বীজের সহজলভ্যতা নিশ্চিত করে বীজঘরগুলো
নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
বারসিক’র উদ্যোগে গতকাল ‘করোনাকালীন সময়ে চাষাবাদে বীজঘরের ভূমিকা’ শীর্ষক এক অনলাইন আলোচনা সভা অনুষ্ঠিত হয়েছে। উক্ত সভায় অংশগ্রহণ করেন নেত্রকোণা অঞ্চলের বিভিন্ন এলাকার বীজঘর, বীজবাড়ির কৃষক কৃষাণীগণ। এছাড়াও অংশগ্রহণ করেন নেত্রকোণা অঞ্চলের বারসিক’র সকল কর্মকর্তা এবং বারসিক ঢাকা অঞ্চলের কৃষিবিদ এ.বি.এম তৌহিদুল আলম ও সৈয়দ আলী বিশ্বাস। আলোচনা অনুষ্ঠানটি সঞ্চালনা করেন বারসিক নেত্রকোণা অঞ্চলের কর্মসূচি কর্মকর্তা হেপী রায়।
অনুষ্ঠানের শুরুতে এই আয়োজনের লক্ষ্য ও উদ্যেশ্য এবং বীজঘর বা বীজবাড়ি গড়ে উঠা সম্পর্কে আলোচনা করেন সৈয়দ আলী বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘আমাদের কৃষকরা নিজেদের পরিবারের বীজ নিজেরাই সংরক্ষণ করেন। তবে বীজ সংরক্ষণ করতে গিয়ে সমস্যায় পড়েন বর্গা চাষীরা। কারণ প্রতিবছর তাঁরা কি পরিমাণ জমি চাষ করবেন তা নির্ভর করে জমির মালিকের উপর। তাছাড়া আমাদের দেশে বিভিন্ন প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসল নষ্ট হয়, বীজ সংকট দেখা দেয়। বিভিন্ন কোম্পানি তখন সেটাকে পুঁজি করে বাজারে বীজ বিক্রি করা শুরু করে। ফলে প্রয়োজনীয় বীজ আমরা পাইনা। কৃষকের চাহিদা, আকাঙ্খা অনুযায়ী ফসল চাষ করতে পারেনা।’ তিনি আরও বলেন, ‘হাইব্রিড’ বন্ধ্যা বীজ, ফসল ফলানো যায় কিন্তু বীজ সংরক্ষণ করা যায় না। এই বীজগুলো মানসম্মত নয়। প্রচুর রাসায়নিক সার, কীটনাশক ব্যবহারে জমির উর্বরাশক্তি নষ্ট হয়। এ সমস্ত বিভিন্ন সমস্যার কারণে বীজের সংকট মোকাবেলার জন্য কৃষকের চাহিদার ভিত্তিতে বীজ সংরক্ষণের প্রয়োজনীয়তা দেখা দেয়। এই সমস্যা সমাধানে কৃষকদের সহযোগিতায় তখন এগিয়ে আসে বারসিক। নেত্রকোণা অঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামে বীজমেলার আয়োজন করা হয়। সেখান থেকে নানা ধরণের বীজ সংগ্রহ করে আগ্রহী কৃষকের বাড়িতে বীজ ঘর গড়ে উঠে। এই বীজঘর থেকেই নিজ গ্রাম ও আশেপাশের বিভিন্ন গ্রাম থেকে কৃষক কৃষাণীরা তাঁদের চাহিদামতো বীজ সংগ্রহ করে চাষ করতে শুরু করেন। একজন কৃষকের এই ধরণের উদ্যোগে উৎসাহী হয়ে অন্যান্য গ্রামেও বীজঘর গড়ে উঠে। বর্তমানের করোনা পরিস্থিতিতেও এই বীজঘর বীজ সমস্যা সমাধানে ভূমিকা রাখছে। কৃষকদের বীজ সম্প্রসারণের বিষয়ে জানাবোঝার জন্যই আজকের এই আয়োজন।’
করোনা পরিস্থিতিতে বীজ বিনিময়, আগামী মৌসুমে কৃষকের বীজ চাহিদা ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন এলাকার কৃষকগণ তাঁদের আলোচনা উপস্থাপন করেন। এ বিষয়ে আমতলা ইউনিয়নের পাঁচকাহনিয়া গ্রামের কৃষক মো. বায়েজিদ বলেন, ‘আমন মৌসুমে আমরার এলাকায় ৫ জন, পার্শ্ববর্তী শাপমারা গ্রামের ৩ জন ৫ ধরণের ধানের বীজ নিয়া গেছে। তার মধ্যে সুবাশ ও কাবুÐুলান ধানের চাহিদা বেশি ছিল। এছাড়া পিটুয়া ও বিশ্বনাথপুর গ্রামের কৃষকরাও ধানের বীজ নিয়া যায়। সব্জীর মধ্যে পুঁইশাক, মিষ্টিকুমড়া, টমেটো, করলা ইত্যাদির বীজ তারা নিয়া চাষ করে। আমরার বীজঘরে যে পরিমাণ বীজ আছে তা দিয়া কৃষকের চাহিদা পূরণ করা যায়।’
কলমাকান্দা উপজেলার কৃষক মো: মোতালিব বলেন, ‘আমার এলাকায় বিশালী বিন্নি, রাঁধুনী পাগল জাতের ধানের চাহিদা বেশি। কিন্তু বীজ সংকটের কারণে চাহিদামতো তাদের বীজ দিতে পারিনা। তবে সব্জী বীজের সংকট নাই। ঢেঁড়স, পাটশাক, কলমীশাক, পুঁইশাক, ডিমবেগুন, বারোমাসী মরিচ, চালকুমড়া ইত্যাদি বীজ নিজে চাষ করি ও অন্যদের মাঝে বিতরণ করি।’ তিনি বারসিক’র নিকট শীতকালীন সব্জী হিসেবে দেশিলাউ বীজের সহযোগিতা প্রত্যাশা করেন।
কেন্দুয়া উপজেলার কৃষাণী রোকেয়া আক্তারের বীজঘরে ১০ ধরণের ধান বীজ, ২০ধরণের সব্জী বীজ ও ১০ ধরণের শিম বীজ আছে। তিনি বলেন, ‘এসকল বীজ আমি নিজে চাষ করি, সংরক্ষণ করি ও অন্যদের মাঝে বিতরণ করি। এছাড়া চালকুমড়া, বারোমাসী মরিচ, টমেটো ইত্যাদি বীজও আছে। ধানের বীজের মধ্যে সুবাশ, কালিজিরা, মালা, তুলসীমালা এই বীজের চাহিদা বেশি। অনেক কৃষক আমার বীজঘর থেইক্যা এইগুলা নিয়া চাষ করে।’
মদন উপজেলার কৃষাণী রহিমা আক্তার তাঁর বীজঘরে বিভিন্ন ধরণের সব্জী বীজ সংরক্ষণ করেন। এসবের মধ্যে রয়েছে শিম, বেগুন, চালকুমড়া, মিষ্টিকুমড়া, পালংশাক ইত্যাদি। তিনি আগামীতে চাষ করার জন্য শিম এবং মরিচ বীজের চাহিদা প্রদান করেন।
কলমাকান্দা উপজেলার আরেকজন কৃষাণী সলিতা চিসিম জানান, তিনি তাঁর নিজ গ্রামের ৬জন কৃষকের মাঝে বিশালী বিন্নি, লালবিরই, মালশিরা ও কাবুÐুলান জাতের ধান বীজ বিতরণ করেন। সব্জী বীজের মধ্যে বারোমাসী মরিচ, ডিমবেগুন, চালকুমড়া, শিম, পাটশাক, মিষ্টিকুমড়া, ডাটা, ঢেঁড়স, পুঁইশাক ইত্যাদি বীজ বিতরণ করেছেন এবং তিনি নিজেও চাষ করেছেন।
আটপাড়া উপজেলার মৎস্যজীবি সংগঠন ‘জানমা’র সভাপ্রধান যোগেশ দাস তাঁর বাড়িতে মৎস্য জাদুঘর বা তথ্যকেন্দ্র প্রতিষ্ঠা করার উদ্দেশ্য সম্পর্কে আলোচনা করেন। এ বিষয়ে তিনি বলেন, ‘আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে মৎস্য সম্পদের সমৃদ্ধ ভাণ্ডার তুলে ধরার জন্য আমি মৎস্য জাদুঘর স্থাপন করছি। তাছাড়া অত্র এলাকার বিভিন্ন মাছের স্মৃতি ধরে রাখাও আমার একটা উদ্যেশ্য।’
লক্ষীগঞ্জ ইউনিয়নের কৃষাণী মালা আক্তার নিজ বাড়িতে মিষ্টিকুমড়া, চিচিঙ্গা, চালকুমড়া, পাটশাক, ডাটা, কাঁকরোল, পুঁইশাক, মরিচ, শশা ইত্যাদি চাষ করেন বলে জানিয়েছেন। এই সকল বীজ তিনি নিজে সংরক্ষণ করেন। এই মৌসুমে তিনি প্রায় ১৫ জনের মাঝে ৬ ধরণের সব্জী বীজ বিতরণ করেছেন।
আলোচনার এক পর্যায়ে বারসিক নেত্রকোণা অঞ্চলের জাত গবেষণা কাজে সম্পৃক্ত বারসিক কর্মকর্তা সুমন তালুকদার রিসোর্স সেন্টারে সংরক্ষিত বিভিন্ন ধরণের বীজ, ধানজাত গবেষণার বর্তমান অবস্থা সম্পর্কে আলোচনা করেন।
কৃষিবিদ তৌহিদুল আলম বলেন, ‘বারসিক দীর্ঘদিন যাবৎ বীজের উপর কৃষকের অধিকার সংরক্ষণে কাজ করছে। শুধু বীজ বিনিময় নয়, এটার সাথে কৃষকের অধিকার, সার্বভৌমত্ব, বিশাল বড় বাজার জড়িত আছে। এটা সকলের অনুধাবন করতে হবে। যারা অনুধাবন করতে পেরেছেন তাঁরা সংরক্ষণ ও চাষ করছেন। অনেকেই সংরক্ষণ করেন বলে আমরা অন্য এলাকায় বীজ দিতে পারি।’
তিনি আরও বলেন, ‘আধুনিক কৃষির বিপরীতে আমরা (বারসিক) কাজ করি। আমরা কৃষকের অধিকার ফিরিয়ে দিতে চাই। একটা বীজ সংগ্রহ করতে অনেক কষ্ট, অনেক সংগ্রাম করতে হয়। এটা সকলকে বুঝতে হবে। আমরা কৃষকদের পাশে থেকে তাঁদের উদ্বুদ্ধ ও সহযোগিতা করছি। পোকামাকড়ের আক্রমণ, প্রাকৃতিক দূর্যোগ ইত্যাদি কারণে অনেক ধরণের বীজ সংরক্ষণ করা সম্ভব হয়না। তাই অনেকের চাহিদা আমরা পূরণ করতে পারিনা। আমাদের মতো যদি এরকম অন্যরাও কাজ করতো তাহলে সমস্যার সমাধান হতো”।
অনলাইনে এই ধরণের আলোচনাটিকে তিনি সময়োপযোগি বলে উল্লেখ করেন। আলোচনার প্রেক্ষিতে গঠনমূলক পরামর্শও প্রদান করেন। নেত্রকোণা রিসোর্স সেন্টাওে যত ধরণের বীজ আছে সেগুলোর ডকুমেন্টেশন, ডাটাবেজ, সংগ্রহশালা তৈরির কথা বলেন। কেন্দুয়া উপজেলার নগুয়া গ্রামের কৃষাণী রোকেয়া আক্তারের নিকট থেকে ১০ধরণের মরিচ বীজ সংগ্রহ করে চাষ করার বিষয়ে জোর দেন। ধান জাতের পাশাপাশি সব্জী নিয়ে গবেষণা প্লট করে চাষাবাদ করা, ব্রিডিং এর জন্য নতুন কোনো কৃষককে প্রশিক্ষণ প্রদান, নেত্রকোণা এলাকার বীজঘরগুলো পরিদর্শন, নতুন জাতের বীজ সংগ্রহ, ২০০৫ সাল থেকে অদ্যাবধি বীজ বিনিময়ের তালিকা তৈরী ইত্যাদি বিষয়েও গুরুত্বারোপ করেন।
আলোচনার শেষ পর্যায়ে বারসিক নেত্রকোণা অঞ্চলের সমন্বয়কারী মো: অহিদুর রহমান বলেন, “অনেক পথ অতিক্রম করে আমরা আজকের এই জায়গায় পৌঁছেছি। যে কারণে আমাদের অঞ্চলে ৬টি বীজঘর, ২১টি বীজবাড়ি ও তথ্যকেন্দ্র গড়ে উঠেছে। প্রতিটি কেন্দ্র একটি গবেষণাগার, প্রদর্শনী কেন্দ্র। এটা কৃষকের নিজস্ব অধিকারের জায়গা, প্রচারণার জায়গা। এই কেন্দ্রগুলো বাংলাদেশসহ অন্যান্য দেশের বিভিন্ন শ্রেণি পেশার লোকজন এসে পরিদর্শন করে গেছেন। রিসোর্স সেন্টারেও বিভিন্ন গ্রামের কৃষকগণ ও প্রশাসনের লোকজন এসে তাঁদের পছন্দমতো বীজ নিয়ে যায়। আমাদের উচিত হবে এই ধরণের কার্যক্রম গুলোকে আরো সক্রিয় ও সম্প্রসারিত করা। সবশেষে তিনি আলোচনায় অংশগ্রহণকারী সকলকে ধন্যবাদ জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।