ফসল সংরক্ষণে কৃষাণীদের স্থানীয় চর্চা

নেত্রকোনা থেকে হেপী রায়
ক্ষুধা নিবৃত্তির উদ্দেশ্যে আমরা খাবার খাই বটে। কিন্তু এর পাশাপাশি শরীরে পুষ্টিরও প্রয়োজন হয়। সেই পুষ্টি আমরা পাই খাদ্যের বিভিন্ন উপাদান থেকে। আমাদের গ্রাম বাংলার আঙিনায়, মাঠে, জমিতে নানা ধরণের শাকসব্জি, ফল, মাছ, মাংস ইত্যাদি আমাদের সেই পুষ্টির যোগান দেয়।


এগুলো শুধু চাষ করলেই হয়না। নিয়মিত পরিচর্যাও করতে হয়। ফসল আবাদের একটি ধাপ হলো ফসল সংরক্ষণ। কারণ রোপণের পর যদি ফসল সংরক্ষণ না করা হয় তাহলে মানুষের খাদ্যের চাহিদা পূরণ হয়না। আর আমাদের গ্রামাঞ্চলের কৃষাণীরা বিভিন্ন স্থানীয় চর্চা বা জ্ঞান অবলম্বন করেই এসব ফসল সংরক্ষণ করেন।
প্রাকৃতিক উপায়ে, স্থানীয় কিছু উপকরণ ব্যবহার করে আমাদের কৃষাণীরা ফসল সংরক্ষণ করেন। এই ধরণের চর্চায় তাঁদের বংশ পরম্পরায় প্রাপ্ত জ্ঞান আর বিশ^াস যুক্ত থাকে। কৃষাণীদের কিছু কিছু চর্চা এরকম হয়:


– মিষ্টিজাতীয় (মিষ্টিকুমড়া) ফসলে ‘চুন’ এর ব্যবহার।

  • সব্জির মাচায় জুতা/ঝাড়ু ঝুলিয়ে রাখা।
  • জমিতে কাকতাড়ুয়া স্থাপন।
  • জমিতে রঙিন ফিতা টানিয়ে রাখা।

বীজ সংরক্ষণের জন্য কৃষাণীরা বিশেষ করে মাচার যে সব্জিটি পুষ্ট, নিরোগ ও দেখতে ভালো সেটিকেই বাছাই করেন। গাছ থেকে সেই ফসল তুলে এনে বীজের জন্য কৃষাণীরা ঘরে এনে রাখেন। গাছে থাকা অবস্থায়ও সংরক্ষণ করা যায়। দীর্ঘদিন সংরক্ষণ করা হবে বলে এই ফসল পচে যাওয়ার সম্ভাবনা থাকে। তাছাড়া মিষ্টি জাতীয় হওয়ায় ইঁদুর শ্রেণির প্রাণীর আক্রমণ হতে পারে। তাই কৃষাণীরা মিষ্টি কুমড়ার গা’এ চুন দিয়ে প্রলেপ দিয়ে রাখেন। এর ফলে এটি পচে যায়না অন্যদিকে মিষ্টিকুমড়ায় সাদা রঙের গোলাকার কিছু দৃশ্যমান থাকায় ইঁদুরও ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। এভাবেই চুন এর সাহায্যে ফসল রক্ষা করে, পরবর্তী মৌসুমে বীজগুলো সংগ্রহ করে রোপণ করা হয়।
বাড়ির আঙিনায় বা সব্জি চাষের জন্য নির্দিষ্ট জমিতে মাচা করে লতা জাতীয় ফসল চাষ করা হয়। নির্ধারিত সময়ে গাছে ফসল আসে। সে সময় কৃষাণীরা ঘরের পুরনো ঝাড়–/জুতা এগুলো মাচায় ঝুলিয়ে রাখে। এ বিষয়ে তাঁদের বিশ^াস যে, এই জিনিসগুলো রাখলে কারো চোখ/নজর লাগেনা। কারণ ভালো ফসল বা সব্জি দেখলে অনেকেরই ভালো লাগে। সেটিকে পেতে তাঁদের ইচ্ছা হয়। তাছাড়া বিভিন্ন ধরণের ক্ষতিকর পোকার আক্রমণে সব্জিগুলো নষ্ট হতে পারে। তাই এই জিনিসগুলো ঝুলিয়ে রাখলে সেখানে পাখি বসে। এবং পোকাগুলো খেয়ে ফেলে। সে কারণেই ক্ষতিকারক পোকা ফসল নষ্ট করতে পারে না। এই চর্চার মাধ্যমে কৃষাণীরা দীর্ঘদিন যাবৎ তাঁদের ফসল সংরক্ষণ করে আসছেন।
ফসল সংরক্ষণের জন্য আরেকটি স্থানীয় চর্চা হলো জমিতে কাকতাড়–য়া স্থাপন। একটি মাটির হাঁড়িতে চুন বা রঙ দিয়ে মানুষের মতো মুখ এঁকে বাঁশের খুটির মধ্যে ঝুলিয়ে দেয়া হয়। এটি দেখে পাখি বা কোনো পশু মনে করে এখানে মানুষ আছে। তাই তারা জমিতে যায় না। তাই ফসল নষ্ট হওয়ারও ভয় থাকেনা।


ধান, গম ইত্যাদি ফসলের জমিতে ইঁদুরের আক্রমণ বেশি হয়। মাটিতে গর্ত করে ইঁদুর বাসা তৈরি করে এবং ফসলি গাছের গোড়া কেটে দেয়। তাই ইঁদুরের হাত থেকে ফসল রক্ষা করার জন্য এ অঞ্চলের কৃষকগণ একটি পদ্ধতি বেছে নিয়েছেন। তাঁরা জমির নানা জায়গায় বাঁশের খুঁটি পুঁতে রেখে বিভিন্ন ধরণের রঙিন ফিতা বা সুতা বেঁধে রাখেন। বাতাস হলে সুতায় শব্দ হয়। সেই শব্দে ইঁদুর ভয় পেয়ে পালিয়ে যায়। ফলে ফসলের ক্ষতি করতে পারেনা।
নেত্রকোণা অঞ্চলে বসতবাড়ির আঙিনা ও জমি এই উভয় জায়গাতেই বিভিন্ন ধরণের সব্জির আবাদ হয়ে থাকে। মৌসুম অনুযায়ী কৃষক/কৃষাণীরা তাঁদের পছন্দ ও চাহিদা অনুযায়ী ফসল চাষ করেন। ফসলের বীজ রোপণের পর থেকে ফসল সংগ্রহ করা পর্যন্ত অনেকখানি সময় লাগে। সেই সময়ের মধ্যে ফসল উৎপাদন থেকে শুরু করে সংগ্রহ পর্যন্ত সময়টা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। তাই এসময়ে কৃষাণীরা ফসলের পরিচর্যার দিকে একটু বেশিই খেয়াল করেন। এই খেয়াল’র জন্যই তাঁদের এই চর্চাগুলো অব্যাহত আছে।


আদিকাল থেকেই এই ভূখ-ে কৃষিকাজ চলে আসছে কৃষকের উদ্ভাবিত সহজ ও স্বাভাবিক কিছু পদ্ধতির মাধ্যমে। এই পদ্ধতির একটি অংশ হলো লোকায়ত জ্ঞান বা স্থানীয় চর্চা। প্রকৃতি ও পরিবেশের কোনো ক্ষতি সাধন না করে, স্থানীয় চর্চা অবলম্বনের মাধ্যমে যে কৃষিব্যবস্থা পরিচালিত হয় সেই ব্যবস্থাই হলো স্থায়িত্বশীল বা টেকসই কৃষি চর্চা। স্থায়িত্বশীল কৃষি ব্যবস্থায় শুধু নিজে ভালো থাকা নয়, পরিবেশকেও ভালো রাখা। আমাদের কৃষাণীরা দীর্ঘদিন যাবৎ সেই কাজটিই করে চলেছেন।

happy wheels 2

Comments