প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় অচাষকৃত উদ্ভিদ সংরক্ষণ করতে হবে
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমি:
গ্রামের সাধারণ কৃষকের মেয়ে ফারজানা আক্তার। কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য নিয়ে তার আগ্রহের শেষ নেই। ছোটকাল থেকেই অচাষকৃত উদ্ভিদ নিয়মিত গ্রহণ ও সংরক্ষণ করে আসছেন। মহামারী করোনাকালীন সংকটে পরিবারে সকল সদস্যদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তিনি দৈনন্দিন খাদ্য তালিকায় নিয়মিত অচাষকৃত শাকসবজি রাখেন।
ফারজানা আক্তারের বাড়ি নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নে দরুণবালি গ্রামে। ছোটবেলা থেকে অচাষকৃত শাকসবজি তার খুব পছন্দের, এসব উদ্ভিদের গুণাগুণ ও উপকারিতা সম্পর্কে বেশ জ্ঞান রাখেন তিনি। করোনাকালীন সময়ে অচাষকৃত উদ্ভিদ যেমন- কলমিশাক, কচুশাক, কচু লতা, বাউতা (বথুয়াশাক), হেইচা শাক (হেলেঞ্চা) ইত্যাদির উপকারিতা, ব্যবহার ও সংরক্ষণের গুরুত্ব সম্পর্কে তিনি সংগঠনের সভায় আলোচনা করেন। এসব খাদ্যের নিরাপত্তা ও পুষ্টিগুণ সম্পর্কে তিনি সকলকে জানান এবং এগুলো সংরক্ষণ করে নিয়মিত খাদ্য তালিকায় রাখার পরামর্শ দেন।
ফারজানা আক্তার কোথাও বেড়াতে গিয়ে নতুন অচাষকৃত খাদ্য উদ্ভিদের দেখা পেলে তা সংগ্রহ করে নিয়ে এসে বাড়ির পাশে রোপণ করেন। তাঁর বাড়িতে সারাবছর বিভিন্ন ধরনের শাক যেমন-হেলেঞ্চা, কলমী, দলকলস, হিজঘাডু, কাটাপুড়িয়া, আপন, থানকুনি, খেতাবুড়ি, হেইচা, সাজনা, কচু, গিমাই, পালই, বউটুনি, আতিচুর পাতা, তেলাকুচা, পাহাড়ীলতা, সুরমা, কচুপাতা, ঢেকিশাক, খুড়িয়া, আলু পাতা, কেউরালি ইত্যাদি পাওয়া যায়। ফারজানার আক্তার বাড়িতে কোচো কম্পোষ্ট সার উৎপাদন করে তা সবজির জমিতে ব্যবহার করেন। কোন প্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক তিনি ব্যবহার করেন না। নিজেই উৎপাদিত স্থানীয় জাতের সকল সবজি বীজ নিজে সংরক্ষণ করেন। বৈশ্বিক মহামারী করোনা সংক্রমণের ভয়ে গ্রামের কেউ ডাক্তার দেখাতে শহরের হাসপাতালে যায়নি।
এই প্রসঙ্গে ফারজানা আক্তার বলেন, ‘গ্রামের রহিমা আপা প্রচন্ড ঠান্ডা জ¦র ও সর্দি-কাঁশিতে ভোগছিলেন। গ্রামের কেউ ভয়ে তার কাছে যেতে চায়নি করোনা হয়েছে ভেবে। তখন আমি নিজেই গরম পানি ভাপ দেয়া, গরম পানি খাওয়ানো, বাসকপাতা রস করে ৭দিন খাওয়াই। সারা শরীরে সরিষার তেল ডলে মালিশ করে দিয়েছি। এক সপ্তাহ সেবা করার পর রহিমা আপা সম্পূর্ণভাবে সুস্থ হয়েছেন। আমি কোন কবিরাজ বা ডাক্তারও না, আমি ঠান্ডা জ্বর ও সর্দি-কাঁশির উপশমে গরম পানি খাওয়া ও গরম পানির ভাপ নেয়া এবং বাসক পাতার উপকারীতার কথা জানতাম। এই জানা জ্ঞান দিয়েই রহিমা আপার সেবা করার চেষ্টা করেছিমাত্র।’
ফারজানা আক্তার জানান, করোনাকালীন সময়ে মানুষ ছাড়াও অনেক গবাদী পশুর বিভিন্ন রোগের চিকিৎসা করেছেন ভেষজ ঔষধ দিয়ে। যেমন-গরুর পেট ফোলা, বদহজমে আদা, পুদিনা পাতা, পেয়াজ, লবণ, গুরুক চাইল্লা গাছ একসাথে মিশিয়ে কলাপাতার সাথে খাওয়ান। তিনি ঔষধি উদ্ভিদ, অচাষকৃত উদ্ভিদের গুণাগুণের সম্পর্কে জানেন এবং সেগুলো সংরক্ষণ করার চেষ্টা করেন। আনেকে এসব মূল্যবান খাদ্যসম্পদকে আগাছা মনে করে রাসায়সিক সার ও কীটনাশক দিয়ে মেরে ফেলেছেন বলে তিনি জানান। তিনি বলেন, ‘আমাদের প্রয়োজনেই কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্যকে বাঁচাতে হবে। মানুষের খাওয়াসহ গবাদি পশু-পাখির চিকিৎসায় এগুলো ব্যবহার করলে আমরা নিজেরা এবং গবাদি পশু-পাখিগুলো সুস্থ রাখতে পারবো। এছাড়াও গ্রামের অনেক দরিদ্র পরিবারের জীবন জীবিকা নির্ভর করে এসব অচাষকৃত খাদ্য ও ঔষধী উদ্ভিদের উপর। যারা কবিরাজী পেশার সাথে যুক্ত তারা এসব উদ্ভিদ দিয়ে ঔষধ তৈরি করে মানুষসহ গবাদী পশু-পাখির চিকিৎসা করে জীবিকা নির্বাহ করেন।’
পরিবেশ, প্রকৃতি ও প্রাণবৈচিত্র্যের জন্য সকল ধরণের উদ্ভিদ সংরক্ষণ জরুরি। আর সেটি যদি হয় খাদ্য বা ঔষধি তাহলে তো কথাই নেই। তাই শুধু ফারজানা আক্তারই নয়, আমাদের সকলকে নিজেদের প্রয়োজনে, গবাদি পশু-পাখির খাদ্য ও চিকিৎসায় ব্যবহারের জন্য বা প্রকৃতি ও পরিবেশ সুরক্ষায় অচাষকৃত উদ্ভিদ সংরক্ষণ করতে হবে।