সাম্প্রতিক পোস্ট

ত্রিশ বছর পর নবান্নের আনন্দে আনন্দিত বিশ্বনাথপুর গ্রামের মানুষ

নেত্রকোনা থেকে খাদিজা আক্তার লিটা
অগ্রহায়ণ মাস শেষ। আমতলা ইউনিয়নে বিশ্বনাথপুর গ্রামে ফসল কাটা প্রায় শেষ পর্যায়ে। কৃষাণীরা ব্যস্ত সময় পার করছেন ধান শুকানোর কাজে। রোদের তেজ, শীতে তীব্রতা কোনকিছইু কৃষক-কৃষাণীদের কাজে বাধা হতে পারেনি। রোদে পুড়তে পুড়তে গায়ের রং তামাটে হয়ে গেছে কিন্তু মুখে হাসি মনে চাপা আনন্দ নিয়ে কাজ করছেন কৃষক ,কৃষাণীরা। কারণ অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর অগ্রহায়ণে ধানের ফলন ভালো হয়েছে। কৃষক-কৃষাণীদের এ আনন্দের রঙ আরও রঙিন করে তুলেছে গাছগড়িয়া যুব সংগঠনে ও বিশ্বনাথপুর গ্রামেরকৃষকদের ছোট একটি আয়োজন।
গত ১২ ডিসেম্বর নবান্নের নতুন চালের শিরনী রান্না হয়েছে। কাঠালি ভোগ চালের সাথে খেজুর গুড় দিয়ে বড় বড় হাড়িতে রান্না হয়েছে শিরনী। প্রায় ত্রিশ বছর আগে বিশ্বনাথপুর গ্রামে এ ধরনের শিরনী রান্নার উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছিলো। সারা গ্রামের মানুষ একদিনে শিরনী খেতো।


উৎসবে উপস্থিত হয়েছেন এ গ্রামের প্রবীণ শতবর্ষী ব্যক্তি মো: আব্দুল গফুর। বয়সে ভারে হাটতে পারেন না। যুব সংগঠনের সদস্যদের কাঁধে ভর করে চলে এসেছেন উৎসবে যোগ দিতে। রান্নার জন্য কোন বাবুর্চি আনা হয়নি যুবদের সাথে প্রবীণরা হাতে হাত মিলিয়ে কাজ করছেন। রান্না করার নিয়মাবলি দেখিয়ে দিতে দিতে প্রবীণ ব্যক্তি মো: আব্দুল গফুর মিয়া নবান্নে বিশ্বনাথপুর গ্রামের অতীত সাংস্কৃতিক চর্চাগুলো আলোচনা করেন গ্রামের যুবদের সাথে ।
এক সময় নবান্নে ফসল কাটা শেষ হলে শিরনি রান্নার আয়োজন করা হতো। প্রায় ত্রিশ বছর ধরে গ্রামে নবান্নকে ঘিরে কোন ধরনের উৎসবের আয়োজন করা হয়না। আজ এত বছর পর এ উৎসবে এসে হারিয়ে যাওয়া স্মৃতিগুলো চোখের সামনে দেখতে পান আব্দুল গফুর। তিনি মাঠের এক কোনায় একটি পোড়ানো রেনটি গাছ দেখিয়ে বলেন, ‘এখানে ৩০ বছর আগে শিরনী রান্না হয়েছিল, নতুন চাল উঠার সাথে সাথে বাড়ি বাড়ি গুড়ে নতুন সুগন্ধি চাল, গরু দুধ সংগ্রহ করে খেজুর গুড় দিয়ে শিরনী রান্না হতো প্রতি অগ্রহায়ণে। রান্নার পর মাটির হাড়ি ভরে প্রথমে গ্রামের মসজিদে পরে বাড়ি বাড়ি বিতরণ করা হতো, বাড়ির বউ ঝিদের জন্য। ধনি, দরিদ্র, উচু নিচু বয়সের ব্যবধান ভুলে পুরুষরা মাঠে বসেই শিরণী খেত। ”


সময়ে সাথে সব কিছু বদলে গেছে। এখন আর নতুন ধান উঠার সাথে গ্রামে নবান্নকে বরণ করা হয়ন । হাজার ধানের দেশ বাংলাদেশের ফসল রোপণ থেকে বাড়ির উঠানে ধান আসা পর্যন্ত এক ধরনের ছন্দ ছড়িয়ে ছিল। দলভেদে এক গাঁয়ের লোক অন্য গাঁয়ে গিয়ে ধান কাটা, ধান কাটতে কাটতে গলা ছেড়ে গান, কাজের ফাঁকে নিজেদের সুখ, দুঃখ, তথ্য বিনিময়ের মধ্যে দিয়ে এক ধরনের সম্পর্ক তৈরি হতো।


এখন অধিকাংশ গ্রামের কৃষকরা ভিন্ন কোম্পানির কেনা নির্দিষ্ট নাম্বারী ধানের উপর নির্ভরশীল। ধান রোপণ থেকে ফসল তোলার সকল কাজ এখন বাজারনির্ভর। কৃষকের জ্ঞান, দক্ষতা, সিদ্ধান্ত গ্রহণে জায়গাটি এখন আর কাজে লাগাতে হয় না। যার ফলাফল সুন্দর সমাজ তৈরির বড় হাতিয়ার পারস্পরিক সম্পর্কের জায়গাটিও কমে যাচ্ছে, হারাচ্ছে প্রাকৃতিক পরিবেশকে ঘিরে তৈরী হওয়া সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য।


এর সাথে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে আমাদের সমাজে নানামূখী সামাজি দ্বন্দ্ব তৈরি হয়েছে। প্রবীণ, নবীনে সম্পর্কে অবনতি হয়েছে চরমভাবে। যুবরা নানামুখি অপকর্মে যুক্ত হচ্ছে। মোবাইল আসক্তি যুবদের ঠেলে দিচ্ছে অন্য এক জগতে। প্রতিটি পরিবারের অভিভাবকরা নিজেদের সন্তানের ভবিষ্যত নিয়ে উদ্বিগ্ন।
সমাজের নানামূখী সমস্যার মধ্যে গাছগড়িয়া যুব সংগঠনের একদল উদ্যোগী যুব সকল অনিয়ম ভেঙ্গে একটি সুন্দর সবুজ গ্রাম তৈরিতে কাজ করছে। সামাজিক সম্পর্ক উন্নয়ন, বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ, নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের মাধ্যমে বাজার নির্ভরশীলতা কমানো ইত্যাদি কাজে নতুন প্রজন্মকে যুক্ত করাই এ সংগঠনের মূল্য লক্ষ্য। সংগঠনের এ লক্ষ্যে পৌছাতে সহযোগি সংস্থা হিসেবে দীর্ঘ দিন ধরে কাজ করছে বারসিক।
সংগঠনের প্রতিটি যুবক পড়াশোনা করছে। কেউ নেত্রকোনা কলেজে, কেউ আবার উচ্চ শিক্ষার জন্য চলে গেছে ময়মনসিংহ। কিন্তু সংগঠনের যে কোন উদ্যোগে সবাই ছুটে আসে।
নবান্ন উৎসবে আয়োজনে থাকা যুব সংগঠনের সদস্য আবু নাঈম বলেন, ‘এ উৎসব আমাদের গ্রামের মধ্যে নতুন সম্পর্ক সৃষ্টি করেছে। গ্রামের প্রায় শতাধিক লোক উৎসবে যুক্ত হয়েছেন। গ্রামের খোলা মাঠে হাসি আনন্দ মধ্য দিয়ে সবাই শিরনি খেয়েছেন।’ যুব সংগঠনের সদস্য আবু নাঈম এ উৎসব রীতিকে ধরে রাখতে এখন থেকে প্রতিবছরে অগ্রহায়ণ মাসে উৎসব আয়োজন করার ঘোষণা দেন। আগামী বছর উৎসবটি আরও বড় করে করার সিদ্ধান্ত নিয়েছেন যুবরা।

  
happy wheels 2

Comments