভিন্ন প্রাণের আন্ত সম্পর্কও আন্তঃনির্ভরশীলতার তথ্য বিশ্লেষণ করা হয়। একজন কৃষকের কৃষি কাজ করতে যে সকল উপকরণ থাকা দরকার তার বেশির ভাগ উপকরণ বাড়িটিতে রয়েছে। সবজি ও ফল, ওষুধি গাছের বৈচিত্র্যতা রয়েছে চোখে পড়ার মত। জমিতে সেচ প্রদান ও মাছ চাষ করার জন্য একটি পুকুর রয়েছে।

স্বপন কুমার রায় জানান, আমার বাড়ির প্রতিটি প্রাণের সম্পর্ক একে অপরের সাথে আন্তঃনির্ভরশীলতার। আমি গরু পালনের করার মাধ্যমে দুধ পাই, গোবার থেকে জৈবসার তৈরি করি, জৈবসারে মাটি ভালো রাখে। মাটি ভালো থাকলে পোকামাকড় ভালো থাকে, সবজি চাষ করি নিজে, নিজে খাই, গ্রামের মানুষকে দিই, পুুকুরে মাছ চাষ করি, মাছ বাজার থেকে কিনতে হয় না।’ তিনি আরও বলেন, ‘একটা সময় কৃষির সকল উপকরণ আমি বাজার থেকে ক্রয় করলেও এখন বাজার থেকে খুব কম ক্রয় করি । আমি বাড়িতেই বীজ সংরক্ষণ করি। বীজ মানুষের মধ্যে বিনিময় করি। পোকা মাকড় রোধ করার জন্য জমির আইলে গাদা ফুলের চাষ করি, ফসলে রোগের জন্য জৈব বালাইনাশক, সেক্স ফেরোমিন ফাঁদ ব্যবহার করি।’ বাড়ি থেকে উৎপাদিত শাকসবজি দিয়েই তার সারাবছর চলে। পাড়া প্রতিবেশীর মধ্যে বিনিময় করেন। কৃষির বেশির ভাগ উপকরণ বাড়িতে থাকলেও বাজার নির্ভরতা পুরোপুরো কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তবে তিনি ভার্মি কম্পোষ্ট তৈরির জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন। তিনি বলেন, ‘আমার বাড়িতে ইউক্যালিপটাস গাছ রয়েছে এই গাছ এর ক্ষতিকর দিক সম্পর্কে আমি জানি। বিশেষ কারণে গাছটি রেখে দিয়েছি। তবে গাছটি কেটে ফেলার ইচ্ছা আছে।’ বাড়িটির চিত্র বিশ্লষণে দেখায় যে, যদিও কিছু ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে সীমাবদ্ধতাগুলো উত্তরণের সুযোগও রয়েছে। প্রয়োজনীয় পরামর্শ প্রদানের মাধ্যমে বাড়িটি খুব কার্যকর একটি কৃষি প্রতিবেশ শিক্ষা কেন্দ্র হতে পারে।


স্বপন কুমার রায় সম্পর্কে সংগঠনের সভাপতি ভানু রায় বলেন, ‘গ্রামের মধ্যে মধ্যে তার গ্রহণযোগ্যতা ও পরিচিতি ভালো। পরোপোকারি মানিসকতা তাঁর বড় গুণ। তার পরিবারে ছেলে ও স্ত্রীর মধ্যে আন্তরিকতা রয়েছে। পরিবারের সদস্যদের আন্তরিকতায় বাড়িটি গ্রামের মানুষের জন্য একটি জ্ঞান বিনিময় কেন্দ্র হয়ে উঠেছে। গ্রামে ২০০৯ সালে তৈরি হয় কাস্তা বারোওয়ারি কৃষক কৃষাণি সংগঠন নামে একটি কৃষক সংগঠন। এই সংগঠনের নিয়মিত মাসিক সভা ও সংগঠনের নিয়মিত কার্যক্রম এই বাড়িটিতেই পরিচালিত হয়ে থাকে। স্বপন কুমার রায় একজন উদ্যোগী এবং আগ্রহী মানুষ। প্রকৃতি ও পরিবেশবান্ধব কৃষি তার পছন্দ। কৃষিপ্রতিবেশবিদ্যা চর্চায় নিজেকে যুক্ত করতে চান। বাড়িটি গ্রামের মানুষের জন্য একটি কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা শিখন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে চান। বর্তমানে কৃষিকাজে যেখানে কৃষকের টিকে থাকা দায় স্বপন কুমার রায় সেখানে গ্রামের মধ্যে একজন আদর্শ কৃষক। কৃষিকাজে তাঁর রয়েছে নিজস্ব পরিকল্পনা। কৃষি মৌসুম বিশ্লেষণ করে নিজেই তৈরি করেন কৃষি পঞ্জিকা। চাষ পদ্ধতিতে অনুসরণ করেন নিজের জ্ঞান, দক্ষতা ও লোকায়ত চর্চা। কৃষি চর্চা সমৃদ্ধ বাড়ি হিসেবে গ্রামের মানুষের জন্য একটি শিখন কেন্দ্র তৈরি হলে গ্রামরে মানুষে মধ্যে কৃষি প্রতিবেশ বিদ্যা চর্চায় ভূমিকা রাখবে।

happy wheels 2

Comments