বৈচিত্র্যময় সবজি ফসল চাষ করে লাভের মুখ দেখছেন হাওরের কৃষকরা
নেত্রকোনা থেকে শংকর ম্রং: হাওরের বসতভিটার সামান্য পতিত জমিতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করে পরিবারের দৈনন্দিন সবজির চাহিদা পূরণ করতে সক্ষম হচ্ছেন হাওরের কৃষকরা। উদ্বৃত্ত সবজি বাজারে বিক্রি করে আর্থিকভাবেও লাভবান হচ্ছেন। পাশাপাশি প্রয়োজনীয় সবজি ফসলের বীজ উৎপাদন করে নিজস্ব পদ্ধতিতে সংরক্ষণ করছেন। প্রতিবেশি ও আত্মীয়দের মধ্যে সবজি ও বীজ বিনিময়, কৃষি চাষাবাদ বিষয়ে পরাস্পারিক বুদ্ধি পরামর্শ ও তথ্য সহভাগিতার ফলে হাওরের জনগোষ্ঠীর সামাজি বন্ধন আরও শক্তিশালী ও দৃঢ় হচ্ছে।
আজ থেকে দু’বছর আগেও মদন উপজেলার সদর ইউনিয়ন ও হাওর বেস্টিত গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের কৃষকরা বছরব্যাপী বৈচিত্র্যময় সবজি চাষে অভ্যস্ত ছিলনা। এসব এলাকার কৃষকদের একমাত্র ফসল ছিল বোরো মৌসুমে ধানের চাষ। শীত মৌসুমে এসব এলাকার কৃষকরা সামান্য পরিমাণে শীতের ফসল যেমন- গোল আলু, ফুলকপি, বাঁধাকপি, টমাটো, খিরা, ডাটা, লালশাক, করলা, কাঠ কচু, লাউ, মরিচ ফসল চাষ করতেন। ২০১৮ সালের বারসিক মদন উপজেলার মদন সদর ও গোবন্দিশ্রী ইউনিয়নে কাজ আরম্ভ করে। কৃষকদের চাহিদার ভিত্তিতে দু’টি ইউনিয়নে বারসিক’র সহযোগিতায় কৃষকদের উদ্যোগে পৃথক দু’টি (উচিতপুর ও গোবিন্দশ্রী খালাশীপাড়া) হাওর বীজঘর স্থাপন করা হয়। বারসিক বীজঘরে কৃষকদের পছন্দের প্রায় ৩৮টি জাতের সবজি ও শস্য বীজ (ধান, ভূট্টা ও মসলা) সহযোগিতা দেয়। এসব বীজ কর্মএলাকার প্রায় ৪ শতাধিক কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। দু’টি বীজঘর ছাড়াও বারসিক স্থানীয় ও উফশী জাতের সবজি ও শস্য বীজ দু’টি ইউনিয়নের ২৬টি গ্রামের প্রায় ৬ শতাধিক কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে বিতরণ করা হয়। বারসিক ও বীজঘর থেকে পছন্দের সবজি ও শস্য বীজ সহযোগিতা পেয়ে হাওরের কৃষক-কৃষাণীরা তাদের বসতভিটার চারিপাশে পতিত পড়ে থাকা সামান্য জমিগুলোতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করছে বিগত দুই বছর যাবত। শুধু রবি মৌসুমেই নয় খরিফ-২ (বর্ষা) মৌসুমেও হাওরের কৃষকরা বস্তায় মাঁচা পদ্ধতিতে পানির উপর সবজি চাষ করে পরিবারের চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত সবজি বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধি করতে সক্ষম হচ্ছে। হাওরের নারীরা বসতভিটায় বৈচিত্র্যময় সবজি চাষে বেশি ভূমিকা রাখছে।
মদন সদর ইউনিয়নের হাওর ঘেষা উচিতপুর গ্রামের সবজি চাষ করে সাফল্য পাওয়া কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে কৃষাণী রহিমা আক্তার, সুমাইয়া আক্তার, অজুফা আক্তার, হাজেরা আক্তার, হেনা আক্তার, সনজু আক্তার, কৃষক সিদ্দিকুর রহমান, বাবুল মিয়া, আমিরুল মিয়া, হাবিল মিয়া, ইনছান মিয়া,দক্ষিণ মদন গ্রামের কৃষাণী সেলিনা আক্তার, কুকিলা আক্তার, তাসলিমা আক্তার, পাপিয়া আক্তার, আয়রিন আক্তার, কালা মিয়া, কুলিয়াটি গ্রামের কৃষক শাজাহান মিয়া, আব্দুল রহিম, মনা মিয়া, মিতানূর আক্তার ও কুকিলা আক্তার উল্লেখযোগ্য।
হাওর অধ্যুষিত গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের কৃষক-কৃষানীরাও খালাশীপাড়া হাওর বীজঘর থেকে সবজি ও অন্যান্য শস্য ফসলের বীজ নিয়ে চাষ করে পরিবারের চাহিদা পূরণ করেও বাজারে বিক্রি করে বেশ লাভবান হয়েছেন। আর্থিকভাবে লাভবান কৃষক-কৃষাণীদের মধ্যে মাদ্রাসা পাড়ার কৃষাণী নাসরিন আক্তার, লাকী আক্তার, সুফিয়া আক্তার, পূর্বহাটি গ্রামের কহিনূর আক্তার, নাসিব উজ্জ্বল হাটির ফজরা বেগম, রুমা আক্তার, সরকারহাটির রোজিনা আক্তার, ইছাপাড়ার কৃষক শামছু মিয়া, কৃষক আলম মিয়া, খালাসী পাড়ার কৃষক আলী আহম্মদ, বড়পাড়ার রেজিনা আক্তার, কদমশ্রী গ্রামের কৃষক কদ্দুস মিয়া, বোয়ালী গ্রামের কৃষক তাজ উদ্দিনসহ অনেকেই সবজি চাষ করে বেশ সফল হয়েছেন। নিজ নিজ পরিবারের সবজির চাহিদা মেটানোর পর বাজারের বিক্রি করে তারা আর্থিকভাবে লাভবান হয়েছেন। বেশ কিছু কৃষক বাণিজ্যিকভাবেও সবজি চাষ করে সফল হয়েছেন। সবজি চাষ করে তারা শুধু সফলই হননি, তারা সকলেই নিজস্ব পদ্ধতিতে (মাটির হাড়ি, প্লাস্টিক বয়াম, প্লাস্টিক ও কাঁচের বোতল এবং বস্তায়) উৎপাদিত উফশী ও স্থানীয় জাতের সবজি বীজ সংগ্রহ করছেন পরবর্তী মৌসুমে চাষের জন্য এবং হাওর বীজ ঘর ও প্রতিবেশীদের সাথে বিনিময়ের জন্য।
হাওরাঞ্চলের কৃষকরা বোরো ধানের ন্যায্য মূল্য না পাওয়ায় প্রতিবছর ব্যাপকভাবে লোকসানের সম্মূখীন হয়। যারা ক্ষেতের ধান আগাম কেটে বিক্রি করতে পারে শুধুমাত্র তারাই ধানের কিছুটা হলেরও ভালো মূল্য পায় তবে ন্যায্য মূল্য নয়। কিন্তু ভরা মৌসুমে যারা ধান কাটে তারা খুবই কম মূল্য পায়। তাই হাওরের কৃষকরা গত দুই বছর ধরে হাওরের অপেক্ষাকৃত উঁচু জমিতে (যেসব জমিতে ধান ছাড়াও অন্য ফসল চাষ করা যায়) সবজি, সরিষা, মসলা জাতীয় ফসল, গোল আলু, ভূট্টা, খিরা ইত্যাদি ফসল চাষ করেছেন। এসব ফসল চাষ করে তারা বেশ ফলনও পেয়েছেন। গত মৌসুমে সরিষা ও ভূট্টা চাষ করে ভালো ফলন পেয়েছেন তাদের মধ্যে, গোবিন্দশ্রী মাদ্রাসাপাড়ার দুলাল মিয়া ১৩ শতাংশ জমি থেকে ৮৬ কেজি সরিষা, পশ্চিমপাড়ার কৃষাণী রুবী আক্তার ১২ শতাংশ জমিতে ৭০ কেজি সরিষা এবং ৮ শতাংশ জমি থেকে ২০ কেজি মসুর ডাল, পূর্বহাটি গ্রামের কৃষক মনসুর আলী ২৩ শতাংশ জমি থেকে ১৩৫ কেজি সরিষা, বড়পাড়ার কৃষক ধনাই মিয়া ২৮ শতাংশ জমি থেকে ১৮০ কেজি সরিষা, বড্ডার কৃষক আলী আকবর তালুকদার ১৫ শতাংশ জমি থেকে ১০৫ কেজি সরিষা এবং ৬ শতাংশ জমি থেকে ২২ কেজি মসুর ডাল এবং খ্রিস্টানপাড়ার কৃষক হাইকুল মিয়া ৩০শতাংশ জমি থেকে ১৬৮ কেজি সরিষার ফলন পেয়েছেন। এছাড়াও কুলিয়াটি গ্রামের কৃষক আবু সাঈদ ৩০ শতাংশ জমিতে প্রথমবারের মত ভূট্টা চাষ করেছিলেন। এর মধ্যে ১৫ শতাংশ জমিতে বারসিক’র বীজ সহায়তা নিয়েছেন। বারসিক’র নিকট থেকে বীজ নিয়ে ১৫ শতাংশ জমি থেকে তিনি প্রায় ১৫ মান ভূট্টা পেয়েছেন। এছাড়াও পরিবারের তিন মাসের জ্বালানি পেয়েছেন।
কৃষকদের মতে, শুধুমাত্র জমি চাষ ও সামান্য সার বাবদ খরচ ছাড়া সরিষা ও মসুর ডাল চাষে অন্য কোন খরচ নেই। অন্যদিকে বৃষ্টির অনেক আগে ফসল তোলা যায় বলে প্রাকৃতিক দুর্যোগে ফসলের ক্ষতি ক্ষতিরও কোন সম্ভাবনা নেই এবং বাজার মূল্যও ভালো। এছাড়াও সরিষা ও মসুরের গাছ জ্বালানি ও গো-খাদ্য হিসেবে ব্যবহার করার ফলে পরিবারের অনেক টাকা সাশ্রয় হয়। এসব ফসল কৃষকরা হাওর বীজঘর থেকে সংগ্রহ করে নিয়ে চাষ করেন। আগামী মৌসুমে হাওরের অনেক কৃষক সরিষা ও মসুর ডাল চাষ করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। কৃষকরা তাদের উৎপাদিত সরিষা ও মসুর বীজ সংরক্ষণ করছেন আগামী মৌসুমে আরও ব্যাপকভাবে চাষ করার জন্য।
হাওরাঞ্চলে রবি মৌসুমে ধানের মাড়াই ও শুকানোর জন্য পতিত রাখা জমিতে (খলা) সবজি চাষের পাশাপাশি বসতভিটার সামান্য জমিতেও বিভিন্ন পদ্ধতিতে সবজি চাষের প্রবণতা কৃষকদের মধ্যে লক্ষ্য করা যাচ্ছে। হাওরের কৃষক-কৃষাণীরা নিজস্ব জ্ঞান ও স্থানীয় পদ্ধতিতে জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সমস্যার সাথে খাপ খাইয়ে সবজিসহ বিভিন্ন ফসল চাষ করে নিজেদের চাহিদা পূরণের পাশপাশি বাজারে বিক্রি করে পারিবারিক আয় বৃদ্ধিতে সক্ষম হচ্ছে। আশা করা যাচ্ছে আগামীতে হাওরাঞ্চলে বিশেষভাবে মদন উপজেলার মদন সদর ও গোবিন্দশ্রী ইউনিয়নের হাওরাঞ্চলে রবি ও খরিফ মৌসুমে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ বৃদ্ধি পাবে। ‘বর্ষা মৌসুমে হাওরাঞ্চলে গবাদি পশুর ব্যাপক খাদ্য সংকট দেখা যায়। ফলে বর্ষা শুরুর সাথে সাথে কৃষকরা তাদের গবাদি পশু বিক্রি করে দেয়। রবি মৌসুমে হাওরাঞ্চলে কৃষকরা পরীক্ষামূলকভাবে ভূট্টা চাষ করে সফল হয়েছেন। আগামীতে ভূট্টা চাষ অনেক বৃদ্ধি পাবে বলে কৃষকরা জানায়। হাওরাঞ্চলে বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ বৃদ্ধির মাধ্যমেই জলবায়ু পরিবর্তন জনিত কারণে সৃষ্ট হাওরাঞ্চলের দুর্যোগ যেমন-আগাম বন্যা, ঢেউ, বাতাস (আফাল), খরা ও ফসলে রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ থেকে হাওরের ফসল রক্ষা করা সম্ভব।