কৃষক রহমত আলীর ধান
নেত্রকোনা থেকে হপী রায়
সভ্য সমাজের মানুষেরা নিত্য নতুন পন্থায় বা পেশায় জীবিকা নির্বাহ করেন। বেঁচে থাকার তাগিদে নানা রকম আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের সাথে যুক্ত হন। তারপর দিন যায় আরামে, আয়েশে। বিভিন্ন পেশায় কাজ করতে গিয়ে হয়তো ঝুঁকি আছে, কিন্তু অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা বা নিরাপত্তাও আছে। আমাদের দেশের শতকরা ২০ ভাগ মানুষ এই শ্রেণির। বাকী ৮০ ভাগ মানুষই কৃষক। কৃষকদের সকল চিন্তা কৃষি কাজকে ঘিরেই।
আদিকাল থেকেই এই ভূখণ্ডে কৃষিকাজ চলে আসছে কৃষকদের উদ্ভাবিত সহজ ও স্বাভাবিক কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে। কোন জমিতে কোন ফসল ভালো হবে, জমিতে কতটি চাষ দিতে হবে, মাটির কোন খাবারের দরকার সব কিছুই তাদের জানা। আবার বীজ হাতে নিয়েই বলে দিতে পারেন ফসল কেমন হবে।
এমনই একজন প্রবীণ কৃষক কিসমতআড়া গ্রামের রহমত আলী। তিনি ছোটবেলা থেকেই কৃষি কাজের সাথে জড়িত। প্রতিবছরই তাঁর জমিতে ধানসহ নানা প্রকারের সবজি চাষ করেন। অন্যান্য জাতের পাশাপাশি তিনি গত ২০১৫ সালে আমন মৌসুমে ৪০ শতাংশ জমিতে মুক্তা ধানের চাষ করেছিলেন। এই ধানের বীজ প্রতিবেশি কৃষক আলাউদ্দিনের কাছ থেকে সংগ্রহ করেছিলেন।
ধান রোপণের কিছুদিন পর স্বাভাবিক নিয়মেই ধানের থোড় বের হয়। এক সময় ধান পাকে। জমি পরিদর্শন করতে গিয়ে রহমত আলী এই মুক্তা ধানের জমিতে ভিন্ন জাতের ধান দেখতে পান। যে ধানগুলো দেখতে মুক্তা ধানের মতো হলেও সুক্ষ্ম কিছু পার্থক্য আছে। যেমন এই ধান গাছগুলো খাটো, কুশি বেশি, শীষ লম্বা এবং ধানের গাঁথুনি বেশ শক্ত। অন্যান্য ধান বা মুক্তা জাতের ধানের মতো সময় নিয়েই এই ধানগুলো পেকেছে। জমিতে ভিন্ন জাতের ধানগুলো চোখে পড়তেই তিনি এগুলোর প্রতি আকৃষ্ট হলেন। ধান কাটার সময় বেশ যতœ নিয়ে এগুলো আলাদা করে কেটে রাখেন। পুরো জমিতে ছড়ানো কয়েকটি গোছা থেকে মাত্র ২০০ গ্রাম এর মতো ধান পেয়েছিলেন। ধান শুকিয়ে বীজ ধানের মতো করেই সংরক্ষণ করেন তিনি ।
ধানগুলোর উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের কারণেই তিনি এগুলোকে পরবর্তী বছরে আবাদ করার জন্য সিদ্ধান্ত নেন। ২০১৬ সালের আমন মৌসুমে এই ধানের বীজগুলো তিনি প্রায় ২ শতাংশ জায়গাতে রোপণ করেন। এটুকু জায়গায় ২০ কেজির মতো ধান হয়েছে। এই ধানের চাল তৈরি করে ভাত খেয়েছেন। খেতে অন্যান্য ভাতের মতোই স্বাদ। তবে ভাতগুলো বেশ আঁঠালো। এই ধানের ফলন, শীষের গাঁথুনি এই বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে কৃষক রহমত আলী প্রতিবছর এ ধান আবাদের সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। কিসমতআড়া গ্রামের অনেকেই তাঁর ধানের প্রশংশা করেছেন। তাঁর চাষকৃত অন্যান্য জাতের ধানের মধ্যে চিনিশাইল, সুবাস, আইজং, ও বোরো। তিনি জমিতে বেশির ভাগই জৈব সার ব্যবহার করেন। সকল জাতের বীজও তিনি সংরক্ষণ করেন। তবে মুক্তা ধানের পরিবর্তে কৃষক মো. আলাউদ্দিকে চিনিশাইল ধানের বীজ দিয়েছিলেন।
আমাদের দেশের আদি পেশা হলো কৃষি। আর এই কৃষিকাজ করে যারা অন্ন বস্ত্রের সংস্থান করেন তারা হলেন কৃষক। অন্যান্য পেশার সাথে জড়িত থাকা মানুষের চিন্তা, চেতনার পরিবর্তন হয়। তাদের নিজেদের খাদ্য উৎপাদন করতে হয় না। কিন্তু কৃষকদের ফসল ফলাতে হয়। একজন কৃষকের সম্পদ হলো তার বীজ, এক খ- জমি, গোয়ালের গরু, হাঁস-মুরগি ইত্যাদি। এসব সম্পদকে ঘিরেই তাঁর চিন্তা ভাবনা, সব কিছু। নিজ পরিবার ও অন্যান্য মানুষের অন্ন যোগানদাতা হলেন আমাদের কৃষক। লোকায়ত জ্ঞান ভিত্তিক ও স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদ এই দুইয়ের আন্তঃক্রিয়ার মাধ্যমে একজন কৃষক নিজস্ব চিন্তায় স্থায়িত্বশীল কৃষিকাজের চর্চা করেন। তাই স্থানীয় প্রাকৃতিক সম্পদের সাথে স্থানীয় জনগণের আন্তঃসম্পর্ককে গতিশীল করার লক্ষ্যে এসব সম্পদের উপর জনগণের পূর্ণ অধিকার নিশ্চিত করার লক্ষ্য নিয়ে এগিয়ে যেতে হবে।