প্রকৃতির ফেরীওয়ালা

রাজশাহী থেকে মো. শহিদুল ইসলাম শহিদ ও রবিউল

‘প্রকৃতির ফেরীওয়ালা’ গড়ে উঠেছে নওগাঁর মান্দা উপজেলার চারটি গ্রামে। গ্রাম চারটি হলো মশিদপুর, ভেড়ী দুর্গাপুর, খাগড়া ও চাকদহ্। তাদের ফেরী দোকানের উপকরণ যোগান দিয়ে থাকে পার্শ্ববর্তী একটি বিল। বিলকে কেন্দ্র করে আশেপাশে হাজারের অধিক জেলে পরিবার বসবাস করেন। যাদের জাল দড়ি আছে তারা মাছ ধরেই জীবিকা নির্বাহ করেন। তবে তাদের মধ্যে অনেকেরই জাল দড়ি কেনার সামর্থ নেই। কিন্তু বিলকে কেন্দ্র করেই তাদের জীবনযাপন। তাই জেলে সম্প্রদায়ের অসহায় মানুষেরা বিলে জন্মানো জলজ উদ্ভিদ, ফুল ও ফল সংগ্রহ করে বেছে নিয়েছেন ফেরিওয়ালার জীবন।

img_20161130_114323
এলাকার মানুষের কাছে বিলটি ‘আন্ধাসুরা’ নামে পরিচিত। কেন এই আন্ধাসুরা জানতে চাইলে স্থানীয় ইউপি সদস্য মো. মোসলেম উদ্দিন (৫৮) বলেন, ‘আগের মানুষরা মনে করতেন ও বলতেন বিলের পানি সব সময় কালো অন্ধকার থাকতো। এ বিলটির সাথে ঐতিহাসিক কুসুম্বা দিঘীর সুড়ঙ্গ পথে সম্পর্ক আছে। তাই আন্ধার ও সুড়ঙ্গ  মিলিয়ে বিলটিকে ‘আন্ধাসুড়া’ নামে ডাকতেন।’ এ প্রসঙ্গে কুসুম্বা গ্রামের নাজিম উদ্দিন (৫৫) বলেন, ‘বিলের পানি যে সময় কালো থাকতো তখন দিঘীর পানিও কালো হতো। ঘোলা হলে একই সাথে ঘোলা হতো এমন কথাও বলতে দেখেছি।’ স্থানীয় বিলের পাড়বাসী বাদশা (৬০) বলেন, ‘আমাদের বিলটিতে শালুক, ভ্যাট, নইকা, লাইল (শাপলা), পদ্ম, শিংগাড়, লিখাড়, ঘেচুল ও কষ্টি পাওয়া যায়। ছেলে মেয়েদের সংগ্রহ করে আস পাশের বাজারে বিক্রি করতে দেখি।’

জেলে আব্দুস সাত্তার (৫৭) বলেন, ‘বিগত পাঁচ ছয় বছর আগে থেকে সরকার বিলটি টেন্ডার দিয়েছেন। টেন্ডার দিলেও মাছ ধরতে বাধা দেয় না, তবে মাছের ভাগ দিতে হয়। প্রাকৃতিক মাছের অর্ধেক এবং ছেড়ে দেয়া মাছ ধরলে শতকরা বিশ টাকা আমরা পাই। কিন্তু জলজ উদ্ভিদ সংগ্রহকারীদের কোন ভাগ দিতে হয় না।” তিনি জানান, এলাকার ৩৫-৪০ জন ছেলে মেয়ে, বিধবা ও বৃদ্ধ অসহায় মানুষদের এসব বিক্রি করতে দেখা যায়। শুধু তাই নয় পাশের তানোর ও নিয়ামতপুর উপজেলার কিছু মানুষ এসে সংগ্রহ করে বিক্রি জন্য। আবার কেউ বেড়াতে এসে খাওয়ার জন্য তুলে নিয়ে যায়। শতাধিক মানুষ এসব জিনিস ফেরি করে বিক্রি করে।

img_20160713_124228
দুর্গাপুর রোস্তমের ছেলে সোহরাফ (১৬) স্থানীয় তালন্দ বাজারে এসব উপকরণ বিক্রি করার সময় বলেন, ‘আমরা তিন মাস এসব জিনিস বিক্রি করতে পারি। প্রতিদিন সংগ্রহ করি ও আশপাশের বাজারে ২০০-২৫০ টাকা পর্যন্ত বিক্রি করতে পারি।’ শহরে এগুলো বিক্রি করেন কিনা জানতে চাইলে বলেন, ‘যাওয়া আসায় আমাদের অনেক টাকা খরচ হয়ে যায় পত্তাও হয়না। তাই স্থানীয় বাজারেই বিক্রি করে থাকি।’

অতীতে বরেন্দ্র অঞ্চলের অধিকাংশ পুকুরগুলোতে পদ্ম, শাপলা, শিংগাড়সহ অনেক জলজ উদ্ভিদ প্রকৃতির নিয়মেই জন্মাতে দেখা যেত। এসব নিয়ে ছেলে মেয়েরা মালা গেঁথে খেলা করতো। বিভিন্ন অনুষ্ঠানে পদ্মা পাতায় খাবার পরিবেশনও করা হতো। এমনকি কিছু কিছু হোটেলেও পদ্ম পাতায় ভাত খাওয়ানো হতো। যেসব পুকুর ও জলাশয়ে জলজ উদ্ভিদ থাকতো পানি হতো কাঁচের মত পরিস্কার। আর সেখানে লুকিয়ে থাকতো দেশী প্রজাতির রকমারী মাছ। স্থানীয় ও অতিথি পাখি এসে সেসব উদ্ভিদ থেকে খাবারও সংগ্রহ করতো। কিন্তু কালের বিবর্তনে হারিয়ে যেতে বসেছে ওই সকল উদ্ভিদ। এখন তাই বলা যায়, প্রকৃতির দৃশ্য যেন ফুলদানীতেই শোভা পায়।

শিবনদীর ধার ঘেঁষা আন্ধাসুরা বিলটি কৃত্রিমভাবে নয়, প্রাকৃতিকভাবেই ধরে রেখেছে প্রকৃতির সৌন্দর্য্য। কিন্তু বর্তমানে এসব উপকরণ চাহিদার তুলনায় অপ্রতুল। কারণ অন্যান্য এলাকায় তেমনটি আর চোখে পড়েনা এ সকল জলজ খাবারগুলো। অনেকের কাছে এগুলোর নাম পর্যন্ত অপরিচিত। এছাড়া পানিতে জন্মানো এগুলো উদ্ভিদ ও উদ্ভিদের ফুল ফলকে কেন্দ্র করে শত শত লেখক কবিদের মুল্যবান লেখাও রয়েছে। প্রকৃতি থেকে এসব উপাদান দিন দিন যেভাবে হারিয়ে যাচ্ছে তাতে একসময় নতুন প্রজন্মের কাছে সেগুলো উদ্ভিদ অপরিচিত থেকে যাবে। যে সব প্রাকৃতিক উপাদানের সাথে মানুষের পরিচিতি থাকে না, সেই সব প্রাকৃতিক উপাদান নিয়ে কোন লেখা ও কবিতা পড়ে পাঠকরা মজাও পান না। আর ঠিক তখনি পাঠকরা অতীতের মহা লেখক ও কবিদের লেখার প্রতি দিন দিন আগ্রহও হারাতে পারেন। তাই শিক্ষার্থীদের মাঝে এই সকল উদ্ভিদের সাথে পরিচিতি হওয়ার জন্য উদ্যোগ নেওয়া প্রয়োজন। তবেই রক্ষা পেতে পারে আমাদের জলজ উদ্ভিদের বৈচিত্র্য ও শতাধিক মানুষের পেশা।

happy wheels 2