শ্যামনগর অ্যাগ্রোটেকনোলজি পার্ক: কৃষির এক উৎকৃষ্ট দৃষ্টান্ত
সাতক্ষীরা থেকে মননজয় মন্ডল
আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর একটি কৃষি উদ্যোগের নাম শ্যামনগর অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক। দেশের উপকূলীয় সাতক্ষীরার শ্যামনগর উপজেলা পরিষদ চত্বরে গড়ে তোলা হয়েছে শ্যামনগর অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্কটি। সেখানে কৃষির নানা উদ্যোগ, চর্চা ও প্রযুক্তিসহ রয়েছে নানা প্রজাতির ফলদ, বনজ, ঔষধি ও অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্যের সমারোহ। উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের সহযোগিতায় শ্যামনগর উপজেলা প্রশাসন উক্ত পার্কটি গড়ে তুলেছে। পার্কটির কৃষি প্রযুক্তি হিসেবে পার্কে প্রদর্শিত দেয়ালে সবজি চাষ, ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন কৌশল, কুইক কম্পোস্ট সার, আবর্জনা/খামারজাত সার এবং সবুজ সার তৈরি পদ্ধতি, মাশরুম চাষ, মৌমাছি পালন, সেক্স ফেরোমন ফাঁদের ব্যবহার, অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্যের প্রদর্শনী প্লট, ঔষধি গাছের বাগান ও স্থানীয় প্রজাতির ধান চাষসহ ভাসমান সবজি চাষ এর পদ্ধতি উপজেলার সকলের মাঝে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে। এখানে সকল প্রকার ফসল চাষাবাদে প্রধান্য দেওয়া হয়েছে জৈব পদ্ধতিকে। কেননা ক্ষতিকর কীটনাশক ও রাসায়নিক সারের ব্যবহার ছাড়াই গড়ে তোলা এই অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্ক দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে সকলের।
পার্কের প্রবেশমুখে ঔষধি গুণ ও পুষ্টিসমৃদ্ধ কুড়িয়ে পাওয়া অচাষকৃত উদ্ভিদবৈচিত্র্যের প্লটে দেখা যাবে নয়নতারা, কাল কেউটে, কচুমুখী, পাথরকুচি, মিছরিপাতা, তুলসী, হাতিশুঁড়, বেতোশাক, পাহাড়ি ধনে, কাঁটানুটে, আমরুল শাক, তুলোটেপারি, হেলাঞ্চ, আদাবরুন, থানকুনি, মনিরাজ, ধুতরা, ভেন্না, বাউল জেলি, কালমেঘ, লজ্জাবতী, বনমূলা, পাশাফুল, অনন্তমূল, শীষ আকন্দ, লাল কেউটে, রক্তকরবী, শ্বেত আকন্দ, নীল অপরাজিতা, শতমূল, শিউলী, হাড়ভাঙ্গা, নিমুখো, বামন আঁটি, খুদকুড়ি তেলাকচু, ঘুমশাক, কলমীশাক, গাদামনি শাক, হেলাঞ্চ, ঘোড়া সেঞ্চি, কাটানটি, গিমে শাক ও কালোকচু সহ প্রায় শতাধিক উদ্ভিদ। শুধু তাই নয়, এখানে রয়েছে-বাদাম, কালজিরা, বাটিশাক, রসুন, বরবটি, বেগুন, টমেটো, পেঁপে, আম, গীমা কলমি, অড়হড়, শসা, তিল, মুগ, উচ্ছে, পুঁইশাক, লাউ, কুমড়া, মিষ্টি আলু, ড্রাগন ফল, পেয়ারা, ওল, মুখি কচু, পাট, আখ, ক্যাপসিকাম, ছোলা, স্ট্রবেরি, সিম, মরিচ, চিচিঙ্গা, ঝিঙে, ধুন্দুল, ঢেঁড়স, ভুট্টা, ডাটাশাক, যব, গম, ধানের প্রদর্শনী ক্ষেত ও ভাসমান সবজি চাষ। শ্যামনগর এগ্রোটেকনোলোজি পার্কটির সার্বিক ব্যবস্থাপক হিসেবে দায়িত্বরত কৃষি উপসহকারী ইসহাক উদ্দিন জানান, তারা এখানে কৃষির এক প্রশিক্ষণ কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলেছেন, যেখানে বারসিকসহ কয়েকটি প্রতিষ্ঠান সহযোগিতার হাত বাড়িয়েছে।
এখানে চলতি মৌসুমে ৬৫ প্রকারের স্থানীয় জাতের ধান বীজ লাগানো হয়েছে। স্থানীয় প্রজাতির সকল প্রকার বীজ সংরক্ষণ করা হয়েছে অতি যতœ সহকারে। গড়ে তোলা হয়েছে দর্শনীয় এক বীজ মিউজিয়াম।
এই প্রসঙ্গে বঙ্গবন্ধু জাতীয় কৃষিপদক প্রাপ্ত কৃষাণী অল্পনা রানী ও ফরিদার পারভীন জানান তাঁরা ধূমঘাট শাপলা নারী উন্নয়ন সংগঠন ও হায়বাতপুর কৃষি নারী সংগঠন শ্যামনগর অ্যাগ্রো টেকনোলজি পার্কটির অভ্যন্তরে ২টি প্রদর্শনী প্লট তৈরি করেছেন, একটি কুড়িয়ে পাওয়া সবজির এবং অপরটি ঔষধি গাছের বাগান। উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার এই ব্যতিক্রমী কৃষি উদ্যোগে তারা সহযোগিতা করতে পেরে খুশি। জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদ ও কৃষিকাজ দেখে কৃষক-কৃষাণীরা একদিকে যেমন উদ্বুদ্ধ হচ্ছেন, অপরদিকে তেমনি ওষুধি লতাপাতা ও তার ব্যবহারবিধি জানতে পারছেন সহজেই। প্রতিদিন বিভিন্ন স্থান থেকে নানা শ্রেণী ও পেশার মানুষ পার্কটি পরিদর্শন করছেন । অভিজ্ঞতা গ্রহণ ছাড়াও মুগ্ধ হচ্ছেন এমন এক ইনোভেশান উদ্যোগ দেখে। বাহবা জানাচ্ছেন উদ্যোক্তাদের।
শ্যামনগর উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা আবুল হোসেন মিঞা বলেন, “কৃষিতে যত প্রকারের প্রযুক্তি রয়েছে তা এখানে এলেই দেখা যাবে, ভুমির যথাযথ ব্যবহারসহ জৈব ব্যবস্থাপনায় কৃষি কার্যক্রম আব্যহত রয়েছে। এখানে কৃষকেরা হাতে কলমে প্রশিক্ষণ নিয়ে লাভবান হতে পারে।”
ক্ষতিকর রাসায়নিক সার ও কীটনাশকমুক্ত চাষাবাদে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করতে উপজেলা প্রশাসনের তত্ত্বাবধানে, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারন অধিদপ্তরের সহযোগিতায় এবং বিভিন্ন সমমনা সংগঠনের যৌথ উদ্যোগে গড়ে তোলা এ পার্কটি হতে পারে কৃষি ও কৃষকের এক চিরন্তন অনুসরণীয়।