চেনেন্দ্র ম্রং এর দেখা পাহাড়ি ঢল ও ক্ষয়ক্ষতি
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
নেত্রকোণা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের ভারত সীমান্তে অবস্থিত হাতিবেড় গ্রাম। এই গ্রামেই দীর্ঘদিন যাবৎ বাস করছেন চেনেন্দ্র ম্রং। তাঁর বয়স ৮০ বছর। পেশায় একজন কৃষক। লেখাপড়া করেছেন পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত। তাঁর স্ত্রী ত্রিনালী মানখিন। তাঁর ৩ মেয়ে ও ১ ছেলে রয়েছে। তবে সবাই এখন বিয়ে করে সংসার পেতেছেন। আবাদী জমি ছিল ২০ কাঠা এর মধ্যে ১২ কাঠা পাহাড়ি ঢলে আসা বালুতে ঢাকা পড়েছে।
গ্রামটির নাম হাতিবেড়। গ্রামের নামকরণ করার পিছনে রয়েছে একটি ইতিহাস। যখন চেনেন্দ্র ম্রং এর দাদা দাদি বেঁচে ছিলেন তখন গ্রামে বন্য হাতির অবাধ বিচরণ ছিল। তখন নাকি সুসং রাজা এই গ্রামে এসে হাতি বেড় দিয়ে শিকার করতেন। স্থানীয়রা হাতি ধরার কাজে সহযোগিতা করতেন অর্থের বিনিময়ে। যদিওবা এ কাজটি কোন সহজ কাজ ছিল না । তারপরও তাদেরকে হাতি ধরতে বাধ্য করা হতো। এর জন্যই নাকি গ্রামটির নামকরণ করা হয়েছে হাতিবেড়। তবে গ্রামটিতে হাতির অত্যাচার পূর্বে যেমন ছিল এখনো কমবেশি বিদ্যমান। আজ থেকে প্রায় ২৫ বছর আগে এ গ্রামে একইদিনে দ্ইুজন ব্যক্তি হাতির আক্রমণে মারা যান। এখনো যখন মাঠে ফসল বা ধান থাকে তখন দল বেঁধে বন্য হাতি এসে ধান খেয়ে যায়, ফসল নষ্ট করে, ঘরবাড়ি ভেঙ্গে রেখে যায়। বর্ষাকালে হাতির অত্যাচার কম হলেও শুকনো মৌসুমে আমন ও বোরো ধান পাকা শুরু হলে হাতির আক্রমণ বেড়ে যায়। তখন এলাকাবাসী মশাল, আগুন, বিকট শব্দের বাঁশি ও হ্যান্ডমাইক ব্যবহার করে হাতি তাড়ানোর চেষ্টা করেন।
আজ থেকে ৫৫ বছর আগে অর্থাৎ ১৯৬৮ সালে চেনেন্দ্র ম্রং প্রথমবার ভয়াবহ পাহাড়ি ঢল দেখেন। এটিই তাঁর জীবনে দেখা স্মরণীয় একটি পাহাড়ি ঢল বলে তিনি জানান। পাহাড়ি ঢলে তাঁর পরিবারের গরু ২টি, ছাগল ৩টি শুকর একটি ও হাঁস ও মুরগি ভেসে যায়। দু’টি মাটির ঘর ধসে পড়েছিলো। ১৮ মণ খোরাকী ধান পানিতে ভেসে যায়। যোগাযোগ ব্যবস্থা সব কিছু অচল হয়ে গিয়েছিল। বাজারের প্রায় দুই সপ্তাহ যাবৎ যেতে পারেননি। ফলে সে বছর খাবারের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল তাকে। ত্রাণের জন্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছিল। কষ্ট করে ত্রাণের জন্য পঞ্চায়েত প্রধানের কাছে গিয়েও ত্রাণ মিলেনি অপর্যাপ্ততার কারণে। ওই সময় এমনও দিন গেছে ত্রাণের জন্য গলা পানি পাড়ি দিয়ে গিয়ে দেখেন ত্রাণ সামগ্রী শেষ হয়ে গেছে। এভাবে অনেক দিন কষ্ট করতে হয়েছিল তাকে ও গ্রামবাসীকে।
এ পর্যন্ত মোট ৩বার ভয়াবহ পাহাড়ি ঢল দেখেছেন চেনেন্দ্র ম্রং। এই তিনটি পাহাড়ি ঢলই খুবই ভয়াবহ ছিল। এই ৩টি পাহাড়ি ঢলে অনেক কৃষিজমি বালুতে ঢাকা পড়েছে। ফসল নষ্ট হয়েছে। ঘরবাড়ি নষ্ট হয়েছে। গাছগাছালি নষ্ট হয়েছে। কৃষিকাজ ব্যাঘাত ঘটেছে। ২০২২ সাালে চেনেন্দ্র ম্রং এর ১২ কাঠা কৃষিজমি পাহাড়ি ঢলে নষ্ট হয়েছে। এখানে আর কোন ফসল করা সম্ভব হচ্ছে না। সুপারি গাছ প্রায় ১২০টি মরে গেছে, আম গাছ ৪টি, বেল গাছ একটি, পেঁয়ারা ৬টি, নারিকেল গাছ ২টি, কাঁঠাল গাছ ৬টি ও মেহগনী গাছ ২টি মারা গেছে, যা তার পারিবারিক অর্থনীতিতে ব্যপক ধাক্কা দিয়েছে। এই ৩টি পাহাড়ি ঢলের মধ্যে সব চেয়ে ভয়াবহ ছিল ১৯৬৮ সালের পাহাড়ি ঢল। এ ঢলের সময় ক্ষতির পরিমাণও বেশি ছিল বলে জানান তিনি।
আগেও পাহাড়ি ঢল বেশি হতো কিন্তু ছড়া গভীর হওয়ার কারণে সেসময় পাহাড়ি ঢলে বেশি ক্ষতি হতো না। কিন্তু এখন পাহাড়ি ঢলের সাথে আসা বালুতে সব কিছু ভরাট করে দিচ্ছে। ফসলী জমি ও ফসল নষ্ট করে দিচ্ছে। আগে শুধু পাহাড়ি ঢল হতো কিন্তু এভাবে ঢলের সাথে বালি পাথর আসতো না বলে জানান চেনেন্দ্র ¤্রং। ঢলের সাথে বালি আসার কারণ হিসেবে তিনি পাহাড়ে গাছপালা কমে যাওয়া ও ভারত সরকারের অবকাঠামো উন্নয়নকে দায়ী করেছেন। পাহাড়ে গাছপালা কমে যাওয়ার ফলে ভারি বর্ষণে পাহাড় ধস হয় যা পূর্বে হতো না। এছাড়াও ভারত সরকারের পাহাড় কেটে রাস্তা ও বিএসএফ এর ক্যাম্প নির্মাণ করাও মূল কারণ বলে জানান তিনি। অবাধে গাছ কেটে বন উজাড় করা হচ্ছে। জুম চাষের জন্য পাহাড়ে আগুন জ্বালিয়ে ঝোপঝাড় পরিস্কার করা হচ্ছে। যার ফলে পাহাড়ের বালু, পাথর বৃষ্টির পানির সাথে মিশে পাহাড়ি ঢলের সাথে চলে আসে উজান থেকে ভাটিতে। নষ্ট করে সমতলের আবাদী জমি, ফসল, বসতভিটা, ভরাট করে ছড়া, খাল ও বিল। পাহাড়ি ঢলের পূর্বে এখানকার সীমান্তবর্তী মানুষেরা তাদের বসতভিটা ও ফসলী জমি রক্ষার জন্য জাঙ্গাল বা বাঁধ নির্মাণ করেন। যাতে করে পাহাড়ি ঢলের পানি, বালু ও পাথর থেকে নিজেদেরর রক্ষা করা যায়। বাঁধের পাশে বাঁশের চারা রোপণ করা হয়, ঢোল কলমী ও অন্যান্য গাছগাছালী রোপণ করা হয়।
এছাড়া পাহাড়ি ঢলের সাথে বালি পাথর আসা বেড়ে যাওয়ার কারণে ফসলী জমি তো নষ্ট হচ্ছেই। পাশাপাশি জমির আইল (সীমানা নির্ধারণকারী) ভেঙ্গে যায় বা বালিতে ভরাট হয়ে যায়। যার ফলে জমির সীমানা নির্ধারণ করার জন্য সমস্যা সৃষ্টি। সাধুপল নামের একজনের জমির সীমানা নির্ধারণকারী আইল বালিতে ভরাট হয়ে যাওয়ায় এখন প্রভাবশালীরা তার রেকর্ডের জমি দখল করার জন্য পায়তারা করছে।
অন্যদিকে খাবার পানির সমস্যা টিউবওয়েল বসানো সম্ভব হয় না। কারণ মাটির নিচে পাথর থাকায় গভীরে নলকূপ স্থাপন করা সম্ভব হয় না। পানির জন্য ১৫ মিনিট হাটতে হয়। তাও আবার ভারতের সীমানা থেকে খাবার পানি সংগ্রহ করতে হয়। আগে বিএসএফ এর সদস্যরা সমস্যা করতো যেহেতু পানি সংগ্রহের স্থানটি ভারতের সীমানার মধ্যে। পরবর্তীতে বিএসএফ এর আলোচনা করে তা শিথিল করা হয়েছে। নারী ও পুরুষ উভয়ই পানি সংগ্রহের কাজটি করে থাকেন। ওই পানি দিয়েই আবার এ গ্রামের মানুষদের গোসলের প্রধান উৎস। যখন পাহাড়ি ঢল আসে তখন পানি ঘোলা থাকে তখন পানি পরিস্কার না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করতে হয়। অনেক সময় পানি ঘোলা থাকার কারণে গোসল করতে পারেন না এখাকার মানুষেরা। বৃষ্টি বেশি হলে বৃষ্টির পানি দিয়ে খাবার ও গোসলের কাজটি সারতে হয়।
বর্তমানে পাহাড়ি বালুতে অনেক আবাদী জমি উচু হয়ে গেছে। এর জন্য এখন ধানের বিকল্প হিসেবে ফলের ও কাঠ জাতীয় গাছের বাগান করা হচ্ছে। বালু পড়ার পরও যাদের জমি এখনো মোটামুটি আবাদযাগ্য মনে হচ্ছে তারা খুঁটি দিয়ে গর্ত করে ধানের চারা রোপন করছেন। দুই ফসলী জমি বালুর কারণে এখন এক ফসলী জমিতে পরিণত হয়েছে। যার ফলে উৎপাদনও কমে গেছে। ফলে দেখা দিচ্ছে পারিবারিক অর্থনৈতিক সংকট। পরিবারের সদস্যরা এখন ঢাকায় বিভিন্ন কোম্পানিতে কাজ করে অর্থনৈতিক ঘাটতি পূরণ করছেন।
চেনেন্দ্র ¤্রং বলেন, ‘পাহাড়ি ঢলের কারণে অনেক ক্ষতির সম্মুখিন হতে হয়েছে আমাকে। ১৯৬৮ সালের পাহাড়ি ঢলে আমাকে প্রায় নিঃস্ব করে দিয়েছিল। কিন্তু অনেক কষ্টের মাধ্যমে সেখান থেকে ঘুড়ে দাঁড়াতে সক্ষম হয়েছি। ২০২২ সালের বন্যায় আবার আমার ১২ কাঠা জমি নষ্ট হয়েছে। যে জমিই ছিল আমার ফসল উৎপাদনের একমাত্র অবলম্বন। ফসলী জমি হারিয়ে এখন আমার দুশ্চিন্তায় সময় কাটে। এখন সংসার চালাতে সন্তানদের উপর নির্ভর করতে হয়।’