গুড়পুকুরের মেলা সাতক্ষীরার ঐতিহ্য
সাতক্ষীরা থেকে আসাদ রহমান
গুড় পুকুরের মেলা সাতক্ষীরার এতিহ্য। ৪’শ বছর এই জেলার মানুষ এটি লালন করে আসছে। গুড়পুকুরের মেলা ছিলো সাতক্ষীরাবাসীর মিলনমেলা। হিন্দু, মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষের এক হওয়ার মহা উৎসব। যে উৎসবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তো তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমার সকল এলাকায়, দুর দুরান্ত থেকে আসা মানুষের মধ্যে। দক্ষিণের মানুষেরা এখন আর নৌকায় শহরে এসে খাওয়া দাওয়া সেখানে সারে না। শহরের বাড়িতে বাড়িতে সেই মিলন মেলা এখন আর বসে না।
একাধিক প্রবীণ ব্যক্তির সাথে কথা বলে জানা গেছে, গুড়পুকুরের মেলা ছিলো সাতক্ষীরাবাসীর মিলনমেলা। হিন্দু, মুসলিম সব সম্প্রদায়ের মানুষের এক হওয়ার মহা উৎসব। যে উৎসবের ঢেউ ছড়িয়ে পড়তো তৎকালীন সাতক্ষীরা মহাকুমার সকল এলাকায়, দুর দুরান্ত থেকে আসা মানুষের মধ্যে। বাড়ির কর্তারা সারাবছর ধরে এই মেলার জন্য অপেক্ষা করতেন ঘরের একটি দরজা অথবা জানালা বা চেয়ার-টেবিল কেনার জন্য। গৃহিণীরা অপেক্ষা করতেন খোন্তা কড়াই দা, বটি ধামা কুলা ঝুড়ি বা অন্য কোন জিনিস কেনার জন্য। শহরের বাইরের মানুষেরও অপেক্ষা ছিলো এ মেলার জন্য। কৃষক তার চাষের জিনিসপত্র তথা লাঙ্গল ফলা ইত্যাদি কেনার জন্য অপেক্ষা করতেন। শ্রমিক তার নির্মাণ কাজের জন্য হাতুড়ি কড়াইসহ প্রয়োজনীয় জিনিস কিনতেন এই মেলা থেকে। কাঠ মিস্ত্রিরা সারাবছর ধরে তাদের কাজের ফাঁকে কাঠের জিনিসপত্র বানিয়ে নিজ বাড়ি ভরতেন। কুমাররা মাটির জিনিসপত্র বানিয়ে মজুদ করতেন। নার্সারি ব্যবসায়ীরা সারাবছর ধরে চারা তৈরি করতেন। কামাররা বানাতেন লৌহজাত জিনিসপত্র। বিভিন্ন পেশার মানুষ সারাবছর ধরে গায়ে গতরে খেটে এসব তৈরি করতেন মেলায় বিক্রি করে একসাথে অনেক টাকা উপার্জনের জন্য।
সাতক্ষীরা প্রেসক্লাবের সভাপতি আবুল কালাম আজাদ ছোট বেলার স্মৃতি চারণ করে বলেন, “এক মেলায় লক্ষ্মীঘট কিনতাম, আর এক মেলায় তা ভেঙে যে টাকা হতো তাই দিয়ে খেলনা সামগ্রীসহ অন্যান্য জিনিসপত্র কিনতাম। বাবা প্রতিদিন ৫ পয়সা-আবার কোন কোন দিন ১০ পয়সা দিতেন। তখন ৫ পয়সায় একটা আইসক্রিম পাওয়া যেত। মাঝে মধ্যে যে পয়সা বাঁচতো তা ফেলতাম লক্ষ্মীঘটে। এভাবেই সারাবছর পর ৪/৫ টাকা যা হতো তাই ছিলো আমার সম্বল। তাছাড়া মেলা উপলক্ষেও বাবা চারআনা-আটআনা, মা আরো দু’এক টাকা ছাড়া আত্মীয় স্বজন যারা মেলা দেখতে আমাদের বাড়ি এসে উঠতেন তাদের কাছ থেকেও পাওয়া যেত নগদ অর্থ ছাড়াও মেলার জিনিসপত্র। তারা সঙ্গে নিয়ে যেয়ে পছন্দমত জিনিষপত্র কিনে দিতেন।” তিনি আরও বলেন, “মেলা উপলক্ষে বোন-বোনাইরা আসতেন। সাথে তাদের ননদ-দেবরসহ অন্যান্য আত্মীয়স্বজন। আমাদের রাত কাটানোর জায়গা ছিলো ফাঁকা ছাদের উপর। যদিও মূল মেলার সময় আমরা রাত কাটাতাম সারারাত সিনেমা দেখে। বাড়িতে কখনো কখনো দাদী নানীরাও আসতেন।”
আবুল কালাম আজাদ জানান, সাধারণত মূল মেলার তিনদিন শহরের প্রায় সকল স্কুল ছুটি থাকতো। তরা সকাল হলেই বেরিয়ে পড়তেন মেলা দেখতে। হাওয়াই মিঠাই খেয়ে মুখ লাল করে ঘুরে বেড়াতেন। কখনো রসমুন্ডা, বাতাশা, গজাসহ মিষ্টি-মিঠাই কিনে বাড়ি ফিরতেন। নাগরদোলায় চড়ার আনন্দটাই ছিল আলাদা। তারপর দু’আনা চারআনা দিয়ে প্রথমদিকে মাটির নৌকা, গাড়ি, মাথা কাপানো বুড়ো দাদাসহ বিভিন্ন পুতুল কিনে নৌকায় দড়ি বেঁধে পাকারাস্তা ধরে টানতে টানতে বাড়ি আসতেন। তিনি বলেন, “তাই প্রতিদিন গিয়ে দাম শুনতাম, দাম কমেছে কি না? লঞ্চ কিনতাম। আর তার পলতেতে আগুন ধনিয়ে পানিতে ছেড়ে দিতাম। বড-বড করে চলতো কিছু সময়। তারপর পানি ঢুকে লঞ্চ শেষ।”
সাতক্ষীরার গুড়পুকুরের মেলার পরিধি নিয়ে তিনি আরও বলেন, তখন মেলাটি শহরের সঙ্গীতা সিনেমা হলের উত্তর পাশের রাস্তার দু’ধারে সারিবদ্ধভাবে বসতো অসংখ্য নার্সারির দোকান এবং তা বর্তমান নিউমার্কেট পর্যন্ত যেত। তার উত্তর পাশে প্রায় বর্তমান জজকোর্ট পর্যন্ত বসতো কাঠের ফার্নিচার, দা-বটি-খোস্তা-কোদাল-লাঙ্গলসহ বিভিন্ন লৌহজাত সামগ্রী। পলাশপোল স্কুলে বসতো বাঁশ বেতের বিভিন্ন সামগ্রীর দোকান। আর সেই সাথে নাগোরদোলা। পাশে গুড়পুকুর কান্দায় বসতো জিলাপি বাতাশাসহ হরেক রকমের মিষ্টি মিঠাইয়ের দোকান। পলাশপোল বর্তমান সেটেলমেন্ট অফিসের এলাকাটি (আমতলা নামে খ্যাত) ছিল সার্কাসের এলাকা। এখানে সার্কাস বসতো। ঐ স্থানে টিনের বেড়া দিয়ে উপরে চট টাঙিয়ে প্রোজেক্টর মেশিনের মাধ্যমে অস্থায়ী সিনেমা হল বসানো হতো।”
আবুল কালাম আজাদ জানান, লাবনী সিনেমা হলের সামনের রাস্তাটির দু’ধারে পাকাপুল পর্যন্ত বসতো হরেক রকমের খেলনা সামগ্রীসহ মনোহরি পণ্যের দোকান। পাকাপুলের বর্তমান মুক্তিযোদ্ধা সড়কে থাকতো কমদামী কাঠের চেয়ার টেবিল চৌকি দরজা জানালাসহ কাঠজাত সামগ্রীর দোকান। পাকাপুলের উত্তর পাশের পাওয়ার হাউজের পাচিলের পূর্ব পাশে বসতো আখ লেবুসহ বিভিন্ন ফলের দোকান। মাটির খেলনার দোকান বসতো এর আশেপাশের এলাকায়। ইলিশের দোকান বসতো ইটাগাছা হাটের সামনে। আর সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে কখনো কখনো বসতো যাত্রা-সার্কাস-পুতুলনাচের আসর। এক এক বছর এর কম বেশি হতো।
আবুল কালাম আজাদ বলেন, “মেলায় দেশের বিভিন্নস্থান থেকে আগত হাজার হাজার মানুষের মধ্যে যাদের শহরে আত্মীয়স্বজন ছিল তারা তাদের বাড়িতে উঠতেন। দক্ষিণের মানুষের থাকা খাওয়া ছিল নৌকার মধ্যে। এছাড়াও আরো বিপুল সংখ্যক মানুষের জন্য তখনকার একমাত্র সিনেমা হল লাবণী, পরে সঙ্গীতা, নিউমার্কেটের অস্থায়ী সিনেমা হলে সারারাত এক টিকিটে ২/৩টি ছবি দেখার ব্যবস্থা করা হতো। এছাড়া যাত্রা চলতো সারারাত। ফলে বিপুল সংখ্যক মানুষের রাত কাটানোর ব্যবস্থা হয়ে যেত এভাবেই।”
তিনি মেলার বর্তমান অবস্থা নিয়ে আরো বলেন, “সাতক্ষীরার ঐতিহ্যের এই মেলা আশির দশকের শুরু দিক থেকেই তার জৌলুস হারাতে থাকে। তারপরও শুরুটা উদ্বেগ উৎকণ্ঠায় হলেও শেষটা হতো ভালোভাবেই। তবে শহরে একের পর এক বাড়ি ঘর দোকান পাট মার্কেট ব্যবসা প্রতিষ্ঠান নির্মাণের কারণে মেলার স্থান অনেকটা সংকীর্ণ হতে শুরু করলেও মানুষের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা কমেনি। মেলার ধারাবাহিকতা ছিল ঠিকই।” তিনি আরও বলেন, “কিন্তু ২০০২ সালের ২৮ সেপ্টেম্বর মেলা উপলক্ষে সাতক্ষীরা স্টেডিয়ামে বসা সার্কাস প্যান্ডেল এবং শহরের রকসি সিনেমা হলে বোমা হামলায় ৩ জন নিহত এবং অর্ধ শতাধিক আহতের ঘটনার পর এই মেলা তার জৌলুস হারায়। কয়েক বছর বন্ধ থাকে। এরই মধ্যে অল্প সময়ে চিরচেনা সেই সাতক্ষীরা শহরের চেহারা সম্পূর্ণভাবে পাল্টে যায়। পূর্বে সেই মেলার স্থানগুলো এখন বাড়ি, ঘর, দোকান পাট ব্যবসা প্রতিষ্ঠানে পূর্ণ হয়ে গেছে। ফলে নতুন করে গত কয়েকবছর মেলা বসে শহীদ আব্দুর রাজ্জাক পার্কে সীমিত পরিসরে। কিছু অংশ পলাশপোল স্কুলে। এ মেলা এখন আর জেলাবাসীকে আগের মতো আকর্ষণ করে না। আত্মীয় স্বজন মেলার কথা ভুলে গেছেন। দুর দুরান্ত থেকে সেই মানুষ আর আসে না। সারাবছর ধরে কেউ আর মেলার জন্য জিনিসপত্র বানায় না।”
প্রণসায়রের অস্তিত্ব নিয়ে তিনি বলেন, “জমিদার প্রাণনাথ রায় চৌধুরী আড়পাঙ্গাশিয়া ও বেতনা নদীকে সংযোগ করতে এই প্রাণসায়রের খাল খনন করেন। আজ সেই প্রাণসায়র অস্তিত্বহীন। জোয়ার-ভাটা আর হয় না। গহণার বা টাবরুর নৌকা আর চলে না। দক্ষিণের মানুষেরা এখন আর নৌকায় শহরে এসে খাওয়া দাওয়া সেখানে সারে না। শহরের বাড়িতে বাড়িতে সেই মিলন মেলা এখন আর বসে না। তারপরও মেলার সেই স্মৃতি বাঁচিয়ে রেখে পুরাতন ঐতিহ্যের ধারাবাহিকতা বজায় রাখতে মেলা বসছে এখনো। এ মেলা আমাদের ঐতিহ্যের। এ মেলা অসাম্প্রদায়িক বাঙালি চেতনার এক গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়। এ মেলা আমাদের সব সম্প্রদায়ের মানুষের মিলন মেলা।”
সাতক্ষীরার প্রবীণ নাগরিক আমিনুর রশিদ বলেন, “ভাদ্র মাসের ৩১ তারিখে আনুষ্ঠানিকভাবে মেলা শুরু হওয়ার ১৫ দিন পূর্ব থেকে শুরু হতো দোকান পাট বানানোর কাজ। মূল মেলা ৩দিনের হলেও তা চলতো মাসব্যাপী। তারপর পুলিশ ভেঙে না দেওয়া পর্যন্ত ব্যবসায়ীরা থেকে যেত। মূল মেলার তিনদিন সাতক্ষীরা-কালিগঞ্জ সড়ক ছাড়া মেলা এলাকায় তেমন কোন যানবাহন চলতো না। পাকাপুল থেকে লাবণী পর্যন্ত মানুষের ভীড় ঠেলে যাতায়াত করতে কখনো কখনো আধাঘণ্টাও সময় লেগে যেত। দিনরাত ২৪ ঘণ্টার শেষ রাতের কিছু সময় ছাড়া প্রায় সকল সময় মেলার দোকান-পাট খোলা থাকতো।
তিনি আরও বলেন, “সাতক্ষীরার প্রাণসায়রে লঞ্চ চলতো। তবে আমরা দেখেছি স্টিমার চলতে, দেখেছি সাতক্ষীরা বড়বাজারের কাছে প্রাণসায়র খালে একটা বড় দোতলা লঞ্চ বাধা ছিল বেশ কয়েক বছর। বর্তমান সাতক্ষীরা নাইট স্কুলটি তখন ছিল সাতক্ষীরার এসডিপিও’র অফিস। সামনে লেখা ছিল জ্ঞান মন্দির। তার সামনে থাকতো স্পীডবোর্ড বাধা। পানি উন্নয়ন বোর্ডের স্পীড বোর্ড থাকতো বড়বাজারের দক্ষিণ পাশে খাদ্যগুদামের দক্ষিণ দিকে। আর স্টেডিয়ামের সামনে বর্তমান টেনিস গ্রাউন্ড ছিল তখন বিডিআর ক্যাম্প। ক্যাম্পের পাশে বাধা থাকতো বিডিআর ও এসডিও’র স্পিডবোর্ড। প্রাণসায়রের পানি উন্নয়ন বোর্ড এলাকা থেকে গার্লস স্কুলের কাঠের পুল পর্যন্ত থাকতো ছোট বড় শতশত গহনা ও টাবরু নৌকা। মেলার বিভিন্ন সামগ্রী আসতো ঐ সব নৌকায়। দক্ষিণাঞ্চলের মানুষ নৌকায় করে মেলায় এসে রাত কাটাতো সেখানে। রান্না-বান্না খাওয়া দাওয়া চলতো ঐসব নৌকায়। এখন আর সে সব হয়না। মেলা এখন ছোট পরিসরে অনুষ্ঠিত হয়ে থাকে।