বিনা চাষে আলু উৎপাদন
বটিয়াঘাটা খুলনা থেকে মিলন কান্তি মণ্ডল
গায়ের রঙ রোদে পোড়া তামাটে বর্ণের, বেঁটে, মুখে কাঁচা-পাকা দাড়ি, মাথা ভর্তি ঘনচুল, অধিকাংশই সাদা। পরনে কম দামের হাফ প্যান্ট। হাতে সব সময় নিড়ানি, কাস্তে, কোদাল, আঁচড়া অথবা অন্য কোনো কৃষিসরঞ্জাম। শীতকালে গেঞ্জি বা সোয়েটার ছাড়া সারাবছর খালি গায়েই কাজ করতে অভ্যস্ত ৬২ বছরের জগন্নাথ মণ্ডল। খুলনা জেলার বটিয়াঘাটা উপজেলার সদর ইউনিয়নের হেতালবুনিয়া মধ্যপাড়ায় বাড়ি জগন্নাথ মণ্ডল’র। প্রাতিষ্ঠানিক লেখাপড়া পঞ্চম শ্রেণি পর্যন্ত কিন্তু কৃষি অভিজ্ঞতায় পরিপূর্ণ জগন্নাথ মণ্ডল। স্ত্রী, এক ছেলে, ছেলে বউও এক নাতি নিয়ে তার সংসার। একমাত্র মেয়েকে বিএ পাস করিয়ে বিয়ে দিয়েছেন অনেক আগেই।
জগন্নাথ মণ্ডলের নিজের সম্পদ বলতে রয়েছে ১০ শতাংশের বাস্তভিটা ও ৫০ শতাংশ আয়তনের বিলের ধানি জমি। স্থানীয় উন্নয়ন সংস্থা লোকজ’র সহায়তায় গ্রামের কৃষকদের নিয়ে তৈরি করেছেন ‘হেতালবুনিয়া রংধনু কৃষক সংগঠন’ যার ক্যাশিয়ার তিনি। বর্ষাকালে নিজের এক বিঘা জমি আর ছয় বিঘা জমি বর্গা নিয়ে চাষ করেন আমন ধান। নিজের ও বর্গা নেওয়া জমির ধানে সংসারে দৈনন্দিন প্রয়োজনীয় চালের যোগান হলেও বসতবাড়িতে কম জায়গার কারণে শাকসবজি, তরিতরকারির অভাব মেটাতে বাড়ি সংলগ্ন দক্ষিণ পাশে আমন ধান কাটার পর পরই ভিজা জমিতে বিনা চাষে গোলআলুর চাষ করেন।
বিনা চাষে গোল আলুর উৎপাদন খুবই সহজ। চলতি বছর শীতকালে পৌষ মাসের প্রথম সপ্তাহে ৫ শতাংশ জমিতে পঁচা খড়কুটা, গোবর ও বাড়িতে পোষা ৮টি মুরগির এক বছরের বিষ্ঠা সব মিলিয়ে ২৫০ কেজি জৈব সার এবং ৩ কেজি টিএসপি ও ২ কেজি এম পি সার জমির ভিজা মাটির উপর সমান করে বিছিয়ে জমি প্রস্তুত করেন। জমি প্রস্তুতের পর উত্তর-দক্ষিণ বরাবর একটি বেডে ৯ ইঞ্চি ফাঁকা দিয়ে ৫টি সারি তৈরি করেন। এক বেড থেকে অন্য বেডের দূরত্ব রাখেন ১৮ ইঞ্চি। লিচু আকৃতির ৪০ কেজি রোপণ উপযোগি গজানো আস্ত বীজ আলু আচড়া টানা সারিতে ৬ ইঞ্চি পরপর লাগিয়ে জৈবসার দিয়ে ঢেকে দেন। আলু ক্ষেতের চার পাশ জিগার ডাল, বাঁশের চটা ও নেট দিয়ে ঘিরে দেন, কোন খরচ লাগেনি। এরপর ইদুর দমনের জন্য চারপাশ পলিথিনের বেড়া দেন। আলু রোপণের একমাস পর প্রথমবার হালকা সেচ, এর পনের দিন পর শেষবার হালকা সেচ দেন।
আলু সংগ্রহের কয়েকদিন আগে গত ১০/০২/১৭ তারিখ জগন্নাথ মণ্ডলের বিনা চাষে আলু উৎপাদন পদ্ধতি সরেজমিনে দেখতে গেলে তিনি ক্ষেতের একটি আলু গাছ খুড়ে দুই হাত ভরে আলু দেখিয়ে জানালেন, ৫ শতাংশ জমিতে আলু চাষের জন্য তিনি ৪০ কেজি বীজআলু ৩২ টাকা হারে ১২৮০/- টাকায় কিনেছেন। পরিবহন ও আনুষাঙ্গিক খরচ বাবদ সর্বমোট ১৮৫৫/- টাকা তিনি বিনিয়োগ করেছেন। তিনি আরও জানান, মাঘ মাসের শেষ বা ফাল্গুনের প্রথম দিকে আলু উঠালে সম্ভাব্য উৎপাদন হবে প্রায় ১৫-১৬ মণ। জগন্নাথ মন্ডল জানান, তাঁর উৎপাদিত আলু এখন ১৫ টাকা দরে সর্বমোট ৯৬০০/- টাকা বিক্রয় হবে। ৫ শতাংশ জমিতে খরচ বাদে ৮,০০০/- টাকা নিট লাভ হবে বলে তিনি আশা করনে। তাঁর বিনা চাষের আলু উৎপাদন দেখে প্রতিবেশী ও আশে পাশের গ্রামের অনেকেই এই পদ্ধতিতে আলু চাষ করছেন। জগন্নাথ মণ্ডলের ভাষায় “এটা একটা ফাও ফসল, খরচ কম, ফলনও ভালো। আমন ধান উঠার পরে আলু, আলুর পরে তিল, ডাল বা সবজির চাষ করা যায়। এক বছরে তিনটি ফসল উৎপাদন করা যায়। সারা বছরের বাড়ির আবর্জনা পচা ও জৈব সারই এই চাষের জন্য যথেষ্ট। ফলে জমির উর্বরাশক্তি বৃদ্ধি পায়, পরবর্তী ফসল ভালো হয়”।
দেশের অন্যান্য এলাকার কৃষকরা যদি বিনা চাষে আলু উৎপাদন কৌশল দেখে ও শিখে নিয়ে চর্চা করেন তবে তাঁরাও লাভবান হবেন। আর এভাবেই পরিবার ও দেশের খাদ্য নিরাপত্তায় তাঁরাও অবদান রাখতে পারবেন বলে তিনি বিশ্বাস করেন।