হারিয়ে যেতে বসেছে মানিকগঞ্জের ঐতিহ্যবাহী ও ইতিহাসখ্যাত “হাজারী গুড়”
মানিকগঞ্জ থেকে আব্দুর রাজ্জাক ॥
শীত মৌসুমে মানিকগঞ্জে খেঁজুর গুড় রীতিমত একটা শিল্পে পরিণত হয়। আর এ শিল্পর প্রধান উপাদানই হচ্ছে এখানকার ইতিহাসখ্যাত ঐতিহ্য “হাজারী গুড়”। এ ঐতিহ্য দু’একদিনের নয়; প্রায় দেড়শত বছর আগের। হাজারী গুড়ের প্রধান বৈশিষ্ট্য হচ্ছে দু’হাতে গুড়ো করে ফুঁ দিলে তা ছাতুর মত বাতাসে উড়ে যায়। স্বাদে-গন্ধে অতুলনীয়। হাজারী গুড়ের সুনাম আজো টিকিয়ে রেখেছেন দেশের একমাত্র হাজারী গুড় উৎপাদনকারী জেলা মানিকগঞ্জের হরিরামপুরের ঐতিহ্যবাহী হাজারী পরিবারসহ শতাধিক গাছী পরিবার। তবে এক শ্রেণির অসাধু গুড় তৈরিকারক সাদা রঙয়ের গুড়ের উপর হাজারী গুড়ের নাম খোদাই করে বাজারজাত করে সাধারণ ক্রেতাদের ধোঁকা দিচ্ছে। ফলে দিন দিন জৌলুস আর জনপ্রিয়তায় ভাটা পড়ছে হাজারী গুড়ে। যদিও ভোজন রসিকরা এর মান নিয়ে নানা প্রশ্ন তুলছেন তবুও স্বাদে-গন্ধে ঝিটকার হাজারী গুড় এখনো সারা বাংলায় তুলনাবিহীন এবং এর চাহিদা ব্যাপক।
জেলার খেঁজুর গাছের দুই তৃতীয়াংশই রয়েছে মানিকগঞ্জের হরিরামপুর উপজেলায়। সেখানে প্রতি একরে ১৫টি খেঁজুর গাছ দেখা যায়। গুণে মানে, স্বাদে গন্ধে এই হাজারী গুড়ের বিস্তর সুনাম রয়েছে। এই হাজারী গুড় নিয়ে রয়েছে নানা উপকথা। এ অঞ্চলের পথে-প্রান্তরে রয়েছে সারি সারি খেঁজুর গাছ। আর এ খেঁজুর গাছ এ অঞ্চলের অসংখ্য মানুষের জীবন-জীবিকার একটি মাধ্যম। শীতে খেঁজুর গাছের রস দিয়ে তৈরি করা হাজারী গুড়। যা দেশ-বিদেশে বেশ প্রিয়। এমনকি ইংল্যান্ডের রাণী এলিজাবেথকেও এ গুড় উপহার দেওয়া হয়েছিল বলে জানা যায়।
তিন পুরুষ ধরে গুড় উৎপাদন করে আসা গাছী আজমত আলি হাজারী (৬৫) জানান, ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রী সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এই গুড় উৎপাদনের নির্ভরযোগ্য সময়। আগের দিন বিকেলে গাছ কেটে হাড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে (সূর্য উঠার আগে) রস সংগ্রহ করে পরিস্কার করে ছেঁকে মাটির তৈরি (জালা) পাত্রে চুলায় (বাইনে) জ্বালিয়ে বিশেষ পদ্ধতিতে তৈরি করা হয় হাজারী গুড়। এই পদ্ধতি এখন আর হাজারী পরিবারের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই। প্রায় গাছিদের মধ্যেই ছড়িয়ে পড়েছে। এই গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টল টলে রস ছাড়া হাজারী গুড় হয় না। প্রতিকেজি গুড় ৬শ টাকা থেকে হাজার টাকা পর্যন্তও বিক্রি হয় বলে তিনি জানান।
কালোই গ্রামের গাছি হযরত আলী জানান, বাজারে এক ধরনের হাজারী সুদৃশ্য গুড় পাওয়া গেলেও মৌলিকভাবে তার ব্যবধান রয়েছে। নানা প্রতিকূলতায় মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী হাজারী খেঁজুরের গুড় প্রায় বিলীন হতে চলেছে। প্রতিবছর হাজার হাজার গাছ কেটে ইট ভাটায় লাকড়ি হিসেবে পোড়িয়ে এই গুড় শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করা জরুরি বলে জানান এই এলাকার গুড় শিল্পীরা।
কথিত আছে, এ হাজারী গুড়ের রয়েছে নানা উপকথা। হাজারী কোন বংশগত নাম নয়। এটা ব্যক্তি বিশেষের নাম। প্রায় দেড়শ’ বছর আগে ঝিটকা অঞ্চলের হাজারী প্রামাণিক নামে একজন গাছি ছিলেন। যিনি খেঁজুরের রস দিয়ে গুড় তৈরি করতেন। হঠাৎ একদিন বিকালে খেঁজুর গাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে গাছ থেকে নামামাত্রই একজন দরবেশ তার কাছে রস খেতে চায়। তখন ওই গাছি দরবেশকে বলেছিলেন, “সবেমাত্র গাছে হাঁড়ি বসানো হয়েছে। এ অল্প সময়ে বড়জোর ১০-১৫ ফোঁটা রস হাঁড়িতে পড়েছে।” তবুও দরবেশ তাকে গাছে উঠে হাঁড়ি থেকে রস খাওয়ার আকুতি জানায়। দরবেশের রস খাওয়ার ইচ্ছায় গাছি সত্যি সত্যি খেঁজুর গাছে উঠেই হতবাক হয়ে যান। গাছি দেখতে পান, সারারাত ধরে রস পড়তে থাকলে যে পরিমাণ হওয়ার কথা ছিল মাত্র কয়েক মিনিটে পুরো হাঁড়ি রসে ভরে গেছে। গাছি হাঁড়ি ভরপুর রস নিয়ে নিচে নেমে দরবেশকে রস খাওয়ান এবং পা জড়িয়ে ধরেন। গাছিকে উঠিয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে দরবেশ বললেন, “কাল থেকে তুই যে গুড় তৈরি করবি তা সকলেই খাবে এবং তোর গুড়ের সুনাম দেশ-বিদেশে ছড়িয়ে পড়বে। তোর সাত পুরুষ এ গুড়ের সুনাম ধরে রাখবে” বলেই দরবেশ দ্রুত চলে যান। এরপর অনেক খোঁজাখুঁজি করেও ওই দরবেশকে পাওয়া যায়নি। ওই দিন থেকেই হাজারী প্রামাণিকের নামেই এ গুড়ের ‘হাজারী’ নামকরণ করা হয়।
আবার প্রবীণ অনেকেরই মতে, গাছের রস থেকে বিশেষ কৌশলে সুগন্ধময় স্বাদ সফেদ এ গুড়ের উদ্ভাবন করেছিলেন হরিরামপুর উপজেলার ঝিটকা গ্রামের মিনহাজ উদ্দিন হাজারী। প্রকৃত হাজারী গুড় তৈরির গোপন কৌশল একমাত্র তার পরিবারের সদস্যদের মাঝেই রয়ে গেছে। আজও এ গুড় নিয়ে মানিকগঞ্জবাসীর অহংয়ের কমতি নেই। তার নামেই এই গুড়ের নামকরণ করা হয়েছে “হাজারী গুড়”।
যেভাবে তৈরি হয় হাজারী গুড়
স্থানীয় গাছিরা দুপুরের পর থেকে খেঁজুর গাছ কেটে হাঁড়ি বসিয়ে দেয়। সারারাত ওই হাড়িতে রস পড়ার পর ভোর রাতে আবার গাছ থেকে হাঁড়ি নামানো হয়। এরপর গাছি পরিবারের নারীরা মাটির চুলায় ভোর থেকে রস জাল দিয়ে ঘন করে। রসের ঘনত্ব বেড়ে গেলে একটি মাটির হাঁড়িতে বিশেষ প্রক্রিয়ায় ঘুটে ঘুটে তৈরি করা হয় সাদা রঙের হাজারী গুড়। বর্তমানে প্রতি কেজি হাজারী গুড় বিক্রি হচ্ছে ৬০০ টাকা থেকে ১০০০ টাকায়।
বেশি শীত অর্থাৎ ১৫ থেকে ২০ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় এ গুড় উৎপাদনের নির্ভযোগ্য সময়। আগের দিন বিকালে গাছ কেটে হাঁড়ি বেঁধে দেওয়া হয়। পরদিন ভোরে (সূর্য উঠার আগে) গাছ থেকে রস নামিয়ে ছেকে ময়লা পরিষ্কার করে মাটির তৈরি জালা অথবা টিনের তৈরি তাফালে (পাত্র) বাইনে (চুলা) জ্বালিয়ে গুড় তৈরি করতে হয়। জ্বালানি হিসেবে ব্যবহার করা হয় খড় কুটো, নাড়া ও কাঁশবন। এ গুড় দেখতে যেমনি সুন্দর, খেতেও তেমনি সুস্বাদু। মিষ্টি ও টলটলে রস ছাড়া এ গুড় হয় না।
মানিকগঞ্জে শীত মৌসুমে খেঁজুর গাছ একটি শিল্পে পরিণত হয়। রস থেকে গুড় উৎপাদনে পেশাদার গাছি, কুমার, কামার, জ্বালানি ব্যবসায়ী, পরিবহনের শ্রমিক, ট্রাক মালিক, চালক, ভ্যান চালক, আড়তদারসহ বিভিন্ন পেশার মানুষ সংযুক্ত হয়। গালা ইউনিয়ন পরিষদ চেয়ারম্যান শফিক বিশ্বাস জানান, সমগ্র বাংলাদেশের মধ্যে একমাত্র মানিকগঞ্জেই তৈরি হয় এই ইতিহাস প্রসিদ্ধ হাজারী গুড়। হরিরামপুরের ঝিটকা এলাকা খেঁজুর গুড় শিল্পের প্রধান কেন্দ্র। গুণে-মানে, স্বাদে-গন্ধে এই গুড়ের ব্যাপক সুনাম রয়েছে।
নানা প্রতিকূলতায় মানিকগঞ্জের স্বনামধন্য ঐতিহ্যবাহী হাজারী খেঁজুরের গুড় প্রায় বিলীন হতে চলেছে। প্রতিবছর হাজার হাজার গাছ কেটে ইট ভাটায় লাকড়ি হিসেবে পুড়িয়ে এই গুড় শিল্পকে ধ্বংস করা হচ্ছে। এছাড়াও নকল গুড় উৎপাদনকারীদের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় প্রশাসনিক ব্যবস্থা না নেওয়ায় দিন দিন জৌলুস ও নাম-ডাক খর্ব হচ্ছে হাজারী গুড়ের। সরকারিভাবে উদ্যোগ নিয়ে এই শিল্পকে রক্ষা করা জরুরি বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।