গাঙ্গের কোলে হয় কালি বোরো ধান
হরিরামপুর, মানিকগঞ্জ থেকে সত্যরঞ্জন সাহা
ভাত আমাদের প্রধান খাদ্য হওয়ায় এক সময় গ্রাম বাংলার ঘরে ঘরে হাজারও ধরনের ধান আবাদ হতো। কৃষকরা পরিবেশ পরিস্থিতি ও জমির ধরণ বুঝে বিভিন্ন ধরনের ধান চাষাবাদ করত। কোথাও খরা সহনশীল ধান, কোথাও পানি সহনশীল ধান, আবার কোথাও লবণ পানি সহনশীল- এমনকি নদীর তীরে বেলে মাটিতেও ধান চাষাবাদে কৃষকগণ সফল হতো। কৃষকদের চাষাবাদ চিন্তা ও অভিজ্ঞতা ধানবৈচিত্র্য সংরক্ষণে সহায়ক হতো।
তেমনি একটি ধান জাত কালো বোরো ধান। স্থানীয়রা এটাকে কালি বোরো বলে থাকেন। এটি মানিকগঞ্জের চর এলাকার স্থানী একটি জাত। মূলত মানিকগঞাজ জেলার হরিরামপুর উপজেলার পদ্মা নদীর চর এলাকায় বোরো মৌসুমে চাষাবাদ করা হয়। এই এলাকায় ২ ধরনের (কালা বোরো ও বোরো) বোরো ধান এক সাথেই চাষ করা হয়।
খালপাড় বয়ড়া, বয়ড়া এলাকার কৃষক আক্তার রহমান (৪২) বলেন, “গাঙ্গের কোল কালিতে লাগান লাগে দেশী বোরো ধান। যেখানে নতুন চর জাগে সে খানে দেশী বোরো ধানের আবাদ করতে হয়। গাঙ্গের কোল কালিতে দেশী বোরো ধান ছাড়া অন্য কোন ধান হয় না। এ জন্য আমাদের কাছে এ ধানের বীজ আজীবন সজিব/সংরক্ষণ করা হবে। বোরো ধান চাষে সুবিধা হলো নিধানের সময় বা বিপদের সময় নদীতে পানি আসার আগে চৈত্র মাসের শেষ বা বৈশাখ মাসের প্রথমে দেশী বোরো ধান কাটা হয়।”
পদ্মা নদীর তীরে বেলে মাটিতে দেশী বোরো ধানের বিকল্প নেই। কালি বোরো ধানে সেচ লাগে না ও জমি চাষ লাগে না। নদীর তীরের পানি যাওয়ার পর পলিযুক্ত মাটিতে অগ্রহায়ণ ও পৌষ মাসে বোরো ধানের চারা রোপণ করা হয়। বোরো ধানের চারা তৈরি করা হয় কার্তিক অগ্রহায়ণে মাসে। বোরো ধান ৩৩ শতক জমিতে ৮ থেকে ১০ মণ ধান উৎপাদন হয়। এই এলাকার বোরো ধানচাষে চাষাবাদ এবং সার বিষ লাগে না। তাই খরচ অনেক কম। আন্ধারমানিক এলাকার শফি বেপারি (৪৫) বলেন, “বোরো ধানের খড় গরু খুব ভালো খায়। বোরো ধান চাষে কোন ধরনের সার ও বিষ লাগে না। বোরো ধান রোপণ করার পরে জমিতে না গেলেও চলে। আবার চৈত্র মাসের শেষ বা বৈশাখ মাসের প্রথমে ধান কর্তন করে বাড়িতে নিয়ে আসতে হয়।”
খাল পাড় বয়ড়া, বয়ড়ার মুসলেম বেপারি (৪২) বলেন, “পদ্মা নদীর পাড়ে ভাসা চরে দেশী বোরো ধানের চাষ হয়। পদ্মা নদী কখন কোন পাড় ভাঙ্গে, কোন পাড় গড়ে তার কোন ঠিক ঠিকানা নাই। যেখানে চর পড়ে সেখানেই বোরো ধান রোপণ করি।” নদীর পানি নেমে যাওয়ার পর পলি মাটিতে বোরো ধান রোপণ করা হয়। জমি চাষের প্রয়োজন পড়ে না কারণ হলো পলি মাটি হাটু পর্যন্ত কাদা থাকে। হাটু পর্যন্ত কাদা থাকায় জমির উপর কলা গাছ বা বাঁশ উপর ভর রেখে বোরো ধানের চারা রোপণ করতে হয়। চর থেকে শুরু করে নদীর পানির ৬ ইঞ্চি পর্যন্ত ধানের চারা রোপণ করা যায়। তবে মাটি শক্ত হলে খোটা গেরে বোরো ধানের চারা রোপণ করা হয়। এ বছর খাল পাড় বয়ড়া গ্রামের ৮ জন কৃষক পদ্মা নদীর তীরে সম্মিলিতভাবে ১৫ বিঘা ( ৫০০ শতক) জমিতে বোরো ধান চাষ করি।
উপসহকারী উদ্ভিদ সংরক্ষণ অফিসার আব্দুস ছালাম মোল্লা বলেন, “হরিরামপুর উপজেলায় পদ্মা নদী, ইছামতি নদী, কল্যাপুর নদী, দিয়াবাড়ি বিল, ভাতচালা বিল, গুপিনাথপুর বিলের তীরে ২০১৮ সালে ২৬০ হেক্টর জমিতে বোরো ধান চাষ হয়। দেশী বোরো ধান দুর্যোগ সহনশীল ধান ফলে পোকা লাগে না ও পরিচর্যার প্রয়োজন হয় না। অল্প সময়ে নদীতে পানি আসার আগেই কৃষক ধান কেটে ঘরে নিতে পারেন।” হরিরামপুর উপজেলা কৃষি অফিসার মো. জহিরুল হক বলেন, “দেশী বোরো ধান নদীর তীর ও বিলের কাছে হয়। এসকল জমিতে অন্য কোন ধান হয় না।”
বোরো ধান চাষে কোন ধরনের খরচ ছাড়াই বেশ ভালো উৎপাদন হয়। বোরো ধানের খড় গরু ভালো খায়, ফলে খড়ের চাহিদা বেশি। পলিযুক্ত মাটিতে রাসায়নিক সার ও বিষ ছাড়াই বোরো ধান চাষ হয় ফলে সবচেয়ে নিরাপদ খাদ্য। এই এলাকার কৃষকগণ চাষাবাদের মাধ্যমে বোরো ধানের বীজ সংরক্ষণ করে চাষাবাদ করেন। কৃষকরা মনে করেন বোরো মৌসুমে যে কোন বিরূপ পরিবেশে দেশী বোরো ধান উৎপাদন হবেই। দেশী বোরো ধান চাষে উৎপাদন খরচ কম ও খড় বেশি পাওয়া যায় ফলে কৃষকগণ বোরো ধান লাভজনক চাষ মনে করেন।