আসুন সবাই যৌন হয়রানি প্রতিরোধে ঐক্যবদ্ধ হই

মানিকগঞ্জ সিংগাইর থেকে রিনা আক্তার
সামাজিকভাবে তৈরি শ্রেণী বৈষম্য আর লিঙ্গীয় অসমতা ক্ষমতার সম্পর্ক যৌন হয়রানির মত সামাজিক ব্যাধির প্রধান কারণ। গবেষণা থেকে দেখা যায়, খুব কম ক্ষেত্রেই যৌন হয়রানি যৌন চাহিদার কারণে তৈরি হয়। বরং নিজের ক্ষমতা ও নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার অভিপ্রায় থেকেই যৌন হয়রানি সংঘটিত হয়। আর্থসামাজিক ও লিঙ্গীয় বৈষম্য যৌন হয়রানির ক্ষেত্রকে আরো প্রসারিত করছে। দিনকে দিন শারীরিক, মানসিক, মৌখিক ও প্রতীকি যৌন নির্যাতনের মাত্রাবৃদ্ধি পাচ্ছে। যদিও প্রাপ্ত, অপ্রাপ্ত যেকোন নারী, পুরুষ, ৩য় লিঙ্গের মানুষ যৌন হয়রানির শিকার হতে পারে কিন্তু আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় এর প্রধান শিকার নারীরা। জীবন জীবিকার প্রয়োজনে নারীর কর্মক্ষেত্র আজ ঘর ও ঘরের বাইরে। রাস্তাঘাট, যানবাহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান কর্মক্ষেত্র সর্বপরিসরেই নারী নানাভাবে যৌন হয়রানির শিকার হচ্ছে। যৌন হয়রানির প্রতিকার পাবার লক্ষ্যে ২০০৯ সালে মহামান্য হাইকোর্ট নির্দেশ দেন-‘কোন প্রতিষ্ঠানে কোন ব্যক্তি যৌন হয়রানির শিকার হলে সেটি তদন্ত ও প্রতিকার ব্যবস্থা থাকতে হবে।’ কিন্তু দেখা যায় অধিকাংশ প্রতিষ্ঠান এই বিষয়ে সচেতন নয়। ২০২২ সালে নভেম্বরে জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির “কর্মক্ষেত্র ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধে হাইকোর্টের নির্দেশনা বাস্তবায়নের অগ্রগতি” বিষয়ক এক সমীক্ষা থেকে দেখা যায়, বর্তমানে ৭১% শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ও ৩৯% কর্মক্ষেত্রে যৌন হয়রানি বিষয়ক প্রতিরোধ কমিটি থাকলেও অধিকাংশই সেটি অকার্যকর। যৌন হয়রানি বিষয়টিকে আমলেই নেওয়া হয়না ।


মানিকগঞ্জ জেলার সিংগাইর উপজেলায় যৌন নির্যাতন ও নারীর নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে দেখা যায় যে, এলাকার স্কুল কলেজের শিক্ষার্থী ও কিশোরীদের রাস্তাঘাট, বাজার, যানবাহন, শিক্ষা প্রতিষ্ঠান বিভিন্ন পর্যায়ে যৌন হয়রানির শিকার হতে হয়। নানা ধরনের কুরুচিকর অনৈতিক প্রস্তাব, ইভটিজিং, যানবাহনে অপ্রয়োজণীয় স্পর্শ, ইচ্ছাকৃত ধাক্কা, শিষ দেয়া, চোখমারা, জিহ্বা বের করা অশ্লীল কথাবার্তা ও গান গাওয়া প্রভৃতিভাবে নারী যৌন হয়রানির শিকার হয়ে থাকে। সেই সাথে বতর্মান সময়ে ইন্টারনেটনির্ভর মোবাইলে নানা ধরনের কুরুচিকর মন্তব্য, তথ্য, ছবি, ভিডিও ও মেসেজের মাধ্যমে যৌন হয়রানি হয়ে থাকে।


এইরকম এক বাস্তবতায় নারীর প্রতি সকল ধরনের যৌন হয়রানি বন্ধ ও নিরাপত্তা বিষয়ে জনসচেতনতা তৈরি ও যৌন হয়রানি বিষয়ক প্রতিরোধ কমিটিকে আরো কার্যকরি করার লক্ষ্য বেসরকারি উন্নয়নমুলক গবেষণা প্রতিষ্ঠান বারসিক সিংগাইর রিসোসর্ সেন্টার বিগত কয়েক বছর ধরে কাজ করে আসছে। এরই অংশ হিসেবে গ্রাম, স্কুল, কলেজ, মাদ্রাসা পর্যায়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক আলোচনা, যানবাহন মালিক ও শ্রমিকদের সাথে আলোচনা ও মতবিনিময়, স্কুল কলেজের শিক্ষক শিক্ষার্থীদের সাথে মতবিনিময়, সামাজিক সংগঠন স্থানীয় প্রশাসন ও জনপ্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে সংলাপ ও মতবিনিময় সভার আয়োজন করা হয়। সেই সাথে যৌন নির্যাতন প্রতিরোধে একাধিক র‌্যালি, মানববন্ধন ও সংবাদ সম্মেলনের আয়োজন করা হয়েছে।


এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৩ মে ঘোনাপাড়া গোবিন্দল উচ্চ বিদ্যালয়ে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক মতবিনিময় সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত সভায় ওই বিদ্যালয়ের শিক্ষকবৃন্দ ও প্রায় ৩৫ জন শিক্ষার্থী উপস্থিত ছিলেন। যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ে বারসিক’র সহযোগী কর্মসূচি কর্মকর্তা রিনা আক্তার আলোচনা করেন। উক্ত মতবিনিময় সভায় প্রতিটি শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে যৌন হয়রানি প্রতিরোধ কমিটি গঠনের ব্যাপারে আলোচনা হয়। সেইসাথে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষার্থীরা যেন যৌন হয়রানি থেকে মুক্ত থাকতে পারে সেই বিষয়টি নিয়ে আলোচনা করা হয়। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে একটি কার্যকরি যৌন হয়রানি প্রতিরোধ বিষয়ক কমিটি গঠন ও কার্যকরি করতে হবে সকল শিক্ষার্থীকে বিষয়টি অবহিত করা যেন যেকোন ধরনের যৌন হয়রানির শিকার হলে তার কমিটির কাছে নির্ভয়ে অভিযোগ করতে পারে। এক্ষেত্রে অভিযোগকারী ও অভিযুক্তর নাম গোপন রাখা হবে। প্রয়োজনে আইন প্রয়োগকারি সংস্থার সহযোগিতা নেওয়া হবে। স্কুল পর্যায়ে যৌন হয়রানি বিষয়ক বিভিন্ন ধরনের সচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ করতে হবে।

happy wheels 2

Comments