দেশে পরিবেশ সংরক্ষণের নানা আইন থাকলেও নেই সঠিক বাস্তবায়ন
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল:
বিগত ৫০ বছরে বাংলাদেশে বৈষম্যের পাল্লাই ভারি হয়েছে। দেশটি বৈষম্যের দেশেই পরিনত হয়েছে। নগরের প্রান্তিক মানুষদের জন্য কোন সুযোগ, সুবিধা নেই কিন্তু তাদেরকে থাকতে হচ্ছে সবচেয়ে অপরিচ্ছন্ন জায়গায়। দেশে পরিবেশ সংরক্ষণের নানা আইন তৈরি হলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন নেই বলে আলোচনা সভায় বলেছেন বিশিষ্ট চিকিৎসক ও প্রান্তিক মানুষের নেতা ডিএসকের নির্বাহী পরিচালক ডা: দিবালোক সিংহ। আজ ৫ জুন ২০২১ শনিবার বিশ^ পরিবেশ দিবস উপলক্ষ্যে ইউএস এইড এবং এফসিডিও এর অর্থায়নে এবং কাউন্টার পার্ট ইন্টারন্যাশনাল এর কারিগরি সহযোগীতায় ‘ঢাকাকলিং’ কনসোর্টিয়াম প্রকল্পের আওতায় বারসিক, ডিএসকে, কাপ ও ইনসাইট নামে চারটি সংগঠনের উদ্যোগে বিকাল ৩ টায় ডা: দিবালোক সিংহ এর সভাপতিত্বে ও বারসিকের প্রজেক্ট ম্যানেজার ফেরদৌস আহমেদের সঞ্চালনায় জুম অনলাইনে এ্ক আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়। আলোচনা সভায় আলোচনায় অংশগ্রহণ করেন বিশিষ্ট জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা: লেলিন চৌধুরী, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন, ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়ের সমাজবিজ্ঞান বিভাবের শিক্ষক দেবাশীষ কুন্ড, কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সিনিয়ার প্রোগ্রাম স্পেসালিষ্ট সুলতান এস চাঁদ, ঢাকা কলিং কনসোর্টিয়াম কোঅর্ডিনেটর সানজিদা জাহান আশরাফি প্রমুখ। এছাড়া আরও অংশগ্রহণ করেন কাপের মাহবুবুল আলম,ইনসাইটস এর নিগার রহমান, ডিএসকের প্রজেক্ট ম্যানেজার রাকিবুল ইসলাম, ডব্লিউকেবি,র প্রতিনিধি ফারজানা ইয়াসমিন,বস্তিবাসী নেত্রী হোসনে আরা বেগম রাফেজা, শিক্ষক সোহেল রানা, ইয়ুথ লিডার বৈশাখী প্রমূখ। আলোচনা সভার শুরুতে মূল প্রবন্ধ উত্থাপন করেন বিশিষ্ট লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ। এসময় আরও উপস্থিত ছিলেন বারসিকের নির্বাহী পরিচালক সুকান্ত সেন ও কাপের নির্বাহী পরিচালক খন্দকার রেবেকা সান ইয়াত।
আলোচনা সভা থেকে ডা: লেলিন বলেন, বাস্তুতন্ত্র ধ্বংস হচ্ছে মানে প্রতিবেশ ও পরিবেশের একেকটা অংশ ধ্বংস হচ্ছে । আর এগুলো ধ্বংস করছে মানুষ। আমাদের এখন দায়িত্ব হলো বিলুপ্তপ্রায়দের রক্ষা করা আর যেগুলো বিলুপ্ত হয়ে গেছে সেগুলোকে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা। মানুষকে ভাল থাকতে হলে তার চারপাশকে ভাল রাখতে হবে।
শিক্ষক জোবাইদা নাসরিন বলেন, করোনায় মেডিকেল বর্জ্য চারিদিক সয়লাব আর এগুলো দেখে মনে হচ্ছে দেখার কেউ নেই। আমরা দেখি নগরের যত্রতত্র ময়লার ভাগাড়, এমনকি ঢাকা বিশ^বিদ্যালয়েও দিনের পর দিন ময়লার ট্রাক পড়ে থাকে। আমাদের প্রাণ ও প্রকৃতির প্রতি সংবেদনশীলতা তৈরি করা জরুরি। আজকে গাছ কাটতে কোন অনুমতি লাগেনা আর তাই পরিবেশ বিনষ্ট হচ্ছে।
কাউন্টারপার্ট ইন্টারন্যাশনালের সুলতান এস চাঁদ বলেন, আলোচনা আমাদের সমৃদ্ধ করেছে। একাডেমিক জ্ঞানের পাশাপাশি আমাদের বাস্তবায়নটাও অত্যন্ত জরুরি। সমাজের প্রতিটি স্তরে সচেতনতা প্রয়োজন। আইন ও নীতিগুলো সম্পর্কে বিশেষজ্ঞদের আরও বলা প্রয়োজন আর নীতি ও কাঠামোর যে আইনী পরিবেশ রয়েছে তার সুষ্ঠু বাস্তবায়নটাও অত্যন্ত জরুরি।
শিক্ষক দেবাশীষ কুন্ডু বলেন, ঢাকা আমাদের ডাকছে এই প্রতিবেশ ও পরিবেশকে সমুন্নত রাখতে। তিনি বলেন, আমাদের দেশে প্রকৃতপক্ষে নগরায়ন হয়নি, হয়েছে নগরউন্নয়ন। যার কারণে বুড়িগঙ্গাকে রক্ষা করা যায়নি, যায়নি এই নগরের প্রাণবৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে। তিনি আরও বলেন, ঢাকার প্রাণবৈচিত্র্যকে রক্ষা করতে হলে তরুণ প্রজন্মকে এগিয়ে আসতে হবে।
বস্তিবাসী নেত্রী হোসনে আরা বেগম রাফেজা বলেন, আমরা ছোটবেলায় পড়েছি আমাদের চারপাশে যা আছে তাই নিয়ে পরিবেশ কিন্তু আমরাতো দেখি আমাদের চারপাশে ময়লা আর আবর্জনা। আমরা এমন পরিবেশ চাই না। আমরা যারা বস্তিতে থাকি তাদের সবসময় ময়লা বর্জ্যের মধ্যে জীবন কাটাতে হয়। আমরা চাই ময়লা আবর্জনামুক্ত পরিবেশ। ইয়ুথ লিডার বৈশাখী বলেন, মানুষের দাড়াই আবর্জনা তৈরি হচ্ছে। তাই মানুষকে সচেতন করতে হবে। গাছ লাগানো যায়। আর মানুষকে এমনভাবে বুঝাতে হবে যেনো তারা ভাবে এটা তার ভালোর জন্য করা হচ্ছে।
মূল প্রবন্ধে পাভেল পার্থ বলেন, আয়তনে ছোট কিন্তু বৈচিত্র্য-বৈভবে অনন্য দক্ষিণ এশিয়ার এক ছোট্ট দেশ বাংলাদেশ। উত্তর-পূর্বের হিমালয় পাহাড় ও উজান থেকে নেমে আসা অসংখ্য নদ-নদী ও স্রোতধারার বয়ে আনা পলিমাটিতে গঠিত হয়েছে এই ব-দ্বীপ। অপরিকল্পিত উন্নয়ন, বনউজাড়, জলাভূমি ভরাট, বৃহৎ খনন, রাসায়নিক কৃষি নানাভাবে দেশের প্রাণ-প্রকৃতির বিকাশকে রুদ্ধ করছে। করোনা মহামারিকালে দুনিয়াব্যাপি এই উপলব্ধি আবার চাঙ্গা হয়েছে যে, প্রাণ-প্রকৃতি ও বাস্তুতন্ত্রের সুরক্ষা ছাড়া এই গ্রহে সকলের বেঁচে থাকা কঠিন হয়ে পড়বে। মানুষসহ সকল প্রাণসত্তার জীবনবিকাশে স্থানীয় পরিবেশ ও বাস্তুতন্ত্র প্রতিনিয়ত যে অবদান রাখছে আমরা এর হিসাব কষে দেখছি না। অথচ পরিবেশ ও বাস্তুসংস্থানের এই বিনামূল্যের অক্লান্ত সেবার জন্যই আমরা বেঁচে আছি। ভবিষ্যতের জন্য প্রাকৃতিক, সাংস্কৃতিক, স্বাস্থ্যগত কিংবা মনোসামাজিকভাবে কী এই শহর সবার জন্য বাসযোগ্য থাকবে? বাস্তুতন্ত্রের এমন ক্ষত নিয়ে কী তা সম্ভব? বাস্তুতন্ত্র পুনরুদ্ধারে আসুন গড়ে তুলি সক্রিয় নাগরিক সংহতি।
আলোচনাসভা থেকে নিম্নোক্ত প্রস্তাবনাগুলো তুলে ধরা হয় :
১.গ্রাম-শহরসহ সর্বত্র পরিবেশ সচেতনতায় যুব-তরুণদের যুক্ত করতে হবে।
২.নগরের নিম্ন আয়ের মানুষরা পরিবেশ সংরক্ষণে ভূমিকা নিলেও জলবায়ুজনিত দুর্যোগে তারাই সবচে বেশি ভ’ক্তভোগী। পরিবেশ ব্যবস্থাপনা ও পরিবেশ সংক্রান্ত কর্মসূচিতে নগরের নিম্ন আয়ের মানুষদের সক্রিয়ভাবে যুক্ত করতে হবে।
৩.বর্জ্য ব্যবস্থানায় আলাদা বাজেট ও প্রণোদনার ব্যবস্থা করা।
৪.বস্তিগুলোতে বর্জ্য ব্যবস্থাপনার জন্য সরকারের বৃহৎ উদ্যোগ নিতে হবে। বর্জ্যকে ব্যবহারের উপযোগী করতে হবে।
৫. বর্জ্য ব্যবস্থাপনায় বস্তিবাসীদের উচ্চ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা। তাদের আয়ের ক্ষেত্র যাতে তৈরি হয় তা দেখা।
৬. ঢাকাসহ সারা দেশের পরিবেশকে সুষ্ঠু করার জন্য বর্জ্য ব্যবস্থাপনার নীতির পরিবর্তন করা জরুরি।
৭. ঢাকার বস্তিবাসী নিম্ন আয়ের তরুণদের নিয়ে পরিবেশ রক্ষা যুবটিম গঠন করা জরুরি।
৮.বর্জ্যমুক্ত পরিচ্ছন্ন নির্মল নগর গঠনে গণমাধ্যমকে আরো সক্রিয় হতে হবে।
৯.সকলের জন্য নগরে পর্যাপ্ত উদ্যান, খেলার মাঠ, জলাশয়, হাঁটার রাস্তা ও উন্মুক্তস্থান নিশ্চিত করতে হবে। নগরের উদ্ভিদ-প্রাণীসহ সকল বন্যপ্রাণের সুরক্ষায় বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
১০.ঢাকাসহ সকল নগরের আবাসিক এলাকা থেকে রাসায়নিকসহ সকল বিপদজনক মজুত ও কারখানা সরাতে হবে।
১১.নগরের চারধারে এবং বস্তির পাশে আবর্জনার ভাগাড় গড়ে তোলা যাবে না। বিপদজনক ও ঝুঁকিপূর্ণ কোনো কারখানা গড়ে তেলা যাবে না।বৈশিষ্ট্য অনুযায়ী বিভিন্ন বর্জ্য এবং বিশেষ করে করোনাকালীন বর্জ্য ফেলার জন্য পৃথক স্থান ও বিশেষ ব্যবস্থাপনা তৈরি করতে হবে। বর্জ্য সংরক্ষণ, পৃথকীকরণ, যথাস্থানে ফেলা বিষয়ে নাগরিক সচেতনতা তৈরি করতে হবে।