জলবায়ু সুবিচারের দাবিতে রাজশাহীতে ছয় বৈচিত্র্যময় অঞ্চলের মানুষের যুব জলবায়ু সম্মেলন
রাজশাহী থেকে মো: শহিদুল ইসলাম
জলবায়ু সুবিচারে ‘লস এন্ড ড্যামেজ ফান্ডের দাবিতে সাম্প্রতি ‘রাজশাহী জলবায়ু সম্মেলন ২০২২’ অনুষ্ঠিত হয়েছে। গত ২৭-২৮ ডিসেম্বর ২০২২ তারিখে দুদিনব্যাপী উক্ত জলবায়ু সম্মেলনটি অনুষ্ঠিত হয়েছে রাজশাহী জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে। এতে “ক্ষতিপূরণের অঙ্গীকার, জলবায়ু সুবিচার”-এর দাবিতে বাংলাদেশের ভিন্ন ভিন্ন কৃষিপ্রতিবেশ ও ভৌগলিক অঞ্চলের ভিন্ন জাতি, পেশা, শ্রেণি, জেন্ডার প্রতিনিধি রাজশাহী, নেত্রকোণা, মানিকগঞ্জ, সাতক্ষীরা, চাপাইনবাবগঞ্জ, বান্দরবান, খাগড়াছড়ি, রাঙ্গামাটি, নীলফামারী, ঢাকা, বাগেরহাট, সিলেট, নওগাঁ থেকে আগত প্রায় ৫০টি যুব সংগঠনের প্রায় তিন শতাধিক যুব তরুণ প্রতিনিধি এতে অংশগ্রহণ করেন। একই সাথে শিক্ষক, উন্নয়নকর্মী , গবেষক জলবায়ু সংকট এবং করনীয় বিষয়ে তাঁদের গবেষণাপত্র এবং বিভিন্ন তাত্ত্বিক দিকগুলো তুলে ধরেন।
জলবায়ু সম্মেলনের প্রথমদিনে “ধরিত্রী ও বৈচিত্র্য” প্রতিপাদ্য বিষয়কে গুরুত্ব দিয়ে শুরুতে জাতীয় পতাকা উত্তোলন ও বীরমুক্তিযোদ্ধাদের প্রতি সম্মান জানিয়ে সম্মেলনের উদ্বোধন করেন বীর মুক্তিযোদ্ধা ও মুক্তিযোদ্ধা কমান্ডার ডা আবদুল মান্নান। এ সময় ছিলেন নদী ও পরিবেশ গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী, যুব সম্মেলনের আহবায়ক শাইখ তাসনীম জামাল, বারসিক পরিচালক সৈয়দ আলী বিশ^াস, লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ, জাহাঙ্গীর আলমসহ বিভিন্ন অঞ্চলের তরুণ-যুব ও নাগরিক প্রতিনধিগণ। রাজশাহী যুব জলবায়ু সম্মেলন ২০২২ এর শুভেচ্ছা বক্তব্য দেন সম্মেলনের আহবায়ক ও বরেন্দ্র অঞ্চল যুব ফোরামের সভাপতি শাইখ তাসনীম জামাল।
দুদিনবাপী উক্ত সম্মেলনে প্রথম দিন বিদ্যায়তনিক আলাচনায় শিক্ষক, গবেষক, উন্নয়নকর্মী, আদিবাসী, তরুণ ও নাগরিক সমাজ জলবায়ু পরির্বতনে এলাকাভিত্তিক সংকট ও ক্ষতির বিভিন্ন দিকগুলো তুলে ধরেন। বলা হয়, ‘আঞ্চলিক ভিন্নতায় বৈচিত্র্য বৈভবে অনন্য আমাদের বাংলাদেশ। জলবায়ু পরিবর্তনে আঞ্চলিক অভিঘাত দিনে দিনে সংকটের দিকে নিয়ে যাচ্ছে। বরেন্দ্র অঞ্চলে যেমন খরা ও অনাবৃষ্টিসহ তাপমাত্র বৃদ্ধি পাচ্ছে, পানি সংকট ভয়াবহ রূপ নিয়েছে। বঙ্গোপসাগর সংলগ্ন উপকূলীয় অঞ্চলে ঘুর্ণিঝর, সাইক্লোন, জলোচ্ছ্বাস তাপমাত্রা বৃদ্ধিসহ নেমে যাচ্ছে ভূগর্ভস্থ পানির স্তর, বাড়ছে লবণাক্ততা। সমতল প্লাবন অঞ্চলসহ নদীবিধৌত চরাঞ্চলে বেড়েছে নদীভাঙন স্থানান্তর। অন্যদিকে বিল ও হাওড়বেষ্টিত জলাভূমি অঞ্চলে অসময়ে বন্যা এবং ফসল হানি আরো বেশি বেড়েছে। জলবায়ু পরির্বতনে নেতিবাচক প্রভাবের কারণে নারীরা নানামূখী নতুন নতুন স্বাস্থ্য সংকটের পাশাপশি বিভিন্ন বয়সের ও মানুষের মধ্যে স্বাস্থ্যঝুঁকি বাড়ছে। গবেষণায় দেখা যায়, খরা এবং পানি সংকটের কারনে বরেন্দ্র অঞ্চলসহ অন্যান্য অঞ্চলে সামাজিক সহিংসতা আগের তুলনায় বৃদ্ধি পেয়েছে। এক কথায় জলবায়ু পরিবর্তনে তৈরি হচ্ছে জটিল আর্থসামাজিক সমস্যা, যার প্রভাব পড়েছে শরীর ও মনে। বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক ভিন্নতায় এই বিপন্নতা বুঝে, তাঁদের উপযুক্ত সুরক্ষার ব্যবস্থা করা না হলে এই মানুষদের জন্য জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পাবেনা, তাঁদের সঙ্গে অন্যায় করা হবে। ধনী দেশগুলোর যে অঙ্গীকার তা পূরণই জলবায়ু ন্যায্যতা প্রতিষ্ঠা পেতে পারে।
বিদ্যায়তনিক ও বিষয়ভিত্তিক আলোচনায় অংশ নিয়ে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিবেশবিদ্যা ইনস্টিটিউটের অধ্যাপক ড. গোলাম মোস্তফা
তাঁর গবেষণার শিরোনাম ‘জলবায়ূ পরির্বতন এবং আমাদের ভাবনা’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপনায় বলেন, ‘উন্নত দেশগুলোতে কার্বন উদগীরনের ফলে সব দেশই ক্ষতির মুখে পড়েছে। বৈশ্বিক তাপমাত্রা বাড়ছে। এটি এখন থেমে যাওয়ারও সম্ভাবনা কম। তাপমাত্রা বৃদ্ধির কারণে হিমালয়ের বরফ গলবে, সমুদ্রের পানির উচ্চতা বাড়বে। একইসঙ্গে উপকূলীয় নি¤œাঞ্চল প্লাবিত হবে। কৃষিজমি লবণাক্ত হয়ে উঠবে। বহু মানুষ কাজ হারাবে। এই সমস্ত মানুষগুলোকে কীভাবে নতুন কাজ দেওয়া যায়, তাদের পুনর্বাসন করা যায়, সে বিষয়ে এখন থেকেই প্রস্তুতি নিতে হবে। প্রশিক্ষণ দিতে হবে। এর জন্য ক্ষতিপূরণগুলো তাঁদেও বৃঝিয়ে দিতে হবে।’
নদী ও পরিবেশ গবেষক মাহবুব সিদ্দিকী বলেন, ‘এখন যে ক্ষতি আমরা দেখতে পাচ্ছি, তার প্রেক্ষাপট অনেক আগেই তৈরি হয়েছে। এখন যে ক্ষতি হচ্ছে, তারও চিত্র আমরা অনেক বছর পরে দেখতে পারব। পৃথিবীকে আমরা বিশৃঙ্খলভাবে ব্যবহার করছি বলেই এটি হচ্ছে। পৃথিবীর এই ক্ষতি অল্প কিছু দেশ করলেও তার শিকার হচ্ছে সব দেশ। তাই যারা ক্ষতি করছে, তাদের কাছ থেকে জলবায়ু পরিবর্তনের শিকার দেশগুলোর জন্য ক্ষতিপূরণ আদায় করতে হবে। এই আন্দোলনকে বেগবান করতে যুব সমাজকেও এগিয়ে আসতে হবে।’
রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের প্রাণীবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক ড. বিধান চন্দ্র দাস তাঁর ‘জীববৈচিত্র্যের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব: প্রেক্ষিত বাংলাদেশ’ শীর্ষক গবেষণা প্রবন্ধের উপস্থাপনে বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনে সব থেকে বেশি ক্ষতি হচ্ছে জীববৈচিত্র্য, আর এই বৈচিত্র্য যদি হারিয়ে যায় বিনষ্ট হয়, মানুষই সব থেকে বেশি ক্ষতির শিক্রা হবে। মৌমাছি এবং এই ধরনে কীটপতঙ্গগুলো মারাত্মক হারে কমে যাচ্ছে। খাদ্য উৎপাদনে এগুলোর ভূমিকা অপরিসীম। তাই এগুলো রক্ষা করার জন্য আরো বেশি কার্যকর উদ্যোগ নেয়া প্রয়োজন।’
বিদ্যায়তনিক আলোচনায় আরো অংশগ্রহণ করেন রাজশাহী বিশ^বিদ্যালয়ের নৃবিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক কাজী রবিউল আলম, তিনি তাঁর বিষয় ‘সোস্যাল সাইন্স: প্রেক্ষিত জলবায়ু পরিবর্তন’ বিষয়ে আলোচনা তুলে ধরেন। এবং একই বিশ^বিদ্যালয়ের সহকারি অধ্যাপক অভিজিৎ রয় তাঁর গবেষণা প্রবন্ধ ‘জলবায়ু পরিবর্তন: প্রেক্ষিত বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিপ্রতিবেশ’ বিষয়ে তথ্যগুলো তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরির্বতনে বরেন্দ্র অঞ্চলের কৃষিবাস্তুবিদ্যা ও ধরণ পরিবর্তিত হচ্ছে। পরিবেশবিজ্ঞানী ও গবেষক ড. মোহাম্মদ জাকির হোসেন খান ‘বাংলাদেশের শিল্পের জন্য পরিবেশগত ব্যববস্থাপনা সিস্টেমের গুরুত্ব এবং জলবায়ু পরিবর্তন’ শীর্ষক প্রবন্ধ উপস্থাপনকালে বলেন, ‘শিল্প কলকারখানার কারণে আমাদের স্থানায় বাস্তুতন্ত্র ও প্রতিবেশ নষ্ট হচ্ছে, একই সাথে জলবায়ু পরিবর্তনে ভূমিকা রাখছে। পরিবশেবান্ধব শিল্পব্যবস্থাপনায় অধিক গুরুত্ব দিতে হবে।’
বিদ্যায়তিন আলোচনায় বারসিক’র গবেষক ও আঞ্চলিক সমন্বয়কারি শহিদুল ইসলাম বরেন্দ্র অঞ্চলে বারসিক’র চলমান যৌথ গবেষণা ‘জলবায়ু পরিবর্তন ও বরেন্দ্রভূমির নয়া সংকট’ শীর্ষক প্রবন্ধে রেশমপলু পোকা পালন ও আবহাওয়া পরিবর্তন বিষয়ক অনুসন্ধান, বরেন্দ্র এলাকার গ্রামীণ জনজীবনে তীব্র্র তাপদাহের প্রভাব অনুসন্ধান, কৃষিজমির সংকটরূপ এবং সমাধানে করণীয় বিষয়ক মাঠ পর্যায়ে অনুসন্ধানমূলক সমীক্ষা, লাক্ষাচাষ ও জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব, তীব্র তাপদাহ ও খরা: নারীদের স্বাস্থ্যগত ঝুঁকি বিষয়ক অনুসন্ধান, বরেন্দ্র অঞ্চলের দুর্যোগ প্রস্তুতি বিষয়ক অনুসন্ধান, মহামারি কারেনাকালে শতবাড়ি উন্নয়ন মডেল বিষয়ক সাতটি গবেষণার প্রাথমিক সারসংক্ষেপ ফলাফল তুলে ধরেন।
বিদ্যায়তনিক আলোচনায় প্যানেল আলোচক সভাপতি ও প্রধান অতিথি হিসেবে ছিলেন নর্থ ইস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ’র উপাচার্য অধ্যাপক ড. ইলিয়াস উদ্দিন বিশ্বাস। তিনি বলেন, ‘বরেন্দ্র অঞ্চলের বৈচিত্র্য যেমন জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কমেছে, তেমনি মানুষ সৃষ্ট কিছু উন্নয়নের কারণেও এর বৈচিত্র্য কমেছে। জলবায়ু পবির্তনে মানুষের এবং জীববৈচিত্র্যের যে ক্ষতি হচ্ছে, তা উন্নয়নে এবং সুরক্ষায় এখনই পদক্ষেপ না নিলে ভয়াবহ সংকটের মধ্যে পড়বো আমরা।’ তিনি লেখক, গবেষক এবং উন্নয়ন প্রতিষ্ঠানসহ সরকারি পর্যায়ে এ বিষয়ে কার্যকর পদক্ষেপের আহবান জানান। বিদ্যায়তিন আলোচনাটি সঞ্চালনা করেন লেখক ও গবেষক পাভেল পার্থ।
প্রথমদিনে বিদ্যায়তিক আলোচনার পাশাপাশি বিভিন্ন অঞ্চলের মানুষ তাঁদের উদ্যোগ এবং সমস্যার কথাগুলো তুলে ধরেন। একই সাথে নাচ গাণ এবং অভিনয়ের মধ্যে দিয়ে জলবায়ু ন্যায্যতার দাবিগুলো তুলে ধরেন।
রাজশাহী যুব জলবায়ু সম্মেলনের দ্বিতীয় দিনে ‘সক্ষমতা ও ন্যায়বিচার’ প্রতিপাদ্য বিষয়ে ধারণ করে সকাল ১১ ঘটিকায় লস এন্ড ড্যামেজ তহবিলের দাবিতে জলবায়ু মিছিল হয়। এতে প্রায় তিন শতাধিক যুব, নাগরিক সমাজ, সাংবাদিক, লেখক , গবেষক এবং উন্নয়নকর্মী অংশগ্রহণ করেন। জলবায়ু মিছিলটি রাজশাহীর মহানগরির বিভিন্ন প্রধান প্রধান সড়ক প্রদক্ষিণ করে জেলা শিল্পকলা একাডেমিতে এসে শেষ হয়। এর পর অঞ্চল, পেশা, জেন্ডার, জাতি, বয়স ও সামাজিক বৈচিত্র্য বিবেচনায় দেশের নানাপ্রান্ত থেকে অংশ নেয়া গ্রাম ও নগরের প্রতিনিধিগণের গান, বক্তৃতা, আলোচনা, অভিনয়, প্রদর্শনী ইত্যাদির মাধ্যমে তাদের চর্চা, সক্ষমতা এবং প্রস্তাব ও দাবি তুলে ধরেন। দেশের বিভিন্ন কৃষিপ্রতিবেশ অঞ্চলের বাঙালি ও আদিবাসী জনগোষ্ঠীর বৈচিত্র্যময় সাংস্কৃতিক পরিবেশনা এবং জলবায়ু ঘোষণা করা হয়। একই সাথে যুব জলবায়ু সম্মাননা ২০২২ ঘোষণা করা হয়।
রাজশাহী যুব জলবায়ু সম্মেলন দুইদিনে সকল অঞ্চলের মানুষের অংশগ্রহণে তাঁদের দাবি এবং জলবায়ু ন্যায্যতায় কার্যকর পদক্ষেপ নিতে রাজশাহী যুব জলবায়ু ঘোষণা ২০২২ পাঠ করা হয়। এ সময় প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত ছিলেন গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশ সরকারের মাননীয় সংসদ সদস্য ফজলে হোসেন বাদসা (সংসদ সদস্য- রাজশাহী -০২)।
রাজশাহী যুব জলবায়ু ঘোষণা ২০২২
১. বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রির বেশি বাড়তে দেয়া যাবে না। তাপমাত্রা ১.৫ ডিগ্রীর ভেতর রাখতে হবে।
২. জলবায়ু পরিবর্তনের জন্য দায়ী দেশগুলোকে জলবায়ু চুক্তি অনুযায়ী কার্বন নির্গমণ হ্রাস করতে হবে। প্রতিটি দেশকে তার অভ্যন্তরীণ অবদানকে সুস্পষ্ট করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৩. জলবায়ু চুক্তির অঙ্গীকার অনুযায়ী বৈশি^ক জলবায়ু তহবিলে জলবায়ু পরিবর্তেনের জন্য দায়ী দেশগুলোকে পর্যাপ্ত পরিমাণে ক্ষতিপূরণ প্রদান করতে হবে। এই তহবিল বাংলাদেশসহ জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ও অতি ঝুঁকিপূর্ণ দেশের জন্য বিনাশর্তে ব্যয় করতে হবে। জলবায়ু তহবিলের যাবতীয় ব্যবস্থাপনা স্বচ্ছ, কর্তৃত্ববিহীন ও জবাবদিহিতার আওতায় আনতে হবে।
৪. জলবায়ুু পরিবর্তনের প্রভাব মোকাবেলায় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অভিযোজন চর্চা ও লোকায়ত জ্ঞানকে অগ্রাধিকার দিয়ে বিবেচনা করতে হবে। এই অভিযোজনকে স্বীকৃতি দিতে হবে এবং এর জন্য প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ ও নীতি গ্রহণ করতে হবে।
৫. কেবল অভিযোজন নয়, বৈশি^ক প্রশমন উদ্যোগসমূহ প্রত্যক্ষভাবে দৃশ্যমান হতে হবে। এক্ষেত্রে কার্বন-বাণিজ্যের মতো বিষয়কে উৎসাহিত করা যাবে না।
৬. বাংলাদেশসহ বিশ^ব্যাপি কৃষিজমি, বনভূমি, নদী ও জলাভ’মি, মাটিসহ প্রাণবৈচিত্র্য ও প্রকৃতি রক্ষা করতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রাণবৈচিত্র্য সনদের অঙ্গীকারকে প্রতিষ্ঠিত করতে এক্ষেত্রে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতগুলোকে মূল্যায়ন করতে হবে।
৭. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশেষত তীব্র তাপদাহ, অনাবৃষ্টি, অতিবৃষ্টি, খরা, বন্যা, পাহাড়ি ঢল, লবণাক্ততা, শৈত্যপ্রবাহ, বজ্রপাত, শিরাবৃষ্টি, ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙ্গনের ফলে গ্রাম ও নগরে যে ধরণের ক্ষয়-ক্ষতি হচ্ছে তা পূরণে আন্তর্জাতিক ‘ক্ষয়-ক্ষতি তহবিল’ গঠন করে অতি দ্রুত তা বাস্তবায়ন করতে হবে।
৮. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে পেশার পরিবর্তনশীলতা ও স্থানান্তর এবং বাস্তুচ্যুতির ঘটনা গভীরভাবে অনুধাবন করতে হবে। এক্ষেত্রে জলবায়ুর কারণে জলবায়ু-উদ্বাস্তু মানুষের জন্য নতুন অভিবাসনস্থল নিরাপদ করতে হবে এবং এসব মানুষের জন্য মর্যাদার কর্মসংস্থান নিশ্চিত করতে হবে। এক্ষেত্রে জলবায়ু-উদ্বাস্তু হয়ে নগর এলাকায় বসবাসরত নগর দরিদ্র্য ও বস্তিবাসীদের জন্য আবাসনসহ নাগরিক সুবিধা নিশ্চিত করতে হবে।
৯. জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে সংকটাপন্ন গ্রামীণ সংষ্কৃতি এবং শিল্পকর্মর বিষয়গুলোকে বিকাশে সহযোগিতা করতে হবে। এক্ষেত্রে দেশব্যাপি সকল গ্রামীণ শিল্পকলা এবং সংষ্কৃতি চর্চা ও বিকাশে পরিকল্পনা ও তহবিল বরাদ্দ করতে হবে।
১০. জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলার সকল পরিকল্পনা ও তৎপরতায় তরুণ-যুবদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে। কৃষিতে তারুণ্য এবং জলবায়ু সুরক্ষায় যুবশক্তিকে সোচ্চার করতে হবে। তরুণদের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে গবেষণা ও কাজের জন্য বিশেষ বৃত্তি, ফেলোশিপ এবং নানা পর্যায়ে ও নানাস্তরে (গ্রাম ও নগরের) উৎপাদনমুখী সৃজনশীল কাজে যুক্ত করতে হবে। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা এবং যুবদের মাধ্যমে সংগঠিত বিভিন্ন কাজকে তৎপর হতে সহযোগিতা করতে হবে।
১১. গণমাধ্যমকে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় কর্মরত গ্রামীণ সমাজের দৃষ্টান্তমূলক কাজগুলোকে আরো বেশি প্রচার ও প্রকাশ করতে হবে। যুবদের মাধ্যমে জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলা ও পরিবেশ সুরক্ষার কাজকে আরো বেশি প্রচারের জন্য জলবায়ুবান্ধব গণমাধ্যম গড়ে তুলতে হবে।
জলবায়ু ঘোষণায় যুবকরা আরো বলেন, ‘আমরা তরুণ যুব সমাজ। আমরা বুঝতে পারছি এই পৃথিবীকে প্রতিদিন বিশে^র কিছু ধনী ক্ষমতাবান দূষিত ও সংকটাপন্ন করে তুলছে। আমরা এই পৃথিবীর দায়িত্ব কিছু মানুষের কাছে ছেড়ে দিতে পারি না। এই পৃথিবী আমাদের, আর একটাই মাত্র গ্রহ আমাদের। একে বাঁচাবার দায়-দায়িত্ব আমাদের। আমরা আর কোনো মিথ্যা অঙ্গীকার ও ভুয়া সমাধান শুনতে চাই না। আমরা এমন বহু বছর ধরে বহুকিছু শুনে এসেছি। আমরা বারবার সম্মেলন আর সংলাপের মাধ্যমে একই কথা আর সুন্দর সুন্দর অঙ্গীকার বিশ^নেতৃবৃন্দর কাছ থেকে শুনতে চাই না। আমরা বুঝতে পেরেছি সমাজ পরিবর্তনের কোনো যোগ্যতা তাদের নাই, তারা কেবল পৃথিবীটা মুনাফা আর লোভের কারণে মেরে ফেলতে চায়। তারা আমাদের শৈশব কেড়ে নিয়েছে। আমাদের খেলার মাঠ নাই, আমাদের নদী দূষিত, আমাদের খাবারে প্লাস্টিক, আমাদের বনভ’মি উজাড়, আমাদের বাতাসে সীসা। এর জন্য উন্নত ও ধনী দেশের ভোগবিলাসিতা দায়ী। আমরা এই অবস্থার পরিবর্তন চাই।’ তারা আরও বলেন, ‘জলবায়ু নয়, এই বৈষম্যমূলক ব্যবস্থার পরিবর্তন করতে হবে। দেশ থেকে দেশে আমরা যুবরাই ইতিহাস রচনা করেনি। আমরা মহান মুক্তিযুদ্ধের আদর্শবিশ^াস করি। আমরা জানি আজ আমরাই পরিবর্তন। আমরাই এই অবস্থার পরিবর্তন করবো। জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় আমরাই আজ এক বৈশি^ক সংহতি জোরালো করবো।’
উল্লেখ্য যে, রাজশাহী যুব জলবায়ু সম্মেলন ২০২২ এ বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বৈচিত্র্যময় শস্য ফসলের জাত, লোকায়ত চর্চাসহ বিভিন্ন ধরনের হস্ত ওকারু শিল্পের প্রদর্শনী করা হয়। দুইদিনব্যাপী উক্ত সম্মেলনে অংশগ্রহণকারিগণ এগুলো থেকে অভিজ্ঞতা বিনিময় করেন।