করোনাকালীন বিনোদন: ঘুড়ি উৎসব
সিংগাইর মানিকগঞ্জ থেকে শাহীনুর রহমান
গ্রাম প্রধান বাংলাদেশে গ্রামের বিশাল জনগোষ্ঠীর শত শত বছর ধরে নিজস্ব ধ্যান, ধারণা ও জীবন পদ্ধতিকে ভিত্তি করে নানামুখী যে সংস্কৃতি গড়ে তুলেছেন তা আমাদের লোক সংস্কৃতি। দীর্ঘকাল থেকে গড়ে ওঠা গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর সামাজিক আচার-আচরণ ও বিশ্বাস, জীবনযাপন আনন্দ-উৎসব বাংলার মানুষের প্রকৃত পরিচয় বহন করে। গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর আনন্দ বিনোদনের মাধ্যম ও ছিল লোকজ সংষ্কৃতির নানা ধরনের উৎসব, জারি, সারি, ভাটিয়ালি গান, ঘুড়ি উড়ানো, কানামাছি, লাঠি খেলা, কাবাডি, কুতকুত, গোল্লাছুট, ষাঁড়ের লড়াই, বউচি, ডাংগুলি, দাড়িয়াবান্ধা, নৌকা বাইচ, পুতুল খেলা, ফুল টোকা, বাঘ ছাগল খেলা, মোরগ লড়াই, ষোল গুটি, এক্কাদোক্কা প্রভৃতি। কিন্তু আধুনিক সভ্যতার অগ্রগতির ফলে বাঙালির শত বছরের সমৃদ্ধ লোক সংষ্কৃতি ও লোকজ খেলা ধুলা ও উৎসবে যেন হারিয়ে যেতে বসেছে, হারিয়ে যেতে বসেছে বাঙালির লোকায়ত সংষ্কৃতিও- যেমন ঘুড়ি উড়ানো।
ঘুড়ি উৎসব ছিল পাড়া মহল্লায় গ্রামবাংলার একটি চিরায়ত লোকজ সংস্কৃতি। গ্রামবাংলায় যেসব প্রতিযোগিতা হতো তার মধ্যে অন্যতম ছিল ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব। এক সময় শরৎ, হেমন্তের বিকেলের আকাশ ছেয়ে যেত ঘুড়িতে। আকাশজুড়ে উড়ে বেড়াত নানা রঙের ঘুড়ি। লাল, নীল, সবুজ, হলুদ, বেগুনি কত রঙের ঘুড়িতে আকাশ ছেয়ে যেত। দেখে মনে হতো, নানা রঙের মেলা বসেছে আকাশজুড়ে। গ্রামের প্রতি পাড়া মহল্লার লোকজন জেগে থাকতো। গ্রামের যুবক ছেলেদের সঙ্গে এ উৎসবে বৃদ্ধরাও যোগ দিতেন। ঘুড়ি উড়ানোর উৎসব ছিল গ্রামীণ মানুষের জীবনে এক অফুরন্ত আনন্দের উৎসব, যা এখন প্রায় বিলীন হয়ে যাচ্ছে।
এই করোনাকালীন সময়ে বিনোদনের খুঁজে আবার যেন বাঙালি সংস্কৃতিতে ফিরে এসেছে হারিয়ে যাওয়া লোকায়ত সংষ্কৃতি ঘুড়ি উৎসব। সারা দেশের মত মানিকগঞ্জের মানুষও মেতে উঠেছেন ঘুড়ি উৎসবে। মানিকগঞ্জের বিভিন্ন পাড়া, মহল্লায় এখন কেবলই শুধু রংবেরঙের ঘুড়ি নীল আকাশে। ৮ মার্চ প্রথম বাংলাদেশে করোনা ভাইরাস শনাক্ত হয়। সেই থেকে অদৃশ্য করোনা নামক এক ভাইরাসে সাদৃশ্য পৃথিবীর সকল মানুষকে গৃহবন্দী জীবনযাপন করতে হচ্ছে। প্রয়োজন না হলে ঘর থেকে বের না হওয়ার নির্দেশও আছে সরকারের পক্ষ থেকে। ঘরবন্দি মানুষের অনেকেই ঘরে থাকতে চাচ্ছেন না। খুঁজছেন সময় কাটানোর পথ। দীর্ঘ লকডাউনে বন্ধ রয়েছে দেশের সকল প্রকার খেলাধুলা ও বিনোদোন মাধ্যম। ফলে অফুরন্ত সময় এখন মানুষের হাতে। আর এই সুযোগে করোনানকলীন ক্লান্তি দুর করতে একটু আনন্দ পেতে পাড়া মহল্লায় আয়োজন হচ্ছে ঘুড়ি প্রতিযোগিতা। শিশু কিশোর থেকে শুরু করে বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ সবাইকে একসাথে দেখা যাচ্ছে ঘুড়ি ওড়াতে।
আধুনিকতার ভাইরাস বাঙালিকে এখনো পুরোপুরি গ্রাস করতে পারিনি তার প্রমাণ মিলে গ্রামাঞ্চলে আকাশে তাকালে। আধুনিক সভ্যতার কল্যাণে যুব সমাজের একটি বড় অংশ যেখানে স্মার্ট মোবাইল, ফেইসবুক কম্পিউটারে ব্যস্ত থাকতেন সেই যুবকরা দা হাতে ব্যস্ত ঘুড়ি তৈরিতে। বিশেষ করে এই ঘুড়ি উড়ানো এলাকার যুব সমাজকে অনুপ্রাণিত করছে। প্রতিযোগিতা হচ্ছে কে কত বড় বানাতে পাড়ে। কেউ একটি করে ঘুড়ি তৈরি করছেন কেউ একাধিক ঘুড়ি বানাচ্ছেন। তৈরিকৃত ঘুড়ি মধ্যে রয়েছে, পতিঙ্গা, চিলা, বাজ, কয়রাফুল, মানুষ, সাপা, ঢোল, উড়োজাহাজ ইত্যাদি। ঘুড়ি তৈরিতেও আছে বৈচিত্র্য। কেউ পলিথিন, কেউ ঘুড়ি তৈরি করেছেন কাগজ দিয়ে। পলিথিনের ঘুড়ির ক্ষেত্রে তাতে দেওয়া হচ্ছে নানান আকার। আবার কাগজের ঘুড়ি তৈরিতে অনেকেই ব্যবহার করছেন রঙিন কাগজ। কেউ তাতে আবার যুক্ত করছেন নকশা।
স্কুল বন্ধ থাকায় শিশু-কিশোররাও মেতে উঠেছে ঘুড়ি উৎসবে। রাতে ঘুড়ি উড়ানোর জন্য ঘুড়িতে যুক্ত করেছে ব্যাটারি চালিত বাতি, যা রাতে উড়ানো ঘুড়িতে জ্বলছে। বড়দের কেউ কেউ ঘুড়ি বানাতে পারলেও শিশু-কিশোররা বেশিরভাগই ঘুড়ি কিনে উড়িয়ে থাকে। আবার যাদের ঘুড়ি উড়ানোর সুযোগ নেই তারা দুর থেকে অন্যের ঘুড়ি উড়ানো দেখে আনন্দ উপভোগ করছেন। ঘুড়ি উৎসবকে কেন্দ্র করে বিক্রি হচ্ছে ঘুড়ি তৈরি করার উপকরণও। সেই সাথে কদর বেড়েছে ঘুড়ি তৈরির কারিগড়দের।। নানা ধরনের ঘুড়ি তৈরি করে করোনাকালীন সময়ে আয় করছেন বাড়তি টাকা। চাহিদা অনুসারে প্রতিটি ঘুড়ি বিক্রি হচ্ছে ১০০ থেকে ৩০০০ টাকা। এ প্রসঙ্গে বায়রা গ্রামের ঘুড়ি কারিগড় কালিপদ কবিরাজ বলেন, ‘আমি ছোট বেলা থেকেই ঘুড়ি তৈরি করতাম নিজে উড়ানোর জন্য। আগে ঘুড়ি উড়ানো ও ঘুড়ি উৎসব হতো। কিন্তু এখন আর আগের মত এই ঘুড়ি উৎসব হয় না। করোনার কারণে মানুষ অবসর সময় কাটানোর জন্য সকল শ্রেণী পেশার মানুষ ঘুড়ি উৎসবে মেতেছেন। মানিকগঞ্জ, সিংগাইর, সাভার, কালিয়াকৈর, বায়রা, চারাভাঙ্গা, সানাইল, গ্রামের মানুষ আমার কাছে আসে ঘুড়ি ক্রয় করার জন্য।’ তিনি আরও বলেন, ‘ঘুড়ি বিক্রি করে আমার ১৫০০০ টাকা আয় হয়েছে।ঘুড়ির প্রতি যুবক শ্রেণীর মধ্যে বেশি আগ্রহ। ঘুড়ি উড়ানোর মধ্য দিয়ে যুব সমাজের মধ্য আমি এক ধরনের পরিবর্তন লক্ষ্য করেছি যে যুব সমাজ আমরা প্রত্যাশা করি। এই ঘুড়ি উৎসবে সবাই আনন্দ উপভোগ করবো এবং সতর্কতা অবলম্বন করতে হবে যেন কেউ কোন দুর্ঘটনার শিকার না হয়।
অন্যদিকে ব্রী কালিয়াকৈর নয়াপাড়া কৃষক সংগঠনের সভাপতি মো. হযরত আলী বলেন, ‘আমি একজন ঘুড়ি প্রেমিক মানুষ। ছোটবেলা থেকেই ঘুড়ি তৈরি করি। ঘুড়ি মেলা আয়োজনে মানিকগঞ্জের আগে থেকেই অনেক সুনাম ছিল। মানিকগঞ্জের গড়পাড়া ইউনিয়নের চান্দোহর, শিবালয়, ঘুড়ির মেলার জন্য প্রসিদ্ধ ছিল। তাছাড়া, সিংগাইর উপজেলার বলধারা ইউনিয়নের বড়কালিয়াকৈর, পারিল নওয়াধা গ্রামে নতুন করে মেতে উঠেছে ঘুড়ি মেলায়। আগে ঘুড়ি তৈরি করতে আমরা ব্যবহার করতাম বাঁশ, কাগজ, বউলা গোটা, গাবের আঠা। কিন্তু ঘুড়ি প্রচলন কমে যাওয়ায় এগুলো এখন আর পাওয়া যায় না ‘ তিনি আরও বলেন, ‘বাজার থেকে পলিথিন কিনে আনতে হয় যা পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। ঘুড়ির সংষ্কৃতি টিকিয়ে রাখতে ঘুড়ি তৈরির প্রাকৃতিক যে উপকরণ তা টিকিয়ে রাখতে হবে। ঘুড়ির সাথে প্রাকৃতিক পরিবেশের একটি সম্পর্ক আছে। ঘুড়ি উড়াতে আকাশে বাতাশ থাকতে হয়। সমাজকর্মী মো. নজরুল ইসলাম বলেন, ‘বাংলার ঋতু বৈচিত্রের পরিবর্তনের ছোঁয়া লেগেছে। আমাদের সাহিত্য ও সংস্কৃতিও পরিবর্তন হচ্ছে। সুতরাং আমাদের আজ উচিত হাজার বছরের সেই গৌরবকে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা করা। আমরা যদি আমাদের এসব গ্রামীণ উৎসব বা সংস্কৃতি রক্ষা করতে পারি তাহলে প্রাণ ফিরে পাবে আমাদের এই লোকজ সংস্কৃতি।