দক্ষিণাঞ্চলে কাঁকড়ার সম্ভাবনা: চাষিদের স্বপ্নযাত্রা
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে গাজী আল ইমরান
কাঁকড়া চাষে জীবনের চাকা ঘুরাতে কাঁকড়া নিয়ে মনের কোণে স্বপ্ন বুনছে দক্ষিণাঞ্চলের চাষিরা। একসময় এ অঞ্চলের মানুষেরা চিংড়ি চাষের দিকে ঝুঁকেছিল ব্যাপকভাবে। চাষীরা চিংড়ির পাশাপাশি কাঁকড়া চাষ নিয়েও নতুন করে ভাবতে শুরু করেছেন। বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠান মানুষকে কাকড়ায় অর্ন্তভূক্ত করতে উদ্বুদ্ধকরণের কাজও করছে। ফলে ওই অঞ্চলের মানুষ স্বপ্ন দেখতে শুরু করেছেন। এই কাঁকড়া ইতিমধ্যে রপ্তানিযোগ্য পণ্য হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ৯টি দেশে রপ্তানি হয় উপকূলীয় অঞ্চলের ১০ পা বিশিষ্ট চিংড়ি প্রজাতির কাঁকড়া। খুলনাসহ দেশের উপকূলীয় অঞ্চল থেকে প্রচুর কাকড়া আহরণ করা হয়ে থাকে। এ অঞ্চলের প্রায় হাজার হাজার বনজীবী নারী ও পুরুষ কাঁকড়া আহরণ বা বিপণনের সাথে জড়িত।
সংশ্লিষ্ট বনজীবীদের সাথে আলাপ করে জানা গেছে, সাতক্ষীরা জেলার শ্যামনগর, আশাশুনি, কালিগঞ্জ, দেবহাটা ও তালা উপজেলায় কাঁকড়া চাষ করা হয়ে থাকে। জানা যায়, থাইল্যান্ড, মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, জাপান, ভিয়েতনাম, ইউকে, ইউএই, সৌদি-আরব, তাইওয়ান, হংকং নেদারল্যান্ড, জার্মান, ফ্রান্স, অষ্ট্রিয়া, কুয়েত, কাতার, ওমান, বাহারাইন, উগন্ডা, হন্ডুরাস, ইউএসএ এবং ভারতে উপকূলীয় অঞ্চলের কাঁকড়া রপ্তানি করা হয়ে থাকে। শুধু তাই নয় বিগত দিনে কাঁকড়ার ক্রাভলেট অর্থাৎ বাচ্চা নদীসহ বিভিন্ন স্থান থেকে সংগ্রহ করতে হলেও তা এখন চলে এসেছে হাতের মুঠোয়।
বাংলাদেশের সর্ব দক্ষিণে সুন্দরবনের পাদদেশে অবস্থিত শ্যামনগর উপজেলায় সর্বপ্রথম কাঁকড়ার বাচ্চা ফুটিয়েছে স্থানীয় বেসরকারি উন্নয়ন প্রতিষ্ঠান নওয়াবেকী গণমুখী ফাউন্ডেশন। নওয়াবেকী গণমুখী ফাউন্ডেশনের কর্মকর্তাদের সাথে কথা বলে জানা যায়, একটি মা কাঁকড়া থেকে কুঁড়ি হাজারের বেশি বাচ্চা সংগ্রহ করা সম্ভব। কাকড়া চাষি বাবুলাল মন্ডল বলেন, “সাধারণত আমাবশ্যা ও পূর্ণিমার গোনে কাঁকড়া ব্যবসা জমজমাট থাকে। শীত মৌসুমে মাদি কাঁকড়ার চাহিদা বেশি থাকে।” তিনি আরও বলেন, “আশ্বিন মাসে কাঁকড়ার চাষ শুরু হয়। দুই মাস পর পর কাঁকড়া আমরা বিক্রি করি। স্থানীয় ডিপো (কাকড়া বিক্রয় করা ঘর) গুলোতে কাঁকড়া কেনাবেচা হয়।” অন্যদিকে মুন্সিগঞ্চ কাকড়া চাষি রাম কৃষ্ণ মন্ডল বলেন, “আমি ১০ কাঠা জমিতে চার ভাগে ভাগ করে সারাবছর কাঁকড়া চাষ করি, সংসারের ৫ সদস্য আর দুই ছেলেকে লেখাপড়ার খরচ যুগিয়েছি।”
শুধু রামকৃষ্ণ মন্ডল নয় এখানকার গ্রামের লোকজন লাভজনক কাঁকড়া চাষে ঝুঁকে পড়েছেন। পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও স্বামীদের কাঁকড়া চাষে সহযোগিতা করেন। কাঁকড়া চাষ তরুণদের জন্য বিকল্প কর্মসংস্থানেরও উপায়। এই প্রসঙ্গে বুড়িগোয়ালিনি ইউনিয়নের তরুণ কাকড়া চাষি হান্নান বলেন, “স্নাতক পাশ করে কোন চাকুরি না হওয়ায় হতাশায় ভুগছিলাম। কিন্তু বর্তমানে মনে হয় সেই হতাশা থেকে মুক্তি পেতে চলেছি। আমরা চার বন্ধু মিলে কুড়ি হাজার কাঁকড়ার খাচায় কাঁকড়া মোটাতাজাকরণ বা ফ্যাটেনিং পদ্ধতিতে চাষ করছি, প্রথমবারেই ভালো লাভ পেয়েছি।” অন্যান্য চাষিদের সাথে কথা বলে জানা যায়, চলতি বছরে ১১০ গ্রাম মাদি কাঁকড়া ২শ’ টাকা কেজি, ১৫০ গ্রামের মাদি কাঁকড়া ৩শ’ টাকা, ১৮০ গ্রামের মাদি কাঁকড়া ৮শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হতে দেখা যায়। এ ছাড়া পুরুষ কাকড়া ৫শ’ গ্রামের কেজির দাম ৯শ’ টাকা, ৪ গ্রাম পুরুষ ৮শ’ টাকা, ৩শ’ গ্রাম পুরুষ ৭শ’ টাকা, এবং ২শ’ গ্রাম সাইজের কাঁকড়া ৫শ’ টাকা কেজি দরে বিক্রি হচ্ছে।
সুতরাং এলাকার শিক্ষিত, অশিক্ষিত বেকার যুবকেরা ব্যাপকভাবে ঝুঁকছে কাঁকড়া চাষের দিকে। কাঁকড়া উৎপাদন বৃদ্ধির লক্ষ্যে আরও সচেতন হওয়া প্রয়োজন। এ এলাকার অন্যান্য চাষিরা বলেন, “কাঁকড়া চাষ হবে এলাকার শ্রেষ্ঠ চাষ সে আশা বুকে নিয়েই নেমেছি।” স্থানীয় কলবাড়ি বাজার রেখে বুড়িগোয়ালিনি-মুন্সিগঞ্জ রাস্তার দু’পাশ্বে শোভা পাচ্ছে হাজার একর জমিতে কাঁকড়া চাষের প্লট। স্থানীয় মানুষদের পাশাপাশি দেশের অন্যান্য এলাকা থেকে অনেকেই এখানে এসে চাষ শুরু করেছে। কাঁকড়া চাষকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে কাঁকড়া মজুদ কারখানা। কাঁকড়া চাষের প্লটে কর্মসংস্থান হয়েছে হাজার হাজার মানুষের।