প্রাথমিক চিকিৎসায় লোকায়ত জ্ঞান
নেত্রকোনা থেকে রুখসানা রুমী
মানুষ পৃথিবীতে জন্ম গ্রহণ করার সাথে সাথে তার শেখার পথ শুরু হয়। মানুষ ধীরে ধীরে বেড়ে উঠে এবং প্রতিনিয়তই কিছু না কিছু শেখে। মানুষের শেখার অন্যতম পাঠশালা হলো প্রকৃতি ও পরিবেশ। এছাড়াও মানুষ পরস্পর পরস্পরের কাছ থেকে শিক্ষা লাভ করে থাকে। প্রকৃৃতি, পরিবেশ ও পরস্পরের কাছে থেকে লব্ধ শিক্ষাকে কাজে লাগিয়ে মানুষ নিজেদের জীবনযাত্রা ও বেঁচে থাকার পথকে আরও প্রশস্ত করতে সক্ষম হয়। মানুষের জীবনটা একাকীত্বের জীবন নয়। মানুষ সামাজিক জীব, তাই অনেকের সমন্বয়ে মানুষের জীবনধারা প্রবাহিত হয়। অন্যের পরামর্শ, সৎ উপদেশ বা ভালো কোন উদ্যোগ থেকে মানুষ যেসব শিক্ষা লাভ করে সেগুলো তার চলার পথের পাথেয়।
নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের বড় কাইলাটি গ্রামের একজন দক্ষ কৃষাণী হালিমা আক্তার। চার সন্তানের জননী হালিমা আক্তারকেই পরিবারের সকল কাজ নিজ হাতে করতে হয়। সংসারের কাজের পাশাপাশি বাড়িতে সব্জী চাষ, হাঁস, মুরগি পালনের কাজও তাকে করতে হয়। আবার পরিবারের কোন সদস্য অসুস্থ হলে হালিমার ভাবনার সীমা থাকেনা, কিভাবে ঐ সদস্যকে সুস্থ করে তুলবেন। ডাক্তারের পরামর্শ নেওয়ার আগেই নিজস্ব জ্ঞান এবং অভিজ্ঞ ভেষজ চিকিৎসকের কাছ থেকে শেখা ভেষজ পদ্ধতিতে তিনি তাদের প্রাথমিক চিকিৎসা সেবা দিয়ে থাকেন।
নিজের পরিবারের সদস্যদের স্বাস্থ্য সেবার পাশাপাশি গ্রামের অন্যান্যদেরও তিনি পরামর্শসহ স্বাস্থ্য সেবা দিয়ে সহায়তা করেন। কারো কানে ব্যথা হলে তিনি শুকনো মরিচের বিচি ফেলে দিয়ে খোসাতে সরিষার তেল নিয়ে কয়েক ফোটা কানে দিয়ে দেন। এভাবে দিনে তিনবার করে দু’দিন দিলে কানের ব্যথা সেরে যায়। গলায় ব্যথার জন্য রোগীকে দিয়ে পানি রাখার কলসের গলায় রাতের বেলা চুনের প্রলেপ দেয়ায়। এর ফরে দু’দিনের মধ্যেই গলার ব্যথা সম্পূর্ণ দূর হয়ে যায়। কোমড়ের ব্যথায় কেরোসিনের সাথে লবণ মিশিয়ে ব্যথার স্থানে মালিশ করেন। হাঁটুর ব্যথায় কদম ফুলের পাতা বেঁেধ রাখেন। হাতে, পায়ে ও কোমড়ে ফুড়া হলে ঢোল কলমী পাতার রস পেষ্ট করে ফোড়ার উপর বেঁধে দিলে ফোড়া ভাল হয়ে যায়। নারীদের শারীরিক স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তিনি দলকলস শাক খেতে পরামর্শ দিয়ে থাকেন।
হালিমা আক্তার এর ভেষজ চিকিৎসাতে কোন ধরনের পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া নেই। চিকিৎসার উপকরণও হাতের নাগালেই পাওয়া যায় এবং এগুলোর ব্যবহারও সহজ। হালিমা আক্তার এর অসুস্থতায় ডাক্তারের প্রয়োজন হয় না। গর্ভবতী নারীদের রক্তশূন্যতা দেখা দিলে তিনি বাড়ির চার পাশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো কচুশাক সামান্য সরিষার তেল দিয়ে শাক্ করে খাওয়া পরামর্শ দেন। গ্রামের সকলে তার কাছ থেকে ভেষজ চিকিৎসা সেবা ও চিকিৎসা সেবা সংক্রান্ত পরামর্শ পেয়ে থাকেন। চিকিৎসার জন্য তিনি কোন রাসায়নিক উপকরণ ব্যবহার করেন না, গ্রামের চারপাশে কুড়িয়ে পাওয়া ঔষধি উদ্ভিদ ও লতাগুল্ম দিয়ে তিনি অসুস্থ ব্যক্তিদের চিকিৎসা করে থাকেন। তার ভেষজ চিকিৎসায় সুস্থ হয়ে এলাকার লোকেরা খুবই খুশি। তিনি সকলকে বাড়ির চারপাশে প্রাকৃতিকভাবে জন্মানো শাক-সবজি ও ঔষধি গুণ সমৃদ্ধ খাবার খাওয়ার পরামর্শ দিয়ে এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণের পরামর্শ দেন।
হালিমা আক্তারের ন্যায় গ্রামের সকলেই যদি অচাষকৃত ঔষধি ও খাদ্য জাতীয় উদ্ভিদ নিয়মিত ব্যবহার করে তাহলে অপুষ্টিজনিত সমস্যা, ভিটামিনের ঘাটতি ও আয়রনের অভাবজনিত বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা পেত। এর ফলে একদিকে যেমন বিভিন্ন রোগ থেকে রক্ষা পাওয়া যাবে, তেমনি চিকিৎসা বাবদ আর্থিক সাশ্রয় হবে, পাশাপাশি চিকিৎসা সেবা নিতে গিয়ে বিড়ম্বনা থেকে মানুষ উদ্ধার পাবে। সকলে অচাষকৃত ও কুড়িয়ে পাওয়া এসব শাকসবজি ও ঔষধি উদ্ভিদ ব্যবহার ও সংরক্ষণ করলে এগুলো বিলুপ্তি থেকে রক্ষা পাবে। আমাদের প্রাণবৈচিত্র্য আরও সমৃদ্ধ হবে।