সরকারি আইনী সহায়তা ও বারসিক
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
“জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা” আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয়ের অধীনে বাংলাদেশ সরকারের একটি বিধিবদ্ধ সংস্থা যা দরিদ্র বাংলাদেশীদের আইনি সহায়তা দেওয়ার জন্য দায়বদ্ধ। বাংলাদেশ সরকারের আইন সহায়তা কর্মসূচি বাস্তবায়নের নিমিত্তে আইন, বিচার ও সংসদ বিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক ইতোপূর্বে ১৯৯৪ ও ১৯৯৭ সালে দুইবার রেজুলেশন করা হলেও লিগ্যাল এইড ব্যবস্থার প্রাতিষ্ঠানিকীকরণ না হওয়ায় সে সময়কার আইন সহায়তা কর্মসূচি ব্যর্থ হয়। এ কারণে ২০০০ সালে আইনগত সহায়তা প্রদান আইন পাশ হওয়ার পরপরই সরকার একটি প্রজ্ঞাপন জারি করে। সংবিধিবদ্ধ সংস্থা হিসেবে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা প্রতিষ্ঠা করে। সমগ্র বাংলাদেশে সরকারি আইন সহায়তা কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্ব এ সংস্থার উপর ন্যাস্ত থাকলেও প্রয়োজনীয় প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামাের অভাবে ২০০৯ সালের পূর্ব পর্যন্ত সরকারি আইন সহায়তা কর্মসূচির উল্লেখযোগ্য কোনো অগ্রগতি হয়নি। ২০০৯ সালে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থাকে একটি সক্ষম ও কার্যকর প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে তোলার প্রথম উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়। সংস্থার অধীনে দেশের ৬৪টি জেলায় জেলা ও দায়রা জজের নেতৃত্বে জেলা লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়েছে। প্রত্যেক জেলা জজ আদালত ভবনে একটি লিগ্যাল এইড অফিস স্থাপন করা হয়। জেলা লিগ্যাল এইড কমিটিকে পুনর্গঠনের পাশাপাশি সারাদেশের উপজেলা ও ইউনিয়ন পর্যায়ে লিগ্যাল এইড কমিটি গঠন করা হয়। আইনগত সহায়তা প্রদান আইন, ২০০০ এর আওতায় বাংলাদেশ সরকারের আইনগত সহায়তা কার্যক্রম পরিচালিত হয়।
সরকারি আইনগত সহায়তা কি?
আইনি সহায়তা হলো যেসকল মানুষ আদালতের ব্যবস্থা গ্রহণ করতে পারেনা বা আইনি প্রতিনিধিকে নেওয়ার সামর্থ্য নেই তাদেরকে আইনি সহায়তা দেয়ার একটি নিয়ম। ন্যায়বিচার পাওয়ার জন্য আইনি সহায়তাকে কেন্দ্র হিসেবে বিবেচনা করা হয়, যা আইনে সকলের সমান অধিকারকে নিশ্চিত করে। লিগ্যাল এইড বলতে আদালতের অভ্যন্তরে এবং বাইরে গরীব এবং অসহায় মামলাকারীদের আইনি বিষয়ে সহায়তা করাকে বোঝায়।
তারই ধারাবাহিকতায় মানিকগঞ্জ জেলায়ও জেলা লিগ্যাল এইড কমিটিসহ উপজেলা এবং ইউনিয়ন পর্যায় কমিটি গঠনের মাধ্যমে গরিব, অসহায় মানুষকে সরকারি আইনি সহায়তা প্রদান করে যাচ্ছে। বারসিক মানিকগঞ্জ জেলার জেলা লিগ্যাল এইড কমিটির সদস্য হিসেবে ২০১৪ সাল থেকে যুক্ত হয়ে প্রান্তিক মানুষের দাড়গোড়ায় সরকারি আইনি সহায়তা পৌঁছে দেওয়ার লক্ষ্যে কাজ করে যাচ্ছে। সরকারি আইনি সহায়তার তথ্য পৌঁছে দেওয়ার পাশাপাশি সংগঠনের নেতাদের লিগ্যাল এইড অফিসে যোগাযোগ ও সম্পর্ক উন্নয়নের কাজ করে যাচ্ছে। প্রত্যন্ত গ্রাম থেকে লোকজন লিগ্যাল এইড অফিসে আসছেন বিভিন্ন বিষয়ে আইনি পরামর্শের জন্য। আইনি সহায়তার জন্য।
লিগ্যাল এইড অফিস থেকে আইনি পরামর্শ পেয়েছেন এমন একজন নারী মানিকগঞ্জ সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চরমত্ত গ্রামের গোলাপী বেগম (৫৫)। তিনি বলেন, “আমি আমার মেয়ে নিয়ে সমস্যায় পড়ি। মেয়ের জামাই মেয়েকে খুব মারধোর করতো। প্রতিমাসেই আমার মেয়েকে মেরে আমাদের বাড়িতে পাঠিয়ে দিতো। আমি চরমত্ত নারী সংগঠনের একজন সদস্য। একদিন মিটিং এ বারসিক সরকারি আইনি সহায়তা বিষয়ে আলোচনা করেছিল। আমি পরে আপার সাথে আমার মেয়ের বিষয়ে আলাপ করি। আপার পরার্মশ মত আমি আমার মেয়েকে নিয়ে লিগ্যাল এইড অফিসে যাই। সেখানে গিয়ে বারসিক কর্মীর কথা বলি। আমার কথা গুরুত্ব দিয়ে শোনে। আমার মেয়েকে আবেদন করার পরামর্শ দেয়। আমরা আবেদন করি। তারা আমাদের একটা তারিখ দেয়। সেই তারিখে আমরা অফিসে গেলে আমার মেয়ের জামাই এবং তার মুরুব্বীদের ও ডাকে। জজ সুন্দর ভাবে আমার মেয়ের জামাইকে বোঝায়। আমার মেয়ের সমস্যা সমাধান করে দেয়। এখন আমার মেয়ে ভালোভাবে সংসার করছে তার স্বামীর সাথে। এই কাজের জন্য আমার এক টাকাও লাগে নাই।”
সদর উপজেলার জাগীর ইউনিয়নের দিয়ারা ভবানীপুর গ্রামের শেফালী বেগম (৪০)। তিনি বলেন, “আমি একজন প্রতিবন্ধী। চোখে দেখতে পাই না। আমার স্বামী আমার কোনো খোজ খবর নেয় না। খোরাকী দেয়না। আমি বারসিক’র কর্মীর কাছে (কইলে) বললে আপা আমারে লিগ্যাল এইড অফিসে যোগাযোগ করার (কতা কয়) পরামর্শ দেয়। আমি অফিসে যাই। আবেদন করি। তারা পরামর্শের জন্য ডাকে। কিন্তু আমার স্বামী আমাকে নিয়ে সংসার করতে চায় না। সে কোনো মীমাংসা মানে না। তখন লিগ্যাল এইড অফিসের সাহায্যে আমি কোর্টে কেস করি আমার খোরাকী আর মোহরানার জন্য। এই কেস চালানোর জন্য আমার এক টাকাও লাগে নাই। আমাগো মত গরিব মানুষের জন্য এই অফিস সহযোগিতা করে।”
সদর উপজেলার কৃষ্ণপুর ইউনিয়নের চরমত্ত গ্রামের শেফালী বেগম (৪৮) বলেন, “আমি আমার ছেলের বউ নিয়ে একবার সমস্যা পড়ছিলাম। বারসিক’র আপার সাথে কথা বললে আপার পরামর্শে লিগ্যাল এইড অফিসে যাই। আমার সমসা নিয়ে কথা বলি। তারা আমাকে পরামর্শ দেয়। যেভাবে কাজ করতে বলে সেভাবে কাজ করি। এই পরামর্শ করার জন্য আমার এক টাকাও লাগে না। একজন উকিলের কাছে পরামর্শ করতে গেলে আমার না হইলেও ৫০০/১০০০ টাকা লাগতো। এখানে কোনো টাকা লাগে না।”
সিংগাইর উপজেলার বায়রা ইউনিয়নের কমলা বেগম বলেন, “আমি আমার মেয়েকে নিয়ে সমস্যায় পড়েছিলাম। বারসিক’র সাথে যোগাযোগ করে লিগ্যাল এইড অফিসে যাই। তাদের সাথে কথা বলি। তাদের পরামর্শ মত বিনামূল্যে কেস করি। সরকার আমার কেস চালায়। আমার মেয়ের দেনমোহরের টাকাসহ খোরাকীর টাকা পাই। আমার মেয়ের সমস্যা সমাধান পাই খুব সুন্দরভাবে। এজন্য আমি বারসিককে ধন্যবাদ জানাই আমাকে তথ্য দিয়ে সহযোগিতা করার জন্য।”
সুবর্ণা সেঁজুতি সিনিয়র সহকারী জজ ও লিগ্যাল এইড অফিসার, মানিকগঞ্জ। তিনি বলেন, “আর্থিকভাবে অসচ্ছল ব্যক্তি যাহার বার্ষিক গড় আয় এক লক্ষ টাকার উপরে নয় তিনি এই আইনী সহায়তা পাওয়ার যোগ্য বলে বিবেচিত হবেন। এছাড়াও কাজ করতে অক্ষম, আংশিক কর্মক্ষম বা কর্মহীন কোন ব্যক্তি, যে কোন শিশু, মানব পাচারের শিকার কোন ব্যক্তি, শারীরিক, মানসিক ও যৌন নির্যাতনের শিকার কোন নারী ও শিশু, নিরাশ্রয় ব্যক্তি, বয়স্ক ভাতা পাইতেছেন এইরূপ কোন ব্যক্তি, ভিজিডি কার্ডধারী কোন দুস্থ মাতা, দুর্বৃত্ত কর্তৃক এসিড ধারী কোন নারী ও শিশু, অসচ্ছল বিধবা, স্বামী পরিত্যাক্তা এবং দুস্থ মহিলা, প্রতিবন্ধী ব্যক্তিরা সরকারী আইনী সহায়তা পাবে।’ তিনি আরও বলেন, ‘আমাদের অফিস থেকে দেওয়ানী, ফৌজদারী ও পারিবারিকসহ সকল প্রকার মামলায় সরকারী খরচে আইনগত সহায়তা প্রদান করা হয়ে থাকে। সেই সাথে মামলা দায়ের ও পরিচালনা করা, কোর্ট ফি প্রদানও এই অফিস করে থাকে। আমাদের ৬৭ জন উকিল রয়েছে লিগ্যাল এইড প্যানেলভুক্ত। কোন ব্যক্তি যদি মনে করে তার পছন্দমত উকিল দিয়ে কেস পরিচালনা করবে তাকে তার পছন্দমত উকিল দেওয়া হয়। এছাড়াও প্রতিটি ইউনিয়ন ও উপজেলা লিগ্যাল এইড কমিটি রয়েছে যেখানে চেয়ারম্যানরা এই সমস্যার সমাধান করে থাকেন। বারসিক গ্রাম পর্যায় উঠান বৈঠক আয়োজন, ইউনিয়ন পর্যায় লিগ্যাল এইড কমিটির সভা আয়োজনসহ বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ভাবে আমাদের সহযোগিতা করে থাকে এজন্য বারসিক কে ধন্যবাদ জানাচ্ছি।”
গোলাপী, শেফালী, কমলার মত অসংখ্য মানুষ প্রতিনিয়ত নানা ধরণের সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছে। বারসিক’র সহযোগিতায় এ পর্যন্ত ২১ জন বিভিন্ন ধরণের আইনি পরামর্শ ও আইনি সেবা গ্রহণ করতে সক্ষম হয়েছে। সরকারি আইনি সহায়তা প্রদানকারি সংস্থা তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে। অসহায় মানুষের সহায় হয়েছে। আর এই সহায়তা যাতে সত্যিকার অর্থেই প্রত্যন্ত গ্রামের দরিদ্র, অসহায় প্রান্তিক মানুষ পায় তার জন্য বারসিক তথ্য, পরামর্শ, যোগাযোগ ও সমন্বয়ের কাজ করে যাচ্ছে।