দরুণবালির নারীরা কান্না ছাড়াই রান্না করছেন
রুখসানা রুমী ও মাহাবুব আলম
জলবায়ু পরিবর্তন, প্রাকৃতিক বিপর্যয়, বায়ু দূষণ ও চারপাশের পরিবেশ বিপন্নতার মাঝেও নেত্রকোনা সদর উপজেলার কাইলাটি ইউনিয়নের দরুণ বালি গ্রামের অক্সিজেন যুব সংগঠন, রাখালবন্ধু কৃষক সংগঠন, ফুল-পাখি কিশোরী সংগঠন, জৈব চাষী দল, নেত্রকোনা শিক্ষা-সংস্কৃতি-পরিবেশ ও বৈচিত্র্য রক্ষা কমিটির যৌথ উদ্যোগে এবং বারসিক’র সহযোগিতায় দরুণবালি গ্রামকে সবুজ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার ঘোষণা মধ্য দিয়ে ২০১৯ সালে সবুজ গ্রামের কার্যক্রম আরম্ভ করা হয়। গ্রাম সবুজায়নের অংশ হিসেবে সংগঠনগুলো ২০১৯ সাল থেকে গ্রামের প্রত্যেক বাড়িতে দু’টি করে সাজনা গাছ রোপণ, গ্রামে বায়ু দূষণ রোধে পর্যায়ক্রমে ধোয়াবিহীন, জ্বালানি সাশ্রয়ী, নবায়নযোগ্য ও পরিবেশবান্ধব ৪০টি চুলা বিতরণ, পলিথিন ব্যাগ বর্জনে পরিবেশবান্ধব পাট ও কাপড়ের ব্যাগের ব্যবহার বৃদ্ধিতে ১০০টি পরিবারে ব্যাগ বিতরণ, বাল্যবিয়ে বন্ধে এবং মাদকমুক্ত যুব সমাজ গঠনে যুব, কিশোরী ও অভিভাবকদের সাথে নিয়মিত সভা আয়োজন, পাখির প্রতি ভালোবাসা প্রকাশ ও পাখির নিরাপদ আশ্রয় সৃষ্টিতে গ্রামের গাছে গাছে মাটির কলসি বেঁধে দেওয়া, জৈব ও পরিবেশবান্ধব উপায়ে নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনে কৃষকদের উদ্বুদ্ধকরণে কৃষক পরিবারের মধ্যে কেঁচো কম্পোস্ট তৈরির বিভিন্ন উপকরণ বিতরণ করেছে।
এছাড়াও নেত্রকোনার বৃক্ষ প্রেমিক ও আর্ত মানবতার সেবক নামে পরিচিত কবিরাজ আব্দুল হামিদের সহযোগিতায় গ্রামের কৃষক-কৃষাণী, যুব ও কিশোর-কিশোরীদের মধ্যে এ পর্যন্ত বিনামূল্যে (৩৩০টি) ঔষধি গাছের চারা বিতরণ করা হয়েছে। মধু চাষি ও প্রবীণ জৈব চাষি ও উদ্যোক্তা গোলাম মোস্তফা মধু দরুণবালি গ্রামে বৈচিত্র্যময় সবজি ও ফলের চাষ বৃদ্ধি এবং মৌ চাষের মাধ্যমে সবজি ও ফলের উৎপাদন বৃদ্ধির জন্য কৃষক-কৃষাণীদেরকে মৌমাছি পালনের উদ্বুদ্ধ করতে বিনামূল্যে মধু বিতরণ করেন। গ্রামের একজন জৈব চাষি ও শতবাড়ি মডেলের আদর্শ কৃষক কালাচাঁন মিয়া আগ্রহী কৃষকদেরকে কেঁচো কম্পোষ্ট উৎপাদনের জন্য বিনামূল্যে কেঁচো দিয়ে সহযোগিতা করছেন। সংগঠনগুলো আগামি বছরগুলোতে গ্রামের প্রতিটি পরিবার, রাস্তার ধারে, শিক্ষা ও ধমীয় প্রতিষ্ঠান এবং বাজারের খালি জায়গায় ৫০০টি নিম গাছের চারা রোপণ এবং প্রতিটি পরিবারে জ্বালানি সাশ্রয়ী ও ধোয়াবিহীন চুলা ব্যবহার নিশ্চিতকরণে চুলা বিতরণের পরিকল্পনা হাতে নিয়েছে। এজন্য সংগঠনগুলো নিজেরা নিমের চারা উৎপাদনের উদ্যোগ নিয়েছে। বাল্যবিয়েমুক্ত, মাদকমুক্ত যুব সমাজ গঠন, ভিক্ষুকমুক্ত, মৌমাছি, ব্যাঙ, কেঁচো ও পাখি কলকাকলিতে মূখরিত, পলিথিনমুক্ত, জৈব কৃষি ও ক্লিনিং কুকিং সবুজ গ্রাম হিসেবে গড়ে তোলার সমন্বিত উদ্যোগ নিয়েছে দরুণবালি গ্রামের যুব, কিশোর-কিশোরী, কৃষক ও কৃষাণী সংগঠনগুলো।
২০১৯ সালে প্রথম দরুণবালি গ্রামের দু’টি রান্না ঘরকে মডেল হিসেবে করা হয়েছিল পরিচ্ছন্ন রান্না ঘর। এর অন্যতম উদ্দেশ্য ছিল পরিছন্ন রান্না ঘরের মডেল দেখে গ্রামের অন্য পরিবারগুলোও ধীরে ধীরে উদ্বুদ্ধ হবে ক্লিনিং কুকিং এ। অক্সিজেন যুব সংগঠন, ফুল-পাখি কিশোরী সংগঠন’র সদস্যরা গ্রামের শতভাগ পরিবারে পরিবেশবান্ধব চুলার ব্যবহার নিশ্চিতকরণে বারসিক’র সহযোগিতায় ধাপে ধাপে ধোয়াবিহীন উন্নত চুলা বিতরণ করে আসছে। এরই ধারাবহিকতায় সংগঠনগুলো বারসিক’র সহযোগিতায় ৭ জুলাই, ২০২১ ইটকল ভর্তুকিতে এএসপিএস সংস্থা উদ্ভাবিত জ্বালানি সাশ্রয়ী ধোয়াবিহীন পরিবেশবান্ধব ৩০টি চুলা দরুণবালি গ্রামের ত্রিশটি পরিবারের মধ্যে বিতরণ করা হয়। এ নিয়ে বর্তমানে দরুনবালি সবুজ গ্রামের ৭০টি পরিবারের নারী পরিবেশবান্ধব ধোয়াবিহীন জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলা ব্যবহার করছে।
চুলা বিতরণকে কেন্দ্র করে যুব ও কিশোরী সংগঠনগুলোর উদ্যোগে পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহারের উপকারিতা ও ব্যবহার কৌশল সম্পর্কে দিনব্যাপী এক প্রশিক্ষণ কর্মশালার আয়োজন করা হয়। এএসপিএস সংস্থার ট্যাকনিকেল কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেন প্রশিক্ষণটির সঞ্চালক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন। ট্যাকনিকেল কর্মকর্তা বিল্লাল হোসেনের আলোচনা থেকে গ্রামের নারীরা পরিবেশবান্ধব চুলা ব্যবহারের পরিবেশগত ও স্বাস্থ্যগত উপকারিতা, চুলা ব্যবহার কৌশল ও ব্যবস্থাপনা সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে সক্ষম হয়েছেন। বাংলাদেশের গ্রামীণ জীবনে সবেমাত্র আধুনিকতার ছোঁয়া লাগতে আরম্ভ করেছে। গ্রামাঞ্চলে কৃষি ক্ষেত্রে আধুনিক যান্ত্রিক উপকরণ ব্যবহার বৃদ্ধি পাওয়ায় উৎপাদন বৃদ্ধি পেয়েছে। গৃহস্থালীর কাজসমূহে বিশেষভাবে রান্নার কাজে গ্রামের বিত্তশালী পরিবারগুলো গ্যাস সিলিন্ডার ব্যবহার করলেও নি¤œ আয়ের পরিবারগুলো রান্নার কাজে প্রচলিত লাকড়ির চুলাই ব্যবহার করে আসছে। ফলে গ্রামের নারীদেরকে দৈনিক তিন বেলার রান্নার কাজের দিনের অধিকাংশ সময় অতিবাহিত হয়। বাকী সময়টা ব্যয় হয় জ্বালানি (লাকড়ি, খড়, পাতা ও গুটে তৈরিতে) সংগ্রহের কাজে। ফলে গ্রামীণ নারীদের জীবন থেকে যাচ্ছে ধীরগতির। রান্নার সময়, অর্থ, শ্রম ও জ্বালানি ইত্যাদি সাশ্রয় করে যদি প্রতিদিনের কাজ করা যায়, তবেই গ্রামীণ জীবনেও গতিশীলতা আসবে, পাশাপাশি নারীদের উদ্ভাবিত প্রযুক্তির মূল্যায়নের মাধ্যমে নারীর কাজের স্বীকৃতি পাবে।
দরুণবালি গ্রামের কৃষাণী রোকেয়া আক্তার বলেন, ‘বাংলাদেশ অহন ডিজিটাল অইছে, সব কিছুই এহন সহজ। আমরা পিছাইয়া থাকব ক্যারে? সারা দিন আমরার কত কাম-কাজ করন লাগে। আমরার তো সেই সুবিধা নাই। লাকড়ি যোগাড় করো, চুলা জ্বালাও, কর কাম। রানতে রানতেই দিন শেষ। তারপর আছে ধোঁয়ার সমস্যা। পরিবেশবান্ধব চুলায় খুব তাড়াতাড়ি রান্ধা অয়, লাকড়িও কম লাগে। বড় সুবিধা অইছে ঘরের ভিতর ধোঁয়া অয়না আর রান্ধনের সময় চোখ জ্বলেনা, কাঁশিও অয়না।’
কিশোরী সংগঠনের নেত্রী রতœা আক্তার বলেন, ‘প্রচলিত চুলায় ভাত রান্না করতে সময় লাগে ২২-২৫ মিনিট। আর পরিবেশবান্ধব এই উন্নত চুলায় সময় লাগে সর্বোচ্চ ১৫ মিনিট। তরকারি রান্নায় প্রচলিত চুলায় সময় লাগে ২০ মিনিট আর এ চুলায় মাত্র ১০-১৪ মিনিট। লাকড়িও লাগে খুব কম। উন্নত চুলায় একবার ভাত, তরকারি রান্নার জন্য মাত্র ৫ কেজি লাকড়ির প্রয়োজন হয়। প্রচলিত মাটির চুলায় লাকড়ি লাগে প্রায় দ্বিগুণ এবং ধোয়াও বেশি হয়।’
পরিবেশবান্ধব জ্বালানি সাশ্রয়ী চুলায় সময় ও অর্থ সাশ্রয় যেমন হয়, তেমনি ধোয়া কম হওয়ায় চুলায় কালি হয়না। একটি পাইপ বা নলের সাহায্যে ধোঁয়া বাইরে বের হয়ে যায়। শুধুমাত্র পাতিলের নিচের অংশে আগুনের তাপ লাগে। চুলা থেকে আগুন বাইরে বের হতে পারেনা বলে কালি হয়না। পাতিলের নিচের অংশে কালি জমেনা বলে প্রতিদিন পাতিল মাজতে হয়না, পরিশ্রম কম হয়। ঘরে ধোঁয়া হয়না বলে কোনো রোগ বালাইয়েরও আশংকা নেই। ঘরে বা কাপড়ে কালি জমেনা, চোখ জ্বালা করেনা, হাঁচিও আসেনা। রান্নাঘর থাকে সব সময় পরিষ্কার পরিছন্ন। জ্বালানি সাশ্রয়ী ও পরিবেশবান্ধব এই চুলায় যে কোনো ধরণের জ্বালানি ব্যবহার করা যায়। ফলে পরিবেশ দূষণ বিশেষভাবে বায়ু দূষণ রোধ হয় এবং নারীরা ধোয়া জনিত কারণে সৃষ্টি বিভিন্ন স্বাস্থ্যগত সমস্যা যেমন- হাচি-কাঁশি, চোখ জ্বালাপোড়া, শ্বাসকষ্ট ইত্যাদি সমস্যা থেকে রক্ষা পাচ্ছে। দরুণবালি গ্রামের যুব, কিশোরী ও কৃষক সংগঠনের সবুজ গ্রাম সৃজনের গৃহীত উদ্যোগ সত্যি প্রশংসনীয়। দরুনবালি গ্রামের যুব, কশোরী ও কৃষক সংগঠনের উদ্যোগ বাস্তবায়িত হলে গ্রামের প্রকৃতি হবে কোমল ও সবুজ। গ্রামের পরিবেশ হবে নির্মল এবং মানুষের বসবাসের উপযোগি।