চুকাই দিয়েছে হেলেনা আক্তারকে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা

চুকাই দিয়েছে হেলেনা আক্তারকে অর্থনৈতিক স্বচ্ছলতা

নেত্রকোনা থেকে সুয়েল রানা
‘চুকাই’ একটি টক্ জাতীয় উদ্ভিজ খাদ্য। এটির পাতা ও ফল সবজি হিসেবে খাওয়া হয়। নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষ টক্ পাতাকে চুকাই পাতা এবং ফলকে চুকাই বলে থাকেন। গাছে ফুল আসার আগ পর্যন্ত গাছ থেকে পাতা সংগ্রহ করে টক্ করে, ভাতের উপর দিয়ে সেদ্ধ করে ভর্তা করে, আবার কেউ কেউ পুঁটি মাছ ও শায়তান মাছসহ ছোট ছোট স্থানীয় মাছ দিয়ে টক্ ঝুল করে খায়। গ্রামাঞ্চলের প্রায় সকলের নিকট খুবই প্রিয় খাবার এটি। গাছে ফুল থেকে লাল রঙের যে ফল হয় সেটিই চুকাই ফল। চুকাই ফলও ডালের সাথে, মাছ ও মাংসের সাথে খেতে খুবই সুস্বাধু। বাজারে শুরুর দিকে ৭০/৮০ টাকা কেজি দরে চুকাই বিক্রি হয়। তবে ভরা মৌসুমে ৩০/৩৫ টাকা কেজি চুকাই বিক্রি হয়। নেত্রকোনা অঞ্চলের প্রায় প্রতিটি বাড়িতেই কম বেশি চুকাই চাষ হয়। সাধারণত বসতভিটায় এবং সবজি খেতের চারপাশে চুকাই চাষ করা হয়। বেশির ভাগ মানুষ পরিবারে খাওয়ার জন্য চুকাই এর চারা রোপণ করে থাকেন। তবে যেসকল কৃষক বসতভিটা বা সবজি ক্ষেতের চারপাশে বেশি করে চুকাই চাষ করেন তারা নিজেরা খাবারের পার উদ্বৃত্ত্ব চুকাই বাজারে বিক্রি করেন।

নেত্রকোনা জেলার আটপাড়া উপজেলার স্বরমুশিয়া ইউনিয়নের পুকলগাও গ্রামের এমনই একজন কৃষাণী হেলেনা আক্তার (৫৫), যিনি সড়কের দুই পাশের খালি জায়গায় এবং বসতভিটা ও পুকুরের চারপাশে সারি সারি করে লাল চুকইয়ের চাষ করেছেন। নেত্রকোনা থেকে মদন উপজেলায় যাবার সড়ক পথের ১২ কি.মি. যাবার পর দূর্গাশ্রম চৌরাস্তা বাজার থেকে বাম দিকে আটপাড়া উপজেলা সদরে যাবার সড়কে প্রায় তিনশত গজ যেতেই সড়কের দুইপাশে নেট দিয়ে ঘেরা সারি সারি চুকাই গাছে লাল চুকাই ফল চোখে পড়ে। গ্রামটির নাম পুখলগাও। কিছুক্ষণ থেমে বাড়ির ভিতর প্রবেশ করলে চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে। ৬ কাঠা বা ৬০ শতাংশ জমির পুকুর পাড়ের চারপাশে সারি সারি চুকাই গাছ রোপণ করা হয়েছে। পুকুরের এক কোনে ছোট টিনের ঘর। ছোট টিনের ঘরে কৃষক কৃষাণী হেলেনা আক্তার স্বামী মোঃ আলতু মিয়াসহ তিন মেয়ে নিয়ে বাস করেন। তিন ছেলে মেয়েসহ (২ ছেলে ও ৩ মেয়ে) পরিবারের মোট সদস্য সংখ্যা ৭ জন। পাঁচ ছেলে-মেয়ের বিয়ে দিয়েছেন। দুই ছেলে গাড়ির চালাক। বড় ছেলের বউ প্রবাসী। ছেলে দু’জনই আলাদা বসবাস করে। বর্তমানে স্বামীকে নিয়ে হেলেনা আক্তারের সংসার। পেশায় কৃষক স্বামী আলতু মিয়া ও হেলেনা আক্তার বিগত বিশ বছর যাবত বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে জীবিকা নির্বাহ করে আসছেন।


হেলেনা আক্তার বছরব্যাপী মৌসুমভিত্তিক বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেন। তিনি চুকাই ছাড়াও ডাটা, মূলা, মরিচ, করলা, চালকুমড়া, ধুন্দল, গোল আলু, লালশাক, পুইশাক্, বরবটি, শিম, পেঁপে, বেগুন, লাউ, মিষ্টিকুমড়া ইত্যাদি চাষ করেন। বর্ষা ও শীত মৌসুমে হেলেনা বসতভিটায় চুকাইসহ ধুন্দল, গাজর, ঢেড়স, কাকরোল, ডাটা, মরিচ, করলা, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পুইশাক, বেগুন, আখ চাষ করেছেন। হেলেনার বসতভিটায় কলা, আম, পেয়ারা, বরই রয়েছে। মাছ চাষের জন্য চাষের জমিতে পুকুর করায় সবজি চাষের জমি কমে গেছে। তিনি সেই পুকুরের চারপাশে এবং সড়কের দুইপাশে সারি সারি করে লাল জাতের চুকাই চাষ করেছেন। তথ্য সংগ্রহ করাকালীন সময় পর্যন্ত চুকাই পাতা বিক্রি করেছেন ১৫০০ টাকার এবং ১০ মণ চুকাই ফল বিক্রি করেছেন প্রায় ৮০০০ টাকায়। প্রায় ২০ মন চুকাই গাছ শুকিয়ে বর্ষা মৌসুমে রান্নার জ্বালানির জন্য্য। চলতি শীত মৌসুমে হেলেনা আক্তার লাউ, মিষ্টিকুমড়া, শিম, গাজর, ঢেড়স, কাকরোল, ডাটা, মরিচ, করলা, চালকুমড়া, পুইশাক, বেগুন, বরবটি চাষ করেছেন। তথ্য সংগ্রহকালীন সময়ে লাউ ২০০ টাকা, মিষ্টিকুমড়া ৫০০০ টাকা এবং শিম ৩০০০ টাকার বিক্রি করেছেন। সবজি চাষে তিনি রাসায়নিক সার সামান্য পরিমাণে ব্যবহার করে গোবর সার বেশি পরিমাণে ব্যবহার করেন। ফলে তার উৎপাদিত সবজি খেতে খুবই সুস্বাদু ও রোগবালাই কম হওয়ায় বাজারে চাহিদা বেশি। তিনি চাষকৃত অধিকাংশ ফসলের বীজ নিজেই সংগ্রহ ও সংরক্ষণ করেন।

চুকাই চাষ সম্পর্কে কৃষাণী হেলেনা আক্তার বলেন, “সড়কের দুই পাশ সারাবছর খালি পইড়া থাহে। মাইনসে সড়কের দারে গরু-বকরি বাইন্দা রাইক্ক্যা আমার বেড়ার দারের নানানতি খাওয়াইয়া ফেলায়। এছাড়াও আমার জমিন না থাহায় আমি সড়কের দারের খালি জায়গা স্বামীরে নিয়া কোদাল দিয়া চাষ কইরা বর্ষাকালে চুহাই চারা লাগাইছি। গরু-বকরি থাইক্কা বাঁচানের লাইগ্যা জাল দিয়া সড়কের পাশ বেড়া দিসি। গাছ বড় হইলে বোটাসহ চুকাই পাতা মুট কইরা বাইন্দা বাজারে বেচনের লাইগ্যা পাঠাইসি।’ তিনি আরও বলেন, ‘চুহাই গাছে ফুল আইতে লাগলে, চুহাই পাতা আর পাইরা বেচিনা। তহন পাতা পারলে চুহাই ফল বড় অয়না। চুহাই ফল বড় অইলে চুহাই কেজি হিসাবে বেচছি। আলি (বীজ) রাহনের লাইগ্যা কিসু চুহাই পাহাইসি। চুহাই বেচা শেষ অইলে গাছগুলা কাইট্টা শুহাইয়া বর্ষাকালে বাত (ভাত) রান্দনের লাইগ্যা জমাইয়া রাখসি। চুহাই চাষের মেলা সুবিধা আছে। চুহাই এর জন্যে সার দিওন লাগেনা। মাকড়া ছাড়া তেমন কোন পোহা-মাহড় ধরেনা। গাছ দেড়-দুই ফ্টু অইলেই চুহাই পাতা বেইচ্চা নানাদা করন যায়। আটপাড়া এলাকার মাইনসে এইবার আমার চুকাই খাইসে। হেলো বছর (২০২০) আমি এই একই জমিকে থাইক্যা প্রায় পয়ত্রিশ হাজার টাকার চুহাই পাতা আর চুহাই ফল বেচছিলাম। আমি চুহাইয়ের আলি আরেক সিজিনের লাইগ্যা রাখসি। নিজে লাগানের পর মাইসেরে আলি দিমু, যাতে তারাও এক দুইডা কইরা লাগাইতো পারে।’
কৃষাণী হেলেনা আক্তার পরিবেশবান্ধব উপায়ে স্বল্প খরচে বৈচিত্র্যময় খাদ্য নিরাপদ উপায়ে উৎপাদন করে নিজ পরিবারের উন্নয়নে গ্রামীণ নারীদের জন্য অনুকরণীয়। যেখানে গ্রামাঞ্চলের অনেক পুকুর পাড় অচাষকৃত বা অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে থাকে, সেখানে কৃষাণী হেলেনা আক্তার স্বামী আলতু মিয়াকে নিয়ে পুকুর পাড়ের সামান্য জমিতে ও সড়কের ধারে চুকাইসহ বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে এবং পুকুরের মধ্যিখানে (শুষ্ক মৌসুমে-বোরো মৌসুমে) ধান চাষের জন্য ব্যবহার করছেন। তিনি ভিটা ও পুকুর পাড়ের (১২ শতাংশ) প্রতিটি ইঞ্চি জমি ব্যবহার করার চেষ্টা করছেন। বারসিক তাকে চাষাবাদ সম্পর্কিত বিভিন্ন পরামর্শ ও সামান্য পরিমানে বৈচিত্র্যময় সবজি বীজ দিয়ে সহযোগিতা করেছেন। কৃষাণী হেলেনা আক্তারের মত সকল গ্রামীণ নারীরা যদি নিজ নিজ বসতভিটার প্রতিটি ইঞ্চি মাটিতে বৈচিত্র্যময় সবজি ও ফলের চাষ করেন, তাহলে পরিবারের সদস্যদের পুষ্টির চাহিদা যেমন পূরণ হবে তেমনি উদ্বৃত্ত্ব সবজি ও ফল বিক্রি করে পরিবারের অন্যান্য চাহিদা নারীরা নিজেরাই পূরণে সক্ষম হবে। নারীদের আয়বৃদ্ধির মাধ্যমে নারীদের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং পরিবারে ও সমাজে নারীদের মর্যাদা বৃদ্ধি পাবে। পরিবারের সদস্যদের দৈনন্দিন খাদ্য ও অন্যান্য প্রয়োজনে পরিবার প্রধান পুরুষদের উপর নারীদের নির্ভরশীলতা অনেকটা হ্রাস পাবে। নারীদের সক্ষমতাও বৃদ্ধি পাবে।

happy wheels 2

Comments