বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসের আহবান
ঢাকা থেকে মো: জাহাঙ্গীর আলম:
১৫ জুন বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস। সারা বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবস পালিত হচ্ছে। বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসের প্রতিপাদ্য ”প্রবীণদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আইনগত সেবায় প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করণের মাধ্যমে তাদের প্রতি যৌন, শারীরিক এবং অর্থনৈতিক বৈষম্য লাঘব করা। এই দিবস পালনের মূল উদ্যেশ্য প্রবীণদের অধিকার নিশ্চিত করার পাশাপাশি বিশ্ব জনগোষ্ঠিকে প্রবীণ বিষয়ে আরো সংবেদনশীল করা। প্রবীণ নির্যাতন বলতে ”শুধু বয়স বেশী হবার কারণে সহিৎসতা অথবা ক্ষতিগ্রস্থের শিকার হওয়া বোঝায়”। প্রবীণ নির্যাতন সাধারণত প্রবীণদের কাছের পরিজনদের দ্বারাই সংঘটিত হয়। যেমন: পরিবারের সদস্য এবং সেবাদানকারী অথবা সমাজ কাঠামো এবং প্রতিষ্ঠানের দ্বারাই সম্পন্ন হয়ে থাতে। এই দিবসটিকে কেন্দ্র করে গত ৬ জুন ২০২০ তারিখে জাতিসংঘের প্রধান কার্যালয়ে একটি সম্মেলনের আয়োজন করা হয় যেখানে প্রবীণদের অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং আইনগত নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য প্রয়োজনীয় উদ্যোগ গ্রহণ করার কথা বলা হয়। আমরা একটু খেয়াল করলেই দেখতে পারি আমাদের দেশের প্রবীণরা ভাল নেই। দেশের চিকিৎসা ব্যবস্থার উন্নয়ন, স্বাস্থ্য সচেতনতার অবাধ তথ্যপ্রবাহ, গড় আয়ু বৃদ্ধি এবং মানুষের দোর গোড়ায় স্বাস্থ্যসেবা পর্যাপ্ততা প্রভৃতি কারণে দেশে প্রবীণ মানুষের সংখ্যা দিন দিন বেড়েই চলছে
আন্তর্জাতিকভাবে স্বীকৃত এবং জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশে ৬০ (ষাট) বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিদেরকে প্রবীণ বলে অভিহিত করা হয়। জাতিসংঘ ঘোষণা অনুযায়ী বাংলাদেশের ৬০ (ষাট) বছর এবং তদূর্ধ্ব বয়সী ব্যক্তিগণ প্রবীণ হিসেবে স্বীকৃত হবেন। সরকারী হিসেবে বর্তমানে বাংলাদেশে ১ কোটি ৩০ লক্ষের অধিক প্রবীণ মানুষ রয়েছে যা মোট জনসংখ্যার ৯ ভাগের মতো এবং ধারণা করা হচ্ছে আগামী ২০৫০ সালে মোট জনসংখ্যার ২০ ভাগ হবে প্রবীণ জনগোষ্ঠী। প্রবীণরা দেশের ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার একটি অংশ। বাংলাদেশের প্রবীণ ব্যক্তিদের প্রধান সমস্যাবলীর মধ্যে স্বাস্থ্যগত সমস্যা এবং অর্থনৈতিক অস্বচ্ছলতা অন্যতম। আমাদের সংস্কৃতির প্রেক্ষাপটে পরিবার হল একটি প্রাচীন প্রতিষ্ঠান। অতীতে প্রবীণেরা যৌথ পরিবারে সকলের নিকট হতে সেবা এবং সহায়তা পেতেন এবং এভাবেই তাদের প্রবীণ সময় কেটে যেত। পরিবার এবং সমাজে প্রবীণদের প্রতি শ্রদ্ধা ও সম্মান প্রদর্শনসহ তাদের বেশি যত্ম নেয়ার একটি বিশেষ মূল্যবোধ এবং সংস্কৃতির চর্চা ছিল। কিন্তু বর্তমানে সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও অর্থনৈতিক নানা পরিবর্তনের ফলে যৌথ পরিবারগুলো ভেঙ্গে ছোট হয়ে যাচ্ছে। প্রবীণেরা হারাচ্ছে তাদের প্রতি সহানুভূতি, বাড়ছে অবহেলা আর তারা শিকার হচ্ছেন বঞ্চনার।
সামাজিক মূল্যবোধের অবক্ষয়ের ধারায় দেখা যাচ্ছে প্রবীণরা প্রথমত নিজ পরিবারেই তাদের ক্ষমতা ও সম্মান হারাচ্ছেন এবং ধীরে ধীরে সমাজের সকল কর্মকান্ড থেকে বাদ পড়ছেন। বিশেষ করে তৃণমূল পর্যায়ের প্রবীণদের বার্ধক্যজনিত সমস্যা আর অন্যদিকে চরম আর্থিক দীনতার মধ্যে থাকার কারণে তারা পরিবার হতে শুরু করে সমাজের প্রতিটি ক্ষেত্রেই সকল ধরনের সেবা পাবার সুযোগ হতে বঞ্চিত। ফলে প্রবীণ এই জনগোষ্ঠী প্রতিনিয়ত বিভিন্ন ধরনের সামাজিক নিরাপত্তা ঝুঁকির মুখোমুখি হচ্ছে যা আগামীতে একটি জাতীয় সমস্যা হিসাবে চিহ্নিত হতে পারে। সমাজের বিপুল এ জনগোষ্ঠীকে কোনভাবেই উপেক্ষা করার উপায় নেই। তাই বর্তমানে প্রবীণদের উন্নয়নের বিষয়টি জাতীয় ও আন্তর্জাতিকভাবে বেশ গুরুত্বপূর্ণ ইস্যু হয়ে দঁড়িয়েছে।
সারা পৃথিবীর মতো বাংলাদেশের মানুষেরা করোনা ভাইরাসের সাথে যুদ্ধ করে ক্লান্ত হয়ে পড়ছে। স্থবির হয়ে পড়েছে দেশের অর্থনৈতিক কর্মকান্ড, খাদ্য সংকটে পড়েছে দেশের নিম্নও মধ্যম আয়ের মানুষেরা। বৈশ্বিক এই সংকটে সবচেয়ে অবহেলায় রয়েছে দেশের প্রবীণ মানুষেরা। বাংলাদেশসহ সারা পৃথিবীতে যে চার লক্ষের অধিক মানুষ মৃত্যুবরণ করেছেন তার একটি বড় অংশই প্রবীণ। প্রবীণদের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা অন্যান্য বয়সের মানুষদের চেয়ে অনেক কম এবং যথাযথ গুরুত্ব না থাকার কারণে তাদের মৃত্যুহার তুলনামূলকভাবে বেশী। ইতিমধ্যে আমাদের দেশে এক হাজারের অধিক মানুষ করোনা রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা গিয়েছে এবং এই রোগে আক্রান্ত আক্রান্ত হয়েছে ৭৫ হাজারের অধিক মানুষ। আমাদের দেশের পারিবারকি ও সামাজিক মূল্যবোধের বর্তমান অবস্থার একটি বড় পরীক্ষা নিয়ে ফেলেছে বিশ্বে চলমান সংকট করোনা ভাইরাস। আমরা এই সংকটকালীন সময়ে আমাদের দেখতে হয়েছে, করোনা সংক্রমন সন্দেহে গর্ভধারিনী মাকে তার সন্তানেরা জঙ্গলে ফেলে দিয়েছে। যমুনা টিভির তথ্য মতে গত ১৩ জুন ২০২০ তারিখে বরগুণার পাথরঘাটায় বয়স্ক ভাতার টাকা সন্তানদের না দেওয়ার কারণ দুই সন্তান মিলে তাদের মাকে বাড়ি থেকে বের করে দিয়েছে। এই সংবাদ শুনে সাংবাদিকসহ স্থানীয় মানুষরা মিলে সন্তানদের বুঝিয়ে তাদের মাকে বাড়িতে তুলে দিয়েছে। এই রকম হাজারো ঘটনা হয়ত আমাদের চেখের অগোচরে ঘটে চলছে তার হিসাব আমরা জানতে পারি না। হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের তথ্য মতে ”বিশ্বব্যাপি প্রতি ছয়জনে একজন প্রবীণ নারী-পুরুষ নির্যাতনের শিকার হয়। পৃথিবীতে যত প্রবীণ নির্যাতনের শিকার হয় তার মাত্র ৪% রিপোর্ট করা হয়”। প্রবীণরা পাঁচ ধরণের নির্যাতনের শিকার হয। (১) শারীরিক নির্যাতন বলতে মারধোর, ঠেলাঠেলি, যথাযথ ঔষধ ব্যবহার না করা, বাধাদান এবং আটক রাখা, (২) মানুষিক নির্যাতন , ভয়, আপমান, নিয়মিত দোষারোপ করা, বার বার প্রবীণদের ইচ্ছাগুলো পূরণে অবহেলা করা, বন্ধু-বান্ধব, আত্মীয়-স্বজন থেকে আলাদা রাখা। (৩) যৌন নির্যাতন বলতে যৌন হয়রানি, সম্মতি বা অবহিত না করে যৌন ক্রিয়াকলাপ করা, (৪) অবহেলা বলতে খাদ্য, পানি, আশ্রয়, দৈনন্দিন জীবনযাপনে সহায়তা না করা এবং (৫) আর্থিক নির্যাতন বলতে কোন প্রবীণ ব্যক্তির অর্থ বা সম্পত্তি ব্যবহার করা বা তাদের সিদ্ধান্তগত সম্মতি ছাড়াই আর্থিক সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা। প্রবীণদের সমস্যা অনুধাবন করে বর্তমান সরকার ১৯৯৬ সাল থেকেই দরিদ্র অসহায় প্রবীণদের জন্য বয়স্ক ভাতার ব্যবস্থা করেন। বারসিক এবং হেল্পএজ ইন্টারন্যাশনালসহ বাংলাদেশের বেশকিছু বেসরকারী সংস্থা সরকারের পাশাপাশি প্রবীণদের অধিকার প্রতিষ্ঠাসহ তাদের প্রতি সব রকমের বৈষম্য, নির্যাতন ও অবজ্ঞা প্রতিরোধে সচেতনতার কাজটি করে যাচ্ছেন।
প্রবীণদের মর্যাদাপূর্ণ, দারিদ্রমুক্ত, কর্মময়, সুস্বাস্থ্য ও নিরাপদ সামাজিক জীবন নিশ্চিত করার জন্য গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকার ২০১৩ সালে ”জাতীয় প্রবীণ নীতিমালা ২০১৩” এবং ”পিতামাতার ভরণপোষণ আইন ২০১৩” ঘোষনা করে। ২০১৪ সালে বর্তমান রাষ্ট্রপতি বাংলাদেশের প্রবীণ নাগরিকদের ”সিনিয়র সিটিজেন বা জেষ্ঠ্য নাগরিক হিসেবে মর্যাদা দান করেছেন। এই পেক্ষাপটে আপনার সামনে কোন প্রবীণ নির্যাতিত হলে আপনার কাজ হলো, তাদের সাথে যোগাযোগ রাখুন, তার কথা শুনুন এবং তার সাথে সংযোগ স্থাপন করুন, তাকে সাহায্য করুণ এবং তাকে জানান যে তার নির্ভয়ে জীবন যাপন করার অধিকার আছে, প্রবীণের অনুমতি নিয়ে যথাযথ স্থানে জানান, পরিশেষে আপনি সামাজিক উদ্যোগে সম্পৃক্ত হয়ে প্রবীণদের অধিকার রক্ষায় কাজ করুণ। বিশ্ব প্রবীণ নির্যাতন সচেতনতা দিবসে আসুন আমরা আমাদের পরিবারে ও সমাজের প্রবীণদের প্রতি যত্নবান হই এবং তাদের জীবনকে আনন্দময় করে তুলতে ভূমিকা রাখি।