জলবায়ু পরিবর্তন ও উষ্ণ পৃথিবীতে কার্বন ব্যবসা
ঢাকা থেকে এবিএম তৌহিদুল আলম
বাংলাদেশের ষড়ঋতুতে বিগত কয়েক দশকে অস্বাভাবিকতা এসেছে, হারিয়েছে ঋতুবৈচিত্র্য। বয়োজ্যেষ্ঠরা হতাশার সুরে বলছেন, এবার তেমন করে শীত পড়ল না কিংবা এবারের মতো গরম আর কোনো দিন পড়েনি। এই পরিবর্তনের কারণ একটিই আর তা হলো প্রকৃতিকে ধ্বংস করে ফেলছে কিছু মানুষ। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির দোহাই দিয়ে উন্নয়নের নামে বিশ্বকে দ্রুতই বসবাসের অযোগ্য করে ফেলা হচ্ছে। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গ্রিনহাউস গ্যাসের পরিমাণ বাড়ছে। ফলে সৃষ্টি হয়েছে জলবায়ু পরিবর্তনের। এর জন্য একতরফাভাবে দায়ী শিল্পোন্নত বলে পরিচিত ধনী দেশগুলো। পৃথিবীকে পঙ্গু করে ফেলার সর্বনাশা পদক্ষেপগুলো থেকে সরে না এসে তারা এখন এই ভূ-উষ্ণায়নকেও ব্যবসার হাতিয়ার করে তুলছে। কার্বন ট্রেড বা কার্বন বিক্রি এ রকম নানা মোড়কে পৃথিবীর উষ্ণায়নকে ঘিরে শুরু হয়েছে আন্তর্জাতিক পাঁয়তারা।
ভূ-উষ্ণায়ন: বৈজ্ঞানিক তথ্যে হেরফের
গ্লোবাল ওয়ার্মিং বা ভূ-উষ্ণায়ন হলো পৃথিবীর বায়ু ও সমুদ্রের গড় তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি। একদল বিজ্ঞানী বলছেন ১৮৮০ সাল থেকে ১৯৮৬ সালের মধ্যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ০.৬ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে। আর ২০৩০ সালের মধ্যে পৃথিবীর ঊষ্ণতা ২.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং ২০৫০ সাল নাগাদ ৩.৮ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়ে যেতে পারে। অন্যদিকে জলবায়ু পরিবর্তন শীর্ষক আন্ত: সরকার প্যানেল (ইন্টার-গভর্ণমেন্টাল প্যানেল অন ক্লাইমেট চেঞ্জ-আইপিসিসি) প্রকাশিত ২০১৪ সালের সর্বশেষ প্রতিবেদনে জানাচ্ছে, গত একশো বছরে সারা বিশ্বে গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ০.৭৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই অবস্থা চলতে থাকলে আগামী শতকে বিশ্বের গড় তাপমাত্রা বাড়বে ৬ থেকে ৭ ডিগ্রি সেলসিয়াস। তারা এটাও জানিয়েছে, বাংলাদেশের গড় তাপমাত্রা বেড়েছে ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস। এই বৈজ্ঞানিক রিপোর্টে দেখানো হয়েছে উন্নত দেশগুলো সচেতন হলে আগামী শতকে তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের বেশি বাড়বে না। এই তাপমাত্রা বৃদ্ধির অধিকাংশই হয়েছে পরিবেশের ওপর মানুষের মাত্রাহীন অত্যাচারের ফলে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞান গবেষণা পত্রিকা ‘সাইন্স’ ৯২৮টি আলাদা গবেষণার ফলাফল বিশ্লেষণ করে ২০০৪ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশিত একটি সমীক্ষা প্রতিবেদনে দেখায় যে, ৭৫ শতাংশ গবেষণায় সরাসরি পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধির জন্য মানুষের আচরণই দায়ী।
বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড গ্যাসের পরিমাণ বাড়লে যে বায়ুমণ্ডলের তাপমাত্রাও বাড়ে ১৮২৪ সালে বিষয়টি প্রথম বর্ণনা করেন জোসেফ ফুরিয়ার। এ সম্পর্কে ১৮৯৬ সালে প্রথম তথ্যানুসন্ধান করেন সুইডিশ রসায়নবিদ আরহেনিয়াস। তিনি দেখান যে, জীবাশ্ম জ্বালানি পোড়ানো, জঙ্গল সাফ করা, কৃষিকাজসহ বিভিন্ন কারণে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ বাড়ে। এ আবিষ্কারের শতবর্ষপূর্তির ঠিক পরপরই ১৯৯৭ সালে পৃথিবীজুড়ে ভূ-উষ্ণতা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
আন্তর্জাতিক চুক্তির মাধ্যমে পৃথিবীর স্বাভাবিক তাপমাত্রা ঠিক করা হয়েছে ৬১ দশমিক ৭ ডিগ্রি ফারেনহাইট, যা ১৯৬১ থেকে ১৯৯০ সাল পর্যন্ত পৃথিবীর তাপমাত্রার গড়। ১৯৯৭ সালে পৃথিবীর তাপমাত্রা ছিল গত শতাব্দীর গড় তাপমাত্রার চেয়ে ১ ডিগ্রি বেশি। নাসার জলবায়ুবিদরা বলেছেন, শতাব্দীর মধ্যে উষ্ণতম বছর ছিল ২০০৫। এরপর উষ্ণতম বছর ছিল যথাক্রমে ১৯৯৮, ২০০২, ২০০৩, ২০০৪ সাল। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে গড় গাঢ়ত্ব ১৯৯০ সালে ছিল ৩৫৩ পিপিএমভি (চধৎঃ ঢ়বৎ গরষষরড়হ নু ঠড়ষঁসব) এবং প্রতিবছর তা গড় ১.৮ পিপিএমভি বাড়ছে। বায়ুমণ্ডলে কার্বন ডাই-অক্সাইডের গাঢ়ত্ব ১৯৫৮ সাল থেকে নথিভুক্ত করা হয়েছে। ১৯৫৮ সালে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের গাঢ়ত্ব ছিল ৩১৫ পিপিএমভি। তখন প্রতিবছর বৃদ্ধির হার ছিল ০.৬ পিপিএমভি। গ্রীনল্যান্ড ও দক্ষিণ মেরুর বরফের মধ্যে আবদ্ধ বুদবুদ বাতাসের রাসায়নিক পরীক্ষার মাধ্যমে শিল্পবিপ্লবের আগে বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইডের পরিমাণ নিরূপণ করা হয়েছে। এ সমীক্ষা থেকে দেখা গেছে, ১০০০ থেকে ১৮০০ সাল পর্যন্ত গড় কার্বন ডাই-অক্সাইডের গাঢ়ত্ব ছিল মাত্র ২৮০ পিপিএমভি।
জলবায়ু পরিবতন ও গ্রীনহাউস এফেক্ট
সূর্য থেকে বিকিরিত শক্তি পৃথিবীর পৃষ্ঠে এসে পড়ে। ফলে পৃথিবী গরম হয়। পৃথিবী থেকে তাপশক্তি আবার মহাকাশে বিকিরিত হয়। কিন্তু শক্তি যখন সূর্য থেকে এসে পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলে প্রবেশ করে, তখন ওই শক্তির তরঙ্গ দৈর্ঘ্য ছোট থাকে। এগুলো সূর্য থেকে মহাকাশের মধ্য দিয়ে আসা বিকিরিত রশ্মি। পৃথিবীর বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে তা চলে আসে পৃথিবীপৃষ্ঠে। ফলে পৃথিবীপৃষ্ঠ গরম হয়ে ওঠে। এরপর পৃথিবী তাপ ছাড়ে। কিন্তু পৃথিবী যে তাপ ছাড়ে, সেই বিকিরণের তরঙ্গ দৈর্ঘ্য বড়। এই বড় তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বায়ুমণ্ডলের মধ্য দিয়ে ভেদ্যতা অনেক কম। ফলে এর সবটাই বায়ুমণ্ডল ছেড়ে বেরোতে পারে না। বায়ুমণ্ডলে উপস্থিত গ্রিনহাউস গ্যাসগুলো দীর্ঘ তরঙ্গ দৈর্ঘ্যের বিকিরণকে ধরে রাখে। এই গ্রিনহাউস গ্যাসগুলোই পৃথিবীকে গরম রাখার কাজটি করে। শীতকালীন দেশে কাঁচের ঘরে বা গ্রিনহাউসে গাছপালা রাখা হয়। সেখানেও এই একই নিয়ম কাজ করে। তাই এ ঘটনাকে বলা হয়, ‘গ্রীনহাউস এফেক্ট’। গ্রীনহাউস এফেক্ট ছাড়া পৃথিবীতে জীবজগতের অস্তিত্বই সম্ভব হতো না। বায়ুমণ্ডল এ ক্ষেত্রে একটি চাদরের কাজ করে। প্রাকৃতিক গ্রীনহাউস এফেক্টের এই চাদর ছাড়া পৃথিবীর তাপমাত্রা হতো বায়ুমণ্ডলহীন চাঁদের মতো। দিনের বেলা ২২৫ ডিগ্রি ফারেনহাইট এবং রাতের বেলা ঋণাত্মক ২৪৩ ডিগ্রি ফারেনহাইটের মধ্যে। এ তাপমাত্রা জীবজগতের পক্ষে সহায়ক নয়, কিন্তু সমস্যা তৈরি হয় বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসগুলোর গাঢ়ত্ব বাড়লে। তখন তাপমাত্রাও বাড়তে শুরু করে, যা নানাভাবে পরিবেশ ও জীবজগতের ক্ষতি করে।
ভূ-উষ্ণায়ন: দায়ী কে ?
আজ থেকে প্রায় একশত বছর আগে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর ১৯২৪ সালে চীন ভ্রমণের সময় এক বক্তৃতায় বলেছিলেন, “শতাব্দীর অধিক সময় ধরে আমরা সমৃদ্ধির আবর্জনার দ্বারা তাড়িত হচ্ছি, ধূলিকণার দ্বারা রুদ্ধ হচ্ছে আমাদের নিঃশ্বাস, শব্দদূষণে হয়েছি বধির, অসহায়তার কাছে মেনেছি হার। আমরা সহমতে পৌঁছেছি এই বহমান রথের অন্য নাম সমৃদ্ধি। অগ্রগতির অন্য নাম সভ্যতা। কিন্তু কেউ যদি প্রশ্ন করে ’কিসের জন্য’, ‘কাদের জন্য’ এই অগ্রযাত্রা”?
রবীন্দ্র্রনাথ যে অগ্রগতির উল্লেখ এখানে করেছেন তা পৃথিবীর ধনী দেশগুলোর সভ্যতার অগ্রগতি। আর আজ ভূ-উষ্ণায়নের জন্য দায়ী মূলত এ দেশগুলো। কেননা ইতিহাসজুড়ে মানবজাতি যত গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গত করেছে তার প্রায় সবটাই করেছে বিশ্বের ধনী দেশগুলো। এরা হলো বিশ্বের উত্তরের দেশ। দক্ষিণের দেশগুলোর তুলনায় এ দেশগুলোর জলবায়ু ঠাণ্ডা, তাদের এলাকাগুলোতে বিশ্ব উষ্ণায়নের পরিবেশগত প্রভাব কম পড়বে, আর যেটুকু পড়বে সেটুকু মোকাবিলা করতে তাদের দেশের মানুষজন সক্ষম এটাও প্রমাণ করা সহজ। বন্যা, খরা, সাইক্লোন, ঝড় এগুলো হলো প্রাকৃতিক ঘটনা যেগুলো প্রাকৃতিক বিপর্যয় ঘটাতে পারে। সব প্রাকৃতিক ঘটনাবলির মধ্যে এগুলোকে একটি বিশেষ বিভাগে ফেলা হয়, যার নাম ‘চরম আবহাওয়ার ঘটনাবলী’ যার প্রভাবে নব্বইয়ের দশকে ৯০ শতাংশ মৃত্যু হয়। আর বাকি ১০ শতাংশ মৃত্যুর জন্য দায়ী ছিল আগ্নেয়গিরির অগ্ন্যুৎপাত ও অতিগ্রীষ্ম বা অতি শীতলতা। কিন্তু দুঃখের বিষয় এই মৃত্যুগুলোর ৯৭ শতাংশই ঘটেছে গরিব দেশগুলোয়। এই একপেশে মৃত্যুহারের কারণ হলো সম্পদের অসম বণ্টন। আর সম্পদের এই অসম বণ্টনের জন্য দায়ী ঔপনিবেশিক শোষণ। বিশ্ব জনসংখ্যার ১৫ শতাংশ মানুষ ধনী দেশগুলোতে বসবাস করে এবং বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায় ৫০ শতাংশ। বিশ্ব জনসংখ্যার ৫ শতাংশ মানুষ আমেরিকায় বাস করে আর বাতাসে কার্বন ডাই-অক্সাইড ছড়ায় ২৩ শতাংশ। অন্যদিকে ১৭ শতাংশ মানুষের দেশ ভারত ছড়ায় মাত্র ৪ শতাংশ কার্বন ডাই-অক্সাইড। অথচ আমেরিকা ক্রমাগত প্রচার চালিয়ে যাচ্ছে, সর্বাধিক জনসংখ্যার দেশ চীন ও ভারত বেশি বেশি করে বাতাস দূষিত করছে। কারণ এরা প্রচুর কয়লা ব্যবহার করে। অথচ বাস্তবে তা যে সত্যি নয় ওপরের তথ্যগুলোই সেটা প্রমাণ করে দেয়। ক্রমবর্ধমান পরিবেশ দূষণের ফলে সমগ্র বিশ্বের অধিকাংশ গ্রামাঞ্চলের মানুষ যারা জীবনে গাড়িতে চড়েনি, রেলে চাপেনি, রেডিও শোনেনি, টিভি দেখেনি, শীতাতপ নিয়ন্ত্রিত যন্ত্রের আরাম ভোগ করেনি, সেই সব কোটি কোটি নিরীহ অসহায় মানুষ গ্রীনহাউস এফেক্টের শিকার হচ্ছে বেশি।
কিয়োটো প্রটোকল
১৯৯৭ সালে কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষরের পর একই বছর বিশ্বে কার্বন ট্রেডিং বা কার্বন বাণিজ্য ধারণার সূত্রপাত হয়। কিয়োটো প্রোটোকল ২০০৫ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে কার্যকরী হয়। কিয়োটো প্রটোকলের ১৭ নম্বর অনুচ্ছেদে কার্বন ট্রেডিং এর নিয়মনীতি বিষয়ে উল্লেখ রয়েছে। কিয়োটো প্রটোকলই গ্রিনহাউস গ্যাস নির্গমন বন্ধ করার উদ্দেশ্যে সবচেয়ে বড় আন্তর্জাতিক উদ্যোগ। কিয়োটো প্রটোকলে কার্বন ডাই-অক্সাইড, নাইট্রাস অক্সাইড, সালফার, হেক্সাফ্লোরাইড, হাইড্রোফ্লুরোকার্বন, কপারফ্লুরোকার্বন স্যালিকে প্রধান গ্রীনহাউস গ্যাস বলে বর্ণনা করা হয়েছে। এতে গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গমনের হার কমানোর সবচেয়ে দক্ষ উপায় হিসেবে একটি বাজারভিত্তিক ব্যবস্থার কথা বলা হয়েছে, যেটিকে সাধারণত এমিশন ট্রেডিং বা কার্বন ট্রেডিং বলা হয়।
কার্বন ট্রেডিং বা কার্বন ব্যবসা
কিয়োটো প্রটোকলেএকটি নতুন নিয়ম চালু করা যাতে বলা হয় এর ফলে শিল্পের অগ্রগতি রোধ হবে না আবার কার্বন ডাই-অক্সাইডের মতো গ্রীনহাউস গ্যাসগুলোর নির্গমনও নিয়ন্ত্রিত হবে। যেসব দেশ কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর করেছে জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলন (ইউএনএফসিসি) তাদের বাৎসরিক কার্বন নিঃসরণের পরিমাণ নির্ধারণ করে দিয়েছে। কোনো সদস্য তার নির্ধারিত অংশের বেশি কার্বন নিঃসরণ করলে তা হবে চুক্তির লঙ্ঘন। তবে কেউ তার বরাদ্দ অংশের চেয়ে কম খরচ করলে অতিরিক্ত অংশ কার্বন ট্রেডিংয়ের মাধ্যমে বিক্রি করতে পারবে। যেহেতু প্রতিটি দেশের জন্য কার্বন নিঃসরণ একটি সীমার মধ্যে বেঁধে দেয়া হয়েছে, তাই যে দেশ সীমার চেয়ে কম কার্বন নিঃসরণ করবে, সেই অনুপাতে তার নামে কার্বন ক্রেডিট জমা হবে। এই ক্রেডিট সে বিশ্ববাজারে বিক্রি করতে পারবে। কারা কিনবে এই ক্রেডিট? যারা নিজের সীমার চেয়ে বেশি পরিমাণ কার্বন ছড়াতে চায় তারা। সোজা ভাবে একেই বলা হয় কার্বন ট্রেডিং বা কার্বন বাণিজ্য।
কিয়োটোবিধি কোনো দেশ কতটা পরিমাণ গ্রীণহাউস গ্যাস নির্গমন করতে পারবে, তার ঊর্ধ্বসীমা বা কোটা নির্ধারণ করে দিয়েছে। এনেক্্র এক নম্বর তালিকাভূক্ত ধনী দেশ নিজেদের কোটা নির্দিষ্ট করার পর নিজের দেশের বিভিন্ন শিল্প সংস্থার জন্য আলাদা করে গ্রীণহাউস গ্যাস নির্গমনের কোটা স্থির করে দিয়েছে। কিন্তু অধিকাংশ শিল্প সংস্থার পক্ষে তাদের বর্তমানে চালু উৎপাদন পদ্ধতি বজায় রেখে গ্রীণ হাউস গ্যাসের নির্গমন ও বেঁধে দেওয়া সীমার মধ্যে রাখা কার্যত অসম্ভব। বেঁধে দেওয়া সীমার বাইরে অতিরিক্ত গ্যাস নির্গমনের অধিকার তাদের নেই; কিন্তু তারা যদি কোনোভাবে সে অধিকার অর্জন করে নিতে পারে, তবে তারা এ ঊর্ধ্বসীমার বাধ্যবাধকতা থেকে মুক্ত হতে পারে। আর ঠিক এখানেই কার্বন সঞ্চয়ের ভূমিকা। কার্বন সঞ্চয় আসলে বাড়তি গ্যাস নির্গমনের অধিকার অর্জনের সমতুল্য। এ সঞ্চয়ের কোটায় পরিবর্তন করা যায়। সংস্থাগুলো এখন এভাবে বাড়তি কোটা কিনতে পারে। যারা কোটার চেয়ে কম গ্যাস নির্গমন করে তারা এদের কাছ থেকে কার্বন কিনে নিতে পারে। অর্থাৎ স্বল্পোন্নত দেশগুলোই এ সংস্থাগুলোর প্রধান ক্লায়েন্ট। যার ফলে ব্যবসায়িক ক্ষতি না করে এবং পরিবেশ ধ্বংস বন্ধ করার প্রচেষ্টা না করেই তার কার্যকলাপ চালাতে পারবে।
কার্বন ব্যবসার মাধ্যমে পৃথিবীর কোনো একটি অঞ্চল বায়ুমণ্ডলে গ্রীনহাউস গ্যাসের এক টন জোগানের পাশাপাশি যদি পৃথিবীর অন্য একটি অঞ্চল থেকে ঠিক এক টন সরিয়ে নেয় এবং এর এই দুই প্রকল্প যদি ওই দুই অঞ্চলে একসঙ্গে চালু থাকে, তবে তার অন্য বায়ুমণ্ডলে কোনো গ্রীনহাউস গ্যাস নির্গত হবে না। ধরুন, আপনার একটি কোম্পানি আছে, যেটি বছরে ২০০ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ করবে। কিন্তু সরকার আপনাকে ১০০ মেট্রিক টনের অনুমোদন দিয়েছেন। এখন আপনি দেশের কোথাও কিছু গাছ লাগালেন যেগুলো বছরে ১০০ মেট্রিক টন কার্বন শোষণ করতে পারবে। এরপর কার্বন ট্রেডারকে আপনি দেখাবেন যে, আপনি সরাসরি ২০০ মেট্রিক টন কার্বন নিঃসরণ করছেন ঠিকই তবে তার থেকে ১০০ মেট্রিক টন আপনার নির্ধারিত গাছ শোষণ করে নিয়েছে। অতএব, আপনি দাবি করতে পারেন যে, আপনি সরকার নির্ধারিত মাত্রা অতিক্রম করেননি। কিন্ত বিষয়টা কি এতটাই সাধারণ?
বৈশ্বিক এই কার্বন কেনাবেচার বাজারে বর্তমানে দুটি বিনিময় সংস্থা আছে। একটি হলো মার্কিন কেন্দ্রিক, যা শিকাগো ক্লাইমেট পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। অন্যটি ইউরোপ কেন্দ্রিক, এটি ইউরোপিয়ান ক্লাইমেট বিনিময় পদ্ধতি হিসেবে পরিচিত। জাতিসংঘ এবং বিশ্বব্যাংকের হিসাব মতে কার্বন ব্যবসায় ২০০৫ সালে ৩৭৪ মেট্রিক টন সমপরিমাণ কার্বনের ট্রেডিং হয়েছে যার বাজার মূল্য ২০০৫ সালে ছিল ১১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অন্যদিকে ২০০৬ সালের প্রথম ৯ মাসেই ২২ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের কার্বন ট্রেডিং হয়েছে। ২০০৬ সালে প্রতি টন কার্বনের দাম ছিল ৫ থেকে ১৬ মার্কিন ডলার অথবা ৪ থেকে ১১ ইউরো। পৃথিবীর অনেক দেশ কিয়োটো প্রটোকল স্বাক্ষর না করেও কার্বন-ট্রেডিং পদ্ধতি তাদের দেশে অনুসরণ করছে। এশিয়ার দেশ জাপান ২০১০ সালে কার্বন-ট্রেডিং পদ্ধতি চালু করেছে। বাংলাদেশে আছে বিশ্বের অন্যতম বড় ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবন, যার কার্বন শোষণের ক্ষমতা অনেক বেশি। ইতোমধ্যে বাংলাদেশ সরকার সুন্দরবন ছাড়াও আরো ১১টি বনকে কার্বন ট্রেডিংয়ের আওতায় নিয়ে আসার চিন্তাভাবনা করছে।
সম্মেলনের পর সম্মেলন, কিন্তু সবই নিষ্ফল পরিণতি
১৯৯২ সালে বিশ্বের প্রতিটি দেশ মেনে নেয় যে পৃথিবীর গড় তাপমাত্রা বাড়ছে। আর সেই প্রেক্ষিতে একই বছর জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সনদ প্রণীত হয় নিউইয়র্কে। ওই বছর জুনে রিও ধরিত্রী সম্মেলনেও একটি সনদ স্বাক্ষরিত হয়। ১৯৯৫ সালে বার্লিনে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলন (ঘের জলবায়ু বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলন (ইউএনএফসিসি) ইউএনএফসিসি) থেকে ২০১৯ সালে মাদ্রিদ সম্মেলন পর্যন্ত মোট ২৭টি বার্ষিক সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়েছে। ১৯৯৭ সালের কিয়োটো প্রটোকলের পর ২০০৭ সালে অনুষ্ঠিত ১৩ তম সম্মেলনে প্রণীত হয় বালি রোডম্যাপ। অংশগ্রহণকারী সকল দেশে সম্মত ছিল যে ২০০৯ সালে কোপেনহেগেনে অনুষ্ঠিত বার্ষিক সম্মেলনে কিয়োটো চুক্তির দ্বিতীয় অঙ্গীকার কাল স্থির হবে। বৈশ্বিক কার্বন নিঃসরণের রাশ টানা হবে। দ্রুত কমানো হবে কার্বন নিঃসরণের মাত্রা। জাতিসংঘ জলবায়ু সনদের কার্যকর বাস্তবায়নের আশু ব্যবস্থা নেওয়া হবে। কিন্তু অনেক রাষ্ট্রনায়কের সরব উপস্থিতি সত্ত্বেও শেষ মুহূর্তে কোপেনহেগেন সম্মেলন ভেস্তে যায়। ২০১০ সালের কানকুন সমঝোতায় ঠিক হয় ১৮ তম সম্মেলনে যা ২০১১ সালে ডারবানেঅনুষ্ঠিত হবে সেখানে কিয়োটো চুক্তির দ্বিতীয় অঙ্গীকারগুলো ঠিক হবে। ডারবান সম্মেলনে কিয়োটো চুক্তির দ্বিতীয় অঙ্গীকারগুলো নির্ধারিত হলেও যুক্তরাষ্ট্র তা মানেনি। এছাড়াও জাপান, কানাডা ও রাশিয়া এই অঙ্গীকারকালের সঙ্গে সম্পৃক্ত হয়নি। সর্বোপরি কিয়োটো প্রটোকল তো কার্বন নিঃসরণে খুব কার্যকর ভূমিকাই রাখতে পারেনি। শুধু তাই নয় ২০১২ সালে অনুষ্ঠিত সর্বশেষ রিও+২০ ধরিত্রী সম্মেলনে কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমন কমাতে এবং অর্থনৈতিক উন্নয়নের লক্ষ্যে অত্যধিক কার্বন ডাই-অক্সাইড নির্গমনের জন্য দায়ী শিল্পোন্নত এবং অর্থনৈতিকভাবে শক্তিশালী দেশগুলোর জীবাশ্ম জ্বালানির ওপর ভর্তুকি বন্ধ করার সুপারিশ আমলেই আনা হয়নি। জাতিসংঘের জলবায়ু বিষয়ক বার্ষিক সম্মেলন ইউএনএফসিসি’র ২২ তম সম্মেলনের মাধ্যমে ২০১৫ সালে বিশ্ব প্যারিস এগ্রিমেন্ট তৈরি করে এবং পৃথিবী সম্মত হয়েছিল যে পৃথিবীর তাপমাত্রা ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস এর বেশি বাড়তে দেওয়া যাবে না। তখনই বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীসহ অন্যান্য দরিদ্র দেশগুলি ১.৫ ডিগ্রি সেলসিয়াসের মধ্যে রাখার প্রস্তাব করেছিল। বিশ্বনেতৃবৃন্দ জলবায়ু সুরক্ষায় ২০১৫ সালের প্যারিস চুক্তির বিষয়ে ঐকমত্যে পৌঁছানোর পরও কার্বন নিঃসরণের মাত্রা কমানোর ব্যাপারে কোনো দেশই পর্যাপ্ত কর্মসূচি গ্রহণ করেনি। জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলনে উন্নত দেশগুলো বায়ুমন্ডলের কার্বন নিঃসরণ কমানোর পাশাপাশি ঝুঁকিতে থাকা দেশগুলোকে মোটা অঙ্কের ক্ষতিপূরণ দেওয়ার অঙ্গীকার করলেও আজও তা বাস্তবে রূপায়িত হয়নি। জলবায়ু পরিবর্তন ইস্যুতে অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণ বন্ধে এবং ক্ষতিগ্রস্ত দেশগুলোকে আর্থিক সহায়তা দিতে অর্থ বরাদ্দে আজও তেমন সাফল্য অর্জিত হয়নি। আইনি কাঠামো বাস্তবায়নে তেমন কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের মধ্যে আসেনি অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণকারী দেশগুলো। জলবায়ু পরিবর্তনের সঙ্গে খাপখাইয়ে নিতে ঝুঁকিপ্রবণ দেশগুলোকে সাহায্য প্রদান এবং জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যা লাঘবে অধিকমাত্রায় গ্রীনহাউস গ্যাস নিঃসরণকারী ও উন্নত দেশগুলোকে অভিযোজন কার্যক্রমে জোরালোভাবে এগিয়ে আসার আহ্বান কার্যকর হয়নি। অন্যদিকে কার্বন নিঃসরণ কমানোর লক্ষ্যে প্রশমণ, অভিযোজন, প্রযুক্তি হস্তান্তর, জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব কমিয়ে আনা এবং পরিবর্তনজনিত প্রভাব মোকাবিলায় নানা প্রকল্প ও ক্ষতিগ্রস্তদের ক্ষতিপূরণসহ বিভিন্ন ইস্যুতে পদক্ষেপ গ্রহণের জন্যই ২০১০ কানকুন সম্মেলনে আনুষ্ঠানিক ভাবে যাত্রা শুরু করা গ্রীনক্লাইমেট ফান্ড (জিসিএফ)। তবে এখনো আশানুরূপ তহবিল জোগাড় করতে সক্ষম হয়নি জিসিএফ। অন্যদিকে ২০১৯ সালে ইউএনএফসিসি’র সাবসিডিয়ারী বডি জার্মানীর বন শহরে একত্রিত হয়ে প্যারিসএগ্রিমেন্ট’র এজেন্ডা নির্ধারণ করেন যা ২০২১ ডিসেম্বরে গ্লাসগোতে অনুষ্ঠিতব্য ইউএনএফসিসি’র ২৮তম সম্মেলনে রুলস ও রেগুলেশন তৈরি এবং লিগ্যাল বাইন্ডিং নির্ধারণ করার কথা ছিল।
প্রকৃত অর্থে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর জাতিসংঘ যুদ্ধের বিরুদ্ধে, শান্তির পক্ষে, পরিবেশ দূষণের বিরুদ্ধে অনেক কনফারেন্স করেছে। ভালো ভালো সিদ্ধান্ত নিয়েছে; কিন্তু বাস্তবে তা অনুসরণ করা হয়নি এবং ভবিষ্যতেও যে হবে সে রকম সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না। কারণ পৃথিবীর পরাশক্তি দেশগুলি তা করতে দেবে না। কারণ এসব দেশের কাছে যুদ্ধ একটা শিল্প, যা দিয়ে তারা মানুষ হত্যা করে। আর তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোকে অর্থনৈতিক, রাজনৈতিক ও সামাজিক কোনো ক্ষেত্রেই মাথা তুলে দাঁড়াতে দেয় না।
বাংলাদেশের জন্য অশনি সংকেত
জলবায়ুর পরিবর্তনের কারণে বাংলাদেশে কখনো খরায় মাঠঘাট, ক্ষেতের ফসল পুড়ে ছারখার হয়ে যায়, কখনোবা অতিরিক্ত জোয়ার এবং জলোচ্ছ্বাসে লবণাক্ত পানি ভূখন্ডে ঢুকে কৃষি জমির উৎপাদন ক্ষমতা কমিয়ে দেয়। ঋতুচক্রের অস্বাভাবিক পরিবর্তনে বিনষ্ট হয়ে যাচ্ছে শ্যামল বৃক্ষরাজি, পশুপাখি। জীবজগতে পড়ছে এর নেতিবাচক প্রভাব। শুকিয়ে যাচ্ছে হাওর, বিল, খাল। জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে গেল ৫০ বা ১০০ বছরের পরিসংখ্যান বিবেচনায় আগামীতে বাংলাদেশে ব্যাপক অতিবৃষ্টি, অনাবৃষ্টি, অসময়ে প্রবল বন্যা, মরুময়তা, ঘূর্ণিঝড়, নিম্নচাপ, খরার মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগের সম্ভাবনা রয়েছে।
১৯৯৭ থেকে ২০১৬ বিগত ১৯ বছরে বিশ্বের ২০০দেশের জলবায়ু পরিবর্তন প্রভাবজনিত দুর্যোগের সংখ্যা, মৃত্যু, অন্যান্য ক্ষয়ক্ষতির হিসাবের ভিত্তিতে জার্মানভিত্তিক আন্তর্জাতিক সংস্থা জার্মান ওয়াচ ‘বৈশ্বিক জলবায়ু ঝুঁকি সূচক-২০১৮’ শীর্ষক প্রতিবেদনে ঝুঁকিপূর্ণ দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ষষ্ঠ। এর আগে জার্মান ওয়াচ এবং যুক্তরাষ্ট্রের ম্যাপল ক্রফট নামক গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মতে, প্রাকৃতিক দুর্যোগ-দুর্বিপাক ও জলবায়ু পরিবর্তনজনিত কারণে বাংলাদেশ পৃথিবীর সবচেয়ে ঝুঁকিপূর্ণ দেশ।
২০১৪ সালে আইপিসিসি’র ৫ম প্রতিবেদনে বলা হয়েছে বর্তমানে বাংলাদেশের মতো মৌসুমি বায়ু প্রভাবিত এলাকায় বর্ষাকাল দীর্ঘায়িত হচ্ছে। অপরদিকে শুকনো মৌসুমে বৃষ্টি কমছে। তাই বদলে যাচ্ছে বৃষ্টিপাতের ধরন। অল্প সময়ে অতিবৃষ্টি তারপর দীর্ঘ সময় ধরে অনাবৃষ্টি প্রায়শই বাংলাদেশের কৃষি অর্থনীতিকে বিপর্যস্ত করে দিচ্ছে। তাই বাড়ছে বন্যা ও খরার প্রকোপ। উত্তাপ বাড়ার ফলে বাষ্পীভবন বাড়ে, কমে যায় ব্যবহারযোগ্য পানির পরিমাণ। এক কথায় বলা যায়, পানি চক্রের স্বাভাবিক ছন্দে বিঘœ ঘটছে। এটা শুধু কৃষি অর্থনীতিতেই নয়, আঘাত হানছে বাস্তুতন্ত্রেও।
ইউএনডিপির ২০০৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী বিশ্বজলবায়ু পরিবর্তনের জন্য বাংলাদেশ দায়ী নয়। ইউএনডিপির ২০০৪ সালের হিসাব অনুযায়ী গ্রীনহাউজ গ্যাস নির্গমনে বাংলাদেশের ভূমিকা মাত্র ০.১ শতাংশ এবং মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের পরিমাণ মাত্র ০.৩ টন যা কিয়োটো প্রটোকল নির্ধারিত নির্গমন মাত্রার চেয়েও কম। অন্যদিকে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের মাথাপিছু কার্বন নির্গমনের হার ১.৫ শতাংশ। ভূ-তাত্ত্বিক জরিপ অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে সমুদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা এক মিটার বাড়লে বাংলাদেশের ১৫ শতাংশ ভূ-ভাগ সমুদ্রের নিচে তলিয়ে যাবে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত আন্তঃসরকার প্যানেলের ২০০৭ সালের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বৈশ্বিক উষ্ণায়নের কারণে ১৯৯৩-২০০৩ সাল পর্যন্ত সমদ্রপৃষ্ঠের উচ্চতা প্রতিবছর গড়ে বাড়ছে প্রায় ৩.১ মিলিমিটার। ভবিষ্যতে এই উচ্চতা ৭ মিটার পর্যন্ত বাড়বে। এতে করে বাংলাদেশের ৭০ শতাংশ ভূ-ভাগ পানির নিচে তলিয়ে যাবে। গ্লোবাল ওয়ার্মিংয়ের কারণে বন্যা, ঝড় ইত্যাদি প্রাকৃতিক দুর্যোগের সংখ্যা ও তীব্রতা ইতোমধ্যেই বেড়েছে। ১৬ নভেম্বর ২০০৭ সালে বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বয়ে গেছে প্রচন্ড শক্তিধর ঘূর্ণিঝড় ‘সিডর’। নাসার বিজ্ঞানীদের মতে এটা ছিল চার মাত্রার ঘূর্ণিঝড়। বঙ্গোপসাগরে এ যাবৎকালে সৃষ্ট ঘূর্ণিঝড়গুলোর মধ্যে ‘সিডর’ ছিল সবচেয়ে তীব্রমাত্রার। এই ঘূর্ণিঝড় ১৯৭০ সালের ১২ নভেম্বর এবং ১৯৯১ সালের ২৯ এপ্রিলের ঘূর্ণিঝড়ের চেয়েও বেশি শক্তিমাত্রার ছিল। আবহাওয়াবিদরা বলেছেন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বঙ্গোপসাগরে প্রবল ঘূর্ণিঝড়ের সংখ্যা বেড়ে গেছে। সর্বশেষ ২০ মে ২০২০ তারিখে বাংলাদেশে সাইক্লোন ’আম্ফান’ আঘাত হানে।
বিলীন হবে সুন্দরবন !
তাপমাত্রা বৃদ্ধিও গ্রীনহাউস গ্যাসের প্রভাবে ইতোমধ্যে দেখা যাচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। ফলে ভারত ও বাংলাদেশের সমুদ্র্রসংলগ্ন সমগ্র সুন্দরবন অঞ্চলে ব্যাপক ভাঙন হচ্ছে। মূল সাগরদ্বীপের সাত হাজার ৫০০ একর জমি অনেক আগেই সাগরের বিলীন হয়েছে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সমুদ্রবিজ্ঞান বিভাগের প্রধান ড. সুগত হাজরা গবেষণা করে দেখেছেন, ১৯৬৫ সাল থেকে সাগরদ্বীপের পার্থিব, জৈবিক ও সামাজিক উপাদানগুলোর অনেক পরিবর্তন হয়েছে পরিবেশ দূষণের ফলে, ঝড়ের সংখ্যা ও ঝড়ের তীব্রতা অনেক গুণ বেড়েছে। বর্ষার বৃষ্টি শীতকালে হওয়ায় ফসল নষ্ট হচ্ছে। গ্রাম ভাসছে। তাঁর গবেষণায় দেখিয়েছেন সুন্দরবন সংলগ্ন জমিতে আগে ১১ ধরনের ধান চাষ হতো, এখন মাটিতে লবণের পরিমাণ বেড়ে যাওয়ায় এসব ধানের চাষ কমেছে। জমি অনাবাদি থেকে যাচ্ছে। অধ্যাপক হাজরার হিসাবে গত ৩০ বছরে সুন্দরবন অঞ্চলে এক হাজার ৬৩৪ বর্গকিলোমিটার জমি সমুদ্র গ্রাস করেছে, সেখানে নতুন চর জেগেছে ৮৬ বর্গকিলোমিটার। উপগ্রহের মাধ্যমে তোলা ছবি থেকে দেখা যাচ্ছে, পরিবেশ দূষণের ফলে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাবে গত ২০ বছরে সুন্দরবন অঞ্চলের সমুদ্রের জলস্তর বছরে গড়ে ৩.১৪ মিলিমিটার করে বাড়ছে, যেখানে সারা বিশ্বের বার্ষিক বৃদ্ধির গড় ২ মিলিমিটার। বিজ্ঞানীরা মনে করেন, সুন্দরবন অঞ্চলের জলস্তর ১০ সেন্টিমিটার বাড়লে ১৫ শতাংশ ভূমি ভেসে যাবে। ৪৫ সেন্টিমিটার বাড়লে স্থলভাগের ৭৫ শতাংশ ডুবে যাবে এবং সমপরিমাণ ম্যানগ্রোভ অরণ্য ধ্বংস হয়ে যাবে। প্লাবিত অঞ্চলের পানিও মাটিতে লবণের পরিমাণ বাড়বে, ফলে ৪২৫ প্রজাতির গাছপালা বিপন্ন হবে। ২৪৬ প্রজাতির বন্য প্রাণীর মধ্যে হরিণ, শুকর, বানব আর কুমিরের বংশ লোপ হওয়ার আশঙ্কা বেশি। ম্যানগ্রোভ অরণ্যের কোলে যে জলাভূমি, সামুদ্রিক মাছ ও প্রাণীদের আঁতুড়ঘর বলে পরিচিত জলাভূমির তাপমাত্রা বাড়ার কারণে তাদের বংশবিস্তার বিঘœ ঘটার সম্ভাবনা দেখা দেবে এবং খাদ্য শৃঙ্খলে বিঘœ দেখা দেবে।
উষ্ণ পৃথিবীতে কার্বন ব্যবসা: সমাধান নয়, এক নতুন ফন্দি!
আপাত চোখে মনে হয়, কার্বন ট্রেডের ধারণাটি একটি চমৎকার পদ্ধতি যার মাধ্যমে বিশ্বের মোট কার্বন নিঃসরণএকই রাখা যাবে। কিন্তু আসলে ব্যাপারটি তা নয়। অনেকেই অভিযোগ করেন,এটি আসলে উপনিবেশবাদেরএকটি নতুন ধারণা। আপাতদৃষ্টিতে স্বল্পোন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলো আর্থিকভাবে লাভবান হচ্ছে বলে মনে হলেও, অদূর ভবিষ্যতে এ দেশগুলোই ভবিষ্যতে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকিতে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এতে গরিব দেশগুলোয় শিল্পায়ন কম হবে, কারণ অতিরিক্ত কার্বন নিঃসরণের ব্যয় মোকাবিলায় গরিব দেশের শিল্পপ্রতিষ্ঠানগুলো ব্যর্থ হবে। অন্যদিকে এ চুক্তির ফলে উন্নত দেশগুলো অর্থের বিনিময়ে তাদের কার্বন নিঃসরণের বৈধতা পাচ্ছে। ফলে কার্বন নিঃসরণ তো কোনভাবেই কমছে না বরং ধনীদেশগুলো কার্বন ক্রেডিট কিনে নিয়ে দায়মুক্তি পাচ্ছে এবং অবাধে কার্বন নিঃসরণ করেই যাচ্ছে। ধনী দেশগুলো ক্রমাগত কার্বন নিঃসরণের লাইসেন্স কিনে তাদের উৎপাদনকে করে রাখবে একতরফা, আর সেই উৎপাদিত পণ্যসামগ্রী আবার বিক্রি করবে গরিব দেশগুলোতেই। অর্থাৎ গ্রীনহাউস গ্যাসের পরিমাণ যেভাবে বাড়ছিল সেভাবেই বাড়বে। কার্বন ট্রেড তাই সাময়িক সমাধান হলেও দীর্ঘ মেয়াদে পৃথিবীর উষ্ণতা বৃদ্ধি বন্ধ করার জন্য কার্যকর প্রযুক্তি আবিষ্কার করার বিকল্প নেই। কারণ ধরিত্রী এসব কার্বন ট্রেডের ছেলেখেলায় ভুলবে না। প্রকৃতি যদি প্রতিশোধ নেয়, তখন বিশ্বের কোনো দেশই সেখান থেকে মুক্ত হবে না। গরিব দেশগুলোকে হয়তো আগেই ভুগতে হবে, কিন্তু তথাকথিত উন্নত দেশগুলোও শেষ পর্যন্ত রক্ষা পাবে না। তাই কার্বন ট্রেডিং জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কোন ভালো উদ্যোগ নয় বরং এটি উন্নত বিশ্বের একটি সুপরিকল্পিত ফাঁদ।