উপকূলের পরিবেশ বন্ধু রবীন্দ্র নাথ
:: শ্যামগনগর থেকে রামকৃষ্ণ জোয়ারদার ও মননজয় মন্ডল::
দেশের গ্রাম বাংলার পল্লীর প্রান্তরে এখনও অনেক সাদা মনের মানুষ রয়েছে যারা প্রকৃতির নিরব বন্ধু ও পরিবেশ সুরক্ষায় নিবেদিতপ্রাণ হয়ে নিভৃতে কাজ করে চলেছেন। দেশের দক্ষিণ পশ্চিম উপকূলীয় শ্যামনগর উপজেলার আটুলিয়া ইউনিয়নের বড়কুপোট গ্রামের তেমনই একজন মানুষ রবীন্দ্র নাথ মন্ডল। পরিবেশবাদী রবীন্দ্র নাথ (৫৫) পেশায় একজন রং মিস্ত্রী হয়েও নিজের মনের তাগিদে বৃক্ষ সম্পদ উন্নয়ন ও সংরক্ষণে উপকূলীয় শ্যামনগরে বিশেষ ভূমিকা রেখে চলেছেন। পরিবেশ-প্রকৃতি ও বনায়নের প্রতি তাঁর অনুরাগ ছোটবেলা থেকে। নিজের বসতভিটায় প্রায় সব ধরনের ফলজ ও বনজ গাছের বনায়ন গড়ে তুলেছেন।
বরীন্দ্র নাথের বনায়নে বিশেষ অবদান হল খোলপেটুয়া নদীর চর বনায়ন। উপজেলার ১০নং আটুলিয়া ইউনিয়নের নওয়াবেঁকী বাজার থেকে বুড়িগোয়ালিনী ইউনিয়নের দূর্গাবাটি গ্রাম পর্যন্ত প্রায় ১২ কি.মি. খোলপেটুয়া নদীর চরে বনায়ন সৃষ্টির অন্যতম প্রধান অবদান তার। উপজেলা সামাজিক বনায়ন অধিদপ্তরের “উপকূলীয় এলাকায় পানি উন্নয়ন বোর্ডের বাঁধ ও বাঁধ সংলগ্ন চর বনায়ন শীর্ষক প্রকল্প” এর আওতায় ওয়াপদা রাস্তার দুই পাশ দিয়ে বাবলা, খেঁজুর, নিম, রেইনট্রি, আকাশমনি, কড়ই এবং নদীর চরে ম্যানগ্রোভ প্রজাতির কেওড়া, গোলপাতা, বাইন, কাঁকড়া, পশুর প্রভৃতি গাছের বীজ ও চারা লাগানো হয়। ২০১০ সালে উক্ত বনায়নের লক্ষ্যে স্থানীয় ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সহযোগিতায় বনায়ন কার্যক্রম বাস্তবায়ন করেন উপজেলা সামাজিক বনায়ন কেন্দ্র। উক্ত বনায়ন রক্ষণাবেক্ষণের জন্য বড়কুপোট গ্রামের স্থানীয়দের সমন্বয়ে একটি বনায়ন সংরক্ষণ কমিটি গঠন করা হয়। রবীন্দ্র নাথকে কমিটির সহ-সভাপতির করে বনায়ন তদারকির জন্য দায়িত্ব দেওয়া। সামান্য পারিশ্রামিকের বিনিময়ে তিনি আন্তরিকতার সাথে এ কাজ করে যাচ্ছেন।
এভাবে বনায়নের সাথে সরাসরি জড়িত হওয়ার পর নিজের চিন্তার মধ্যে বনায়ন গেঁথে যায়। রবীন্দ্র নাথ সকালে ঘুম থেকে উঠে একটি লাঠি হতে বনায়ন সীমানার এক প্রান্ত থেকে অন্যপ্রান্তে ঘুরে বেড়ান। বনায়নের গুরুত্বকে তুলে ধরে মাইকিং করে এলাকার মানুষদের সচেতন ও বনায়নের মধ্যে যাতে কোন গবাদি পশু পাখি প্রবেশ করে ক্ষতি না করে এজন্য সবাইকে সতর্ক করেন। এই প্রসঙ্গে তিনি বলেন, “ওয়াপদা রাস্তার উভয় পাশ বনায়নের মধ্য দিয়ে নদী ভাঙন রোধ, নানা ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ থেকে রক্ষা, জ্বালানি সংকট নিরসন পাখ-পাখালির নিরাপদ আবাসস্থল তৈরিতে বন আমাদের উপকার করবে।” তিনি আরো বলেন, “বনায়নের জন্য বীজ ও চারা লাগানো খুবই সহজ কিন্তু সেটা সঠিক পরিচর্যা ও রক্ষণাবেক্ষণের মাধ্যমে পরিণত বৃক্ষ তৈরি সহজ নয়।”
সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বনায়নের মধ্যে উপস্থিত থেকে বীজ বপন, চারা রোপণ, পানি দেওয়া, আগাছা পরিস্কার, ডাল ছাটাই, পরিচর্যাসহ প্রতিটি গাছকে সন্তানের মমতায় বড় করে তুলেছেন। এলাকায় বন সংরক্ষক হিসেবে সুপরিচিত রবীন্দ্র নাথ। নিজ এলাকা ছাড়া, ঝাঁপা, কামালকাঠি, নীলডুমুর, তালবাড়িয়া, দাঁতিনাখালীসহ উপকূলীয় শ্যামনগরের প্রতিবেশীয় বনায়নে তার অবদান অনেক। শ্যামনগর উপজেলা সামাজিক বনায়ন কর্মকর্তা এমএম মিজানূর রহমান বলেন, “উপজেলায় উপযোগি বনায়নের একটি সফল নাম রবীন্দ্র নাথ। তিনি রোদ-বৃষ্টি, ও রাত-দিনকে উপেক্ষা করে খেয়ে না খেয়ে বড়কুপোট এলাকায় দীর্ঘ একটি বনায়ন গড়ে তুলেছেন। তার কাজের সম্মান ও শ্রদ্ধা জানানোর জন্য বনায়ন সুরক্ষায় কিছু উপকরণ সহযোগিতা করার প্রয়োজন। তাহলে তার কাজের আগ্রহ অনেকখানি বেড়ে যাবে।” শ্যামনগর উপকূল সুরক্ষায় বনায়ন গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন রবীন্দ্রনাথ। এজন্য তিনি কঠোর ও নিরলস পরিশ্রম করে চলেছেন। বনায়নে বিশেষ অবদান রাখায় গবেষণা উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান বারসিক’র পক্ষ থেকে তাঁকে জলবায়ু সংবর্ধনা ও সম্মাননা দেওয়া হয়। রবীন্দ্রনাথ উপকূলীয় পরিবেশ-প্রাণ ও প্রকৃতি বন্ধু। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় রবীন্দ্রনাথের অভিজ্ঞতার আলোকে সংশ্লিষ্ট সবাইকে বনায়ন সুরক্ষায় অগ্রসর হতে হবে।