শতবাড়ির মর্জিনা গ্রামের নারীদের প্রেরণা
নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
মাইয়া মাইনসের পড়া লেহা কি, নাম ঠিকা লেখা শিখব, আরবী পড়া শিখব, তারপর বিয়ে দিয়া দিবা” সহজ সরল বাংলার জন্মসূত্রে পাওয়া নারীর প্রতি আর এক নারীর সিদ্ধান্ত”। এই কথাগুলো অনেক বছর আগে কৃষাণী মর্জিনা বেগমের মাকে বলেছিলেন তার দাদি শারজাহান বেগম।” দাদির কথার সাথে মর্জিনা বেগমের মায়ের সম্মতি না থাকলেও সেই কথার সাথে একমত ছিল তাঁর বাবা। ফলে কথার ছলে আদেশগুলো খুব সহজে প্রয়োগ হয়েছিল। বাড়ির বড় মেয়ে মর্জিনা বেগম মাত্র ১৪ বছর বয়সে বাল্য বিয়ের শিকার হন। ছেলেবেলা থেকে অত্যন্ত পরিশ্রমী মর্জিনা বেগম বাড়ির কাজের পাশাপাশি পড়াশুনা খুব আগ্রহ ছিল। কিন্তু তার কোন মতামত না নিয়ে কিশোরী বয়সে বিয়ে দেওয়া হয় নেত্রকোনা জেলার আমতলা ইউনিয়নের বিশ্বনাথপুর গ্রামে। হঠাৎ করে মেয়ে থেকে বউ হয়ে গেলেন তিনি।
স্বামীর ৭ কাঠা জমির উপর নির্ভর করে সংসার চলানোর দায়িত্ব নিলেন। বিয়ের কয়েক বছরের মধ্যে ২ সন্তানের জন্ম দিয়ে একজন কিশোরী ‘মা’ হয়ে নিজের কিশোর জীবনকে পিছনে ফেলে সামনে যাওয়ার লড়াই শুরু করলেন। তাঁর স্বামী-ফারুক আহম্মেদ পিতার কাছ থেকে পাওয়া ৭ কাঠা ধানি জমিতে চাষ করে যে পরিমাণ ধান পান তা দিয়ে পরিবারের খাওয়া চালানো কষ্টকর হয়ে উঠে। সেই সাথে ছেলেমেয়ে বড় করার জন্য নিজের বাড়ির চারপাশে নদীর চরে পতিত জমিকে কাজে লাগানোর সিদ্ধান্ত নেন মর্জিনা। তিনি শুরু করেন সবজি চাষ। তাঁর স্বামী ধান চাষে ব্যস্ত থাকায় নিজেই জমি প্রস্তুত থেকে বপন পর্যন্ত সকল কাজ একাই করেন তিনি। বাড়ির সামনে তৈরি করেন সবজির মাঁচা। সুন্দর গুছানো মাঁচাটি তিনি এমনভাবে তৈরি করলেন যাতে করে সারাবছর সবজি চাষ করা যায়।
বর্ষায় প্রতিবছর মাঁচায় পুঁইশাক করেন, মাঁচার নিচে করেন ডাটা ও পাট শাক। পুঁইশাক শেষ হওয়ার আগেই নতুন করে শীতের সবজির জন্য প্র¯‘িত নেন। নিজের ঘরে রাখা কয়েক ধরনে সিম গাছ তিনি বর্ষাকালে চাষ করেন যা গ্রামে আশ্বিনা সিম হিসেবে পরিচিত। শীতের শুরুতে সিম বাজারে প্রচুর চাহিদা থাকে সেই সাথে ৯০ থেকে ১০০ শত টাকা ধরে বিক্রয় করা যায়। এ সম্পর্কে তিনি বলেন, “বিক্রয়ের জন্য সবজি চাষ করলে বাজারের চাহিদা সম্পর্কে ধারণা রাখতে হবে, সবাই যখন চাষ করে তখন বাজারের দাম কমে যায়, বেশি হলে উপযোক্ত মূল্য পাওয়া যায় না”। ছোট একটি মাঁচা থেকে তিনি পরিবার ও প্রতিবেশীদের মাঝে বিতরণ করেও বছরে প্রায় ত্রিশ থেকে চল্লিশ হাজার টাকার সবজি বিক্রয় করেন। সুন্দর বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের জন্য তৈরি মাঁচাটি গ্রামের অনেক কৃষাণী সবজি চাষের আগ্রহ বাড়িয়েছে।
সবজি চাষ করে থেমে থাকেননি তিনি খুব কম বয়সে তিনি বুঝতে পারেন ছেলেমেয়েদের একটু ভালোভাবে বড় করতে হলে পরিবারের খরচ কমাতে হবে আর এ খরচ কমানোর জন্য বাজার নির্ভরশীলতা কমাতে হবে। বাজার নির্ভরশীলতা কমাতে সবজির পাশাপাশি বাড়ির চারপাশে যেখানে সবজি কম হয় এরকম পতিত জমিতে হলুদ, আদা, ধনিয়া চাষ করেন।
মর্জিনা বেগমের বাড়ির পাশ দিয়ে বয়ে গেছে মগড়া নদী শীত মৌসুমে নদীর চরে কখনো শসা, মিষ্টি কুমড়া, মরিচ,পাট, সরিষা, পেঁয়াজ, রসুন, ধনিয়া, গমুড়ি ইত্যাদি চাষ করেন, যা দিয়ে পরিবারের চাহিদা পূরণ করে শসা, মিষ্টি কুমড়া, সরিষা বিক্রয় করে ২০ থেকে ৩০ হাজার টাকায় আয় করেন। চলতি বছর বাজারে তেলের দাম হঠাৎ বেড়ে গেছে কিন্তু নিজের ঘরে সরিষা থাকায় বাজারে বিক্রয় না করে খাবারের জন্য তেল করে নিয়েছেন। আগামী বছর নদীর চরে একটু বেশি পরিমাণে সরিষার করার পরিকল্পনা করেছেন তিনি। এতে করে যেমন ভেজালমুক্ত তেল খেতে পারবেন সেই সাথে বাজারে দাম কম বেশি হওয়া নিয়ে কোন ধরনের প্রভাব পড়বেনা পরিবারে।
তিনি সারাবছর বাড়িতে গরু, হাঁস, মুরগি পালন করেন যা দিয়ে পরিবারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করেও বিক্রয় করতে পারেন। গরুর গোবর, হাঁস মুরগির বিষ্ঠা সবজি ক্ষেতে সার হিসেবে ব্যবহার করেন। সবজি জমিতে জৈব সার ব্যবহারের ফলে উৎপাদিত সবজির বাজার চাহিদা রয়েছে। অন্যদিকে তিনি নিজে বাড়ির চারপাশে প্রতিবছর ফলজ গাছ লাগান। বর্তমানে বাড়িতে আম, কাঁঠাল, লিচু, আমড়া, জাম্বুড়া, সুপারী, নারকেল, পেয়ারা, পেঁপে, জলপায় গাছ রয়েছে। সবগুলো গাছে ফলন দিচ্ছে। বাড়ির এক কোনায় বারোমাসি লেবু গাছটি যে পরিমাণ লেবু হয় তা থেকে প্রতি বাজার বারে বিক্রয় করতে পারেন।
সকাল থেকে সন্ধ্যা সবজি ক্ষেত আর পরিবারের রান্নার কাজ করে থেমে থাকেনি তিনি। সঠিক সময় নিজের সন্তানকে পড়তে বসিয়েছেন। ক্লান্ত লাগলেও ছেলে মেয়েকে সময় দিয়েছেন রাতের পর রাত। তাঁর এর পরিশ্রমের কারণে বর্তমানে তাঁর বড় ছেলে ঢাকায় অনার্স পড়ছে, মেয়ে নেত্রকোনায় অনার্স পড়ছে। ছেলেমেয়ে পড়ার খরচ যোগাতে প্রতিনিয়ত বাড়ির চারপাশকে পুঁজি করে নানা ধরনের পরিকল্পনা করে এগিয়ে গেছেন তিনি।
বাড়ির একপাশে সবজি বিক্রয়ের টাকা থেকে ১৪ হাজার টাকা খরচ করে একটি মুরগি পালনের ঘর ও উপকরণ কিনে অন্যের সহায়তায় ব্রয়লার মুরগির ফার্ম দেন। পার্শবতী গ্রামের মুরগির বাচ্চা ও খাবার বিক্রেতার কাছ থেকে ব্রয়লার মুরগি এনে পালন পালন করে চার বছর ধরে বিক্রয় করছেন। প্রতিবছর তিন থেকে চার মাস মুরগি পালন করেন তিনি। এতে করে বছরে ১৫ থেকে ২০ হাজার টাকা আয় হয়। পরিবারের সকল পুষ্টির চাহিদা পূরণে যেমন পতিত জমি কাজে লাগিয়েছেন তেমনি নিজেদের ধানি জমি যেখানে ধান কম হয় সেখানে ছোট আকারে পুকুর দিয়ে স্থানীয় জাতের মাছ চাষ করেন, যা বছরে ২ থেকে ৩ মাস খাওয়া চলে।
মর্জিনা বেগমের এ ধরনের ব্যয় সাশ্রয়ি জীবন ব্যবস্থাকে পিছিয়ে পড়া নারীদের কাছে উদারণ হিসেবে তুলে ধরতে দীর্ঘদিন ধরে পরিবারটির সাথে কাজ করছেন বারসিক। একটি আদর্শ পুষ্টি বাড়ি হিসেবে গড়ে তুলতে পরিবেশবান্ধব কৃষি চর্চায় সহায়তা হিসেবে বারসিক তাকে কম্পোস্ট তৈরিে উপকরণ দিয়েছে। বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের জন্য দেওয়া হয়েছে সবজি বীজ রাখার উপকরণও। কখনও কখনও দিয়েছে বিভিন্ন ধরনে ঔষধি গাছ, যা পরিবারটিকে আর বৈচিত্র্যময় করে তুলেছে।
মর্জিনা বেগমের এ পরিবেশবান্ধব বৈচিত্র্যময় সবজি চাষের গল্প নিজের গ্রাম ছাড়িয়ে ভিন্ন গ্রামে নারীদের মধ্যে সবজি চাষের আগ্রহ বাড়িয়েছে। আমতলা ইউনিয়নে কাটাকালি, পাঁচকাহনীয়, গাছগড়িয়া, দেওপুর গ্রাম থেকে নারীরা এসে বাড়ি পরিদর্শন করে গেছেন বিভিন্ন সময়। এসেছেন উপজেলা কৃষি কর্মকর্তারাও। মর্জিনা বেগমের পরিবেশবান্ধব কৃষিচর্চা দেখে চলতি বছর পুট্টা ও মরিচের চাষের প্রদর্শনী প্লট তৈরি করেন উপসহাকারী কৃষি কর্মকর্তা।
একজন আদর্শ সবজি চাষি মর্জিনা বেগম শুধু নিজের বাজার নির্ভরশীলতা কমিয়ে পরিবারের আর্থিক স্বচ্চলতা এনে থেমে থাকেননি। তিনি বিশ্বনাথপুর গ্রামকে একটি সবজি গ্রাম তৈরির জন্য কাজ করছেন। এই লক্ষ্যে তৈরি করেছেন বিশ্বনাথপুর কৃষাণী সংগঠন। সংগঠনে সহযোগি সংস্থা হিসেবে কাজ করছে বারসিক। পারিবারিক পর্যায়ে ও নিজের জীবনে সকল ক্ষেত্রে সিদ্ধান্ত নিতে হলে নারী শিক্ষার যেমন ভূমিকা আছে সেই সাথে নারীকে আয় বৃদ্ধিমূলক কাজের মাধ্যমে আর্থিকভাবে স্বচ্ছলতা তৈরির কোন বিকল্প নেই বলে মনে করেন মর্জিনা বেগম। বাবার পরিবারে কোন সিদ্ধান্ত নিতে না পারলেও এখন নিজের সংসারে যে কোন ধরনের সিদ্ধান্ত গ্রহণে স্বামী তাকে মূল্যায়ন করেন।
আমাদের সমাজে হাজারো নারী সকাল থেকে রাত পর্যন্ত পরিশ্রম করে পারিবারিক পর্যায়ে ব্যয় সাশ্রয়ি অর্থনীতিতে ভূমিকা রাখলেও এখনও সিদ্ধান্ত গ্রহণে অংশ নিতে পারেন না শতশত নারী। তাই সকল নারীদের উচিত নিজের যেটুকু সম্বল আছে, বা নিজের চারপাশের সম্পদকে কাজে লাগিয়ে মর্জিনা বেগমের মত জীবন পরিবর্তনে গল্প তৈরি করা, যা পরিবারের পাশাপাশি সামাজিক পরিবর্তনে ভূমিকা রাখে ।