শিক্ষার্থীদেরকে পড়াশোনার পাশাপাশি সবদিক থেকেই দক্ষ ও পারদর্শী হতে হবে
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
মো. আজহারুল হক তুহিন। পেশায় একজন শিক্ষক। লক্ষ্মীগঞ্জ ইউনিয়নের বিরামপুর গ্রামের হাজী ফয়েজ উদ্দিন আকন্দ উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক তিনি। এলাকার সকলের কাছে তুহিন স্যার নামে পরিচিত। তাঁর জন্ম হয় নেত্রকোণা জেলার চকপাড়া নামক গ্রামে। ১৯৯৪ সাল থেকে প্রতিষ্ঠাতা শিক্ষক হিসেবে এই শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি যুক্ত আছেন। তিনি তার শিক্ষা প্রতিষ্ঠানটি ৩৬ জন শিক্ষার্থী নিয়ে শুরু করেছিলেন। বর্তমানে এর শিক্ষার্থীর সংখ্যা ৯১৮ জন। তিনি তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ব্যতিক্রমী কিছু উদ্যোগের মাধ্যমে কার্যক্রম পরিচালনার জন্য এলাকায় বেশ আলোচিত ও প্রশংসিত হয়েছেন। তাঁর শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সর্বপ্রথম মেয়েদের খেলাধূলা (হ্যা-বল) চালু করে বেশ সমালোচিত হয়েছিলেন। কিন্তু এখন তার প্রতিষ্ঠানের মেয়েরাই সবদিকে যেমন, পরীক্ষার ফলাফল, সামাজিকতা, সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান ইত্যাদিতে এগিয়ে আছে।
স্কুলের পাঠ্যক্রমের পাশাপাশি শিক্ষার্থীদের সক্রিয় নাগরিক হিসেবে গড়ে তোলার জন্য তিনি নানানভাবে চেষ্টা করে যাচ্ছেন। তিনি বলেন, “আমার পরিবেশ, আমার স্কুল এবং আমার শিক্ষার্থীদের সত্যিকার উন্নয়ন করতে চাই আমি। শিক্ষার্থীরা যাতে পড়ালেখার পাশাপাশি নিজের পরিবার, পরিবেশ ও সমাজের জন্য কিছু করতে পারে।” তাঁর এই আকাঙ্খাকে রূপ দেওয়ার জন্য তিনি ইতিমধ্যে স্কুলের শিক্ষার্থীদের সাহায্যে নিজের বাড়ি, রাস্তা ও বাজারে পরিষ্কার পরিচ্ছন্নতা অভিযান পরিচালনা করেছেন। শিক্ষকেরাও হোম ভিজিটও করেছিল। এত বেশ সাড়া পাওয়া গেছে। আগামীতেও তিনি এ ধরণের কার্যক্রম পরিচালনা করবেন বলে জানান। তিনি দেখতে চান একজন শিক্ষার্থী শুধুমাত্র পড়ালেখাতেই দক্ষ হবে না, সে সকল দিকে পারদর্শী হবে। তিনি মনে করেন সামাজিক উন্নয়নের জন্য বাড়ি-ঘর, রাস্তা পরিষ্কার রাখা থেকে শুরু করে সরকারি সম্পদ নষ্ট না করা, স্কুল এবং বাড়িতে গর্ত করে ময়লা ফেলা, বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, নারী শিক্ষার প্রসার, ঝরে পড়া শিক্ষার্থীদের আবার স্কুলগামী করা, প্রত্যেকটা শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে জৈব সারে সবজি বাগান তৈরি, দেশীয় উপকরণ ব্যবহার ইত্যাদি বিষয়গুলোর দিকে নজর দেওয়া উচিত। কারণ মানুষ ইচ্ছা করলে এ কাজ সহজে করতে পারে।
তিনি জানান, একসময় প্রত্যেকের বাড়িতেই ছনের ঘর ছিল, স্যানিটেশন ব্যবস্থা ছিল না। মেয়েরা স্কুলে আসতো না। স্কুলের নির্দিষ্ট পোষাক ছিল না, জুতা পড়ে কেউ স্কুলে আসতো না। সামাজিক অবক্ষয়ও এতটা ছিল না। মাদকাসক্তের পরিমাণও কম ছিল। কিন্তু সময়ের পরিক্রমায় সবকিছু পবির্তন হয়েছে। মেয়েদের স্কুলে আসাকে যেমন এখন সবাই স্বাগত জানাচ্ছে অন্যদিকে সামাজিক সমস্যাগুলোও দিনকে দিন বেড়ে গেছে। এক্ষেত্রে স্কুল থেকেই যদি শিক্ষার্থীদের শেখানো হয় কীভাবে তারা সামাজিক ও পরিবেশ বিভিন্ন সমস্যা সমাধানে অবদান রাখবে কিংবা ব্যবহারিক অর্থে তাদেরকে দিয়ে স্কুল আঙিনা পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন রাখা, গাছ রোপণ এবং বাল্যবিবাহ, মাদকাসক্ত নিরসনে প্রচার-প্রচারণা চালানো যায় তাহলে এক পর্যায়ে তারা সক্রিয় ও সুনাগরিক হিসেবে গড়ে উঠবে।
তিনি জানান, আধুনিকতার একটা পার্শ্ব প্রতিক্রিয়া আছে। আধুনিকতার সংস্পর্শে সামাজিকতা নষ্ট হচ্ছে। আগে আমাদের দেশে বাজান, বুবু, বুয়াই, খালাজি, আম্মা কত নামে আমরা নিজের মানুষদের ডাকতাম। অনেক আপন মনে হতো, একটা আন্তরিকতাও ছিল। কিন্তু এখন যত দিন যাচ্ছে এই ডাকগুলো নেই বললেই চলে। সকলের ভিতর হিংসা, হানাহানি, জেদ ইত্যাদির মানসিকতা তৈরি হয়েছে। বর্তমানে দেশীয় খাবার কেউ খাইতে চায় না, পার্লারে সাজতে যায়। এতে করে আমাদের ঐতিহ্যবাহী যে খাবারগুলো ছিল সেগুলোর সংস্কৃতিও হারিয়ে যেতে বসেছে।
মো. আজহারুল হক তুহিন স্কুলের পাঠক্রমের পাশাপাশি আরও অনেক বিষয় পড়ানোর চিন্তাভাবনা করছেন। আগামী বছর থেকে তিনি মেয়েদের জন্য কৃষি বিজ্ঞান বিষয়টি বাধ্যতামূলক করবেন বলে জানান। প্রত্যেক শিক্ষার্থী তাদের বাড়িতে জৈব সার ব্যবহার করে দেশীয় জাতের সবজি বাগান করতে উৎসাহিত করবেন। এ কাজ মনিটর করার জন্য তিনি একজন করে শিক্ষক নিয়োজিত করবেন। তিনি বলেন, “বর্তমানে মেয়েরা শিক্ষায় অগ্রসর, এখন অনেকেই গ্রামের বাইরের স্কুল, কলেজে গিয়ে পড়ালেখা করছে। তবে তাদের এগিয়ে যাওয়ার জন্য যা যা করতে হয় আমি সকল পদক্ষেপ গ্রহণ করবো। আমি চাই একজন মেয়ে সকল বিষয়ে সক্ষম হবে। তার হাতেই জাতির ভবিষ্যৎ।” তিরি আরও বলেন, “সে আমাদের ভবিষ্যতের পাশাপাশি অতীত ঐতিহ্যের ধারক এবং বাহক হবে। সে যেমন সন্তান জন্ম দিবে তেমনি সেই সন্তানকে সংস্কৃতির সাথে পরিচয় করিয়ে দিবে। সে আমাদের দেশীয় খাবারগুলো যেমন রান্না করতে পারবে তেমনি বর্তমান বিশ্বের এই মুহূর্তের খবরগুলোও তার জানা থাকবে।