রূপান্তরিত মানুষের জীবিকার সংকট: প্রয়োজন সমন্বিত উদ্যোগ
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
করোনাকালে সকল পেশাজীবীর মানুষের যেমন জীবিকার সংকট দেখা দিয়েছে তেমনি রূপান্তরিত মানুষ, যাদের আমরা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ হিসেবে চিনি তাঁদের জীবিকার মারাত্মক সংকট দেখা দিয়েছে। এই তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা বাংলাদেশে মোট জনসংখ্যার একটি ক্ষুদ্র অংশ হলেও আবহমানকাল থেকেই এ জনগোষ্ঠীী অবহেলিত এবং অনগ্রসর হিসেবে পরিচিত। সকল নাগরিক সুবিধা ভোগের অধিকার সমভাবে প্রাপ্য হলেও তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা পারিবারিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে বৈষম্যের শিকার বলে প্রতীয়মান। তাই তাদের প্রতি সদয় আচরণ ও তাদের ন্যায্য অধিকার প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট হওয়া পরিবার, সমাজ রাষ্ট্র ও সকলের দায়িত্ব।
সম্প্রতি বারসিক, দিনের আলো হিজড়া সংঘ এবং বরেন্দ্র অঞ্চল যুব সংগঠন ফোরামের আয়োজনে ‘করোনাকালে রূপান্তরিত মানুষের সমস্যা-সম্ভাবনা ও করণীয় বিষয়ক অনলাইন মতবিনিময় অনুষ্ঠিত হয়। মতবিনিময়ে অংশগ্রহণ করেন দিনের আলো হিজড়া সংঘের সাধারণ সম্পাদক ও জয়িতা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পলি, তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার কর্মী জুলি, ডেইলি স্টারের রাজশাহী প্রতিনিধি আনোয়ার আলী, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহকারী অধ্যাপক অভিজিৎ রায়। অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বারসিক বরেন্দ্র অঞ্চল সমন্বয়কারী শহিদুল ইসলাম।
অনলাইন মতবিনিময়ে পলি বলেন, ‘করোনার কারণে আমার বুটিক শিল্পের বিক্রি কমে গেছে। যার ফলে এই কারখানায় প্রায় ৪০০ কর্মীর অনেকে কাজহীন হয়ে পড়েছে। জিনিস বিক্রি না হলে কর্মীদের টাকা দেয়াও মুসকিল হয়ে গেছে। আমার প্রতিষ্ঠানটি সচল রাখতে সরকারী বিশেষ বরাদ্দ দেয়া প্রয়োজন।’ উল্লেখ যে জয়ীতা তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ পলি তাঁর এই প্রতিষ্ঠানের তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলো কাজের সুযোগ পায়। কিন্তু করোনাকালে সেই সম্ভাবনাও যেন বন্ধ হতে চলেছে।
তৃতীয় লিঙ্গের অধিকার কর্মী জুলি বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের অনেক মানুষ অপ্রাতিষ্ঠানিক পেশার সাথে জড়িত, তারা বিভিন্ন খানে টাকা তুলে জীবিকা চালাতেন, করোনাকালে এখন সেটাও বন্ধ। অনেকে তাঁদের বাসা ভাড়া দিতে পারছেন না, খাদ্য সংকটে আছেন।’ তিনি মনে করেন, সক্ষম এবং সবল সকল তৃতীয় লিঙ্গের মানুষগুলোকে উৎপাদনমুখী কাজে লাগানো যেতে পারে।
ডেইলি স্টারের প্রতিনিধি আনোয়ার আলী বলেন, ‘তৃতীয় লিঙ্গের মানুষের কর্মময় করে তুলতে তাঁদের পর্যাপ্ত প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এটা সরকারি ও বেসরকারি সকল প্রতিষ্ঠানকে এগিয়ে আসতে হবে।’
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের সহকারী অধ্যাপক অভিজিৎ রায় একটি গবেষণা প্রবন্ধের সূত্র ধরেন বলেন, ‘করোনাকালে তৃতীয় লিঙ্গের মানুষকে নিয়ে যে গবেষণা করা হয়েছে সেখানে দেখা যায়, তৃতীয় লিঙ্গের মানুষেরা বিভিন্নভাবে যে আয় করতো তা করোনাকালের আগে গড়ে প্রতিদিন ২৯৬ টাকা। কিন্তু এই করোনাকালে তাদের আয় ৯৫% কমেছে। যা এখন ১৪ টাকা।’ তিনি গবেষণার সূত্র ধরে আরো বলেন, ‘করোনাকালে তৃতীয় লিঙ্গের ৭১% মানুষ ঋণ বা ধার করে জীবনযাপন করছেন, ৮১% স্বাভাবিক খাদ্য গ্রহণ করতে পাচ্ছেন না, ৯৩% তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ তাদের ভবিষ্যৎ খাদ্য নিরাপত্তা এবং ভবিষ্যৎ নিয়ে চিন্তিত। এখনো ২% তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ কোন ধরনের সহায়তা পায়নি এবং ১৪% তৃতীয় লিঙ্গের মানুষ সহায়তা পেতে লিঙ্গ বৈষম্যের শিকার হয়েছে।’
তিনি মনে করেন আমাদের বৈচিত্র্যময় পেশাগুলো যখন ধ্বংস হয়েছে তখনই আমরা দেখতে পারি দুর্যোগকালীন সময়ে সাধারণ মানুষের সমস্যা দেখা দিয়েছে। আমাদের বৈচিত্র্যময় পেশাগুলোকে টিকিয়ে রাখতে হবে।