পাহাড়ি বালুতে বিপর্যস্ত সীমান্তের জনজীবন
নেত্রকোনা থেকে রনি খান
পাহাড়ের পাদদেশে ছবির মতো সুন্দর গ্রামগুলো। একদিকে পাহাড় অন্যদিকে ধানের জমি, মাঝখানে কৃষকের বসত। বিস্তীর্ণ পাহাড় আর হাওরের প্রাকৃতিক সম্পদের উপর ভর করেই এখানকার মানুষের জীবন-জীবিকা। পাহাড় আর হাওরকে কেন্দ্র করেই গড়ে উঠেছে এ অঞ্চলের মানুষের সংস্কৃতি, সামাজিক সম্পর্ক, ইতিহাস-ঐতিহ্য। কিন্তু গত কয়েক বছরে দুর্যোগের ঘনঘটা এ অঞ্চলের মানুষকে নতুন নতুন অভিজ্ঞতার মুখোমুখি করছে। তবে অন্যসব দুর্যোগকে ছাপিয়ে এখন এ অঞ্চলের মানুষের জন্য বড়ো হয়ে উঠছে ‘পাহাড়ি ঢল’। সমৃদ্ধ এক জনপদ ‘পাহাড়ি ঢল’ এর কারণে এখন অস্তিত্ব সংকটে। পাহাড়ি ঢল একদিকে যেমন নষ্ট করছে মানুষের ঘর-গেরস্থালি, আবাদি ফসল। অন্যদিকে তেমনি ঢলের সাথে নেমে আসা পাহাড়ি বালু নষ্ট করছে কৃষকের জমিন। সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, বিস্তীর্ণ ফসলের মাঠ অনাবাদি পড়ে আছে। ধানের ক্ষেতগুলোতে জমা হয়েছে কমপক্ষে ফুট তিনেক বালুর পুরো স্তর। এতোক্ষণ কথা হচ্ছিলো-নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের চন্দ্রডিঙ্গা, সন্ন্যাসীপাড়া, পাঁচগাঁও, চেংগ্নী, পাতলাবন, হাতিবেড়, বাঘবেরসহ আশপাশের গ্রামগুলো নিয়ে। এ অবস্থায় স্থানীয় বাসিন্দারা তাদের ভবিষ্যত নিয়ে ভীত। প্রতিবছর এভাবে পাহাড়ি বালু আসতে থাকলে হয়তো অদূর ভবিষ্যতে তাদেরকে জীবন এবং জীবিকার জন্য অন্য কোথাও পাড়ি জমাতে হবে। যেমনটা ইতিমধ্যেই বেশ কয়েকজন করেছেন বলে জানা গেছে।
প্রশ্ন উঠছে- এ পরিস্থিতিতে কোন কৌশলে টিকে থাকবেন এ অঞ্চলের মানুষ? এবং তারও আগের প্রশ্ন হচ্ছে- কী কারণে প্রায় প্রতিবছরই পাহাড়ি ঢলে সর্বস্ব হারাতে হচ্ছে এই অঞ্চলের মানুষের?
দৈনিক সমকাল-এ ০৬ মে ২০২২ এ প্রকাশিত একটি প্রতিবেদন এবং স্থানীয় মানুষের সাথে কথা বলে জানা যায়, ভারতীয় সীমানায় পাহাড়ে বিভিন্ন উন্নয়ন কর্মকান্ড, পাহাড়ি বন এবং প্রতিবেশ ধ্বংসের কারণে এ ধরণের পাহাড়ি ঢল অকস্মাৎ নিচু অঞ্চল দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যায়। প্রাকৃতিক সুরক্ষা ব্যবস্থা ধ্বংস হয়ে যাওয়ার কারণে পাহাড়ি ঢল, ঢলের সাথে পাথর এবং বালু, পাহাড়ি গাছ, ডাল-পালা মানুষের ঘর-গেরস্থালি এবং ধানের জমিকে ক্ষতিগ্রস্ত করছে। ফলে কৃষিজীবী মানুষের কৃষি ফসল নিয়ে নতুন করে ভাবতে হচ্ছে। ভাবতে হচ্ছে তাদের ফসলের মৌসুম নিয়েও। এবং একই সাথে ফসলের জাত বৈচিত্র নিয়েও। হঠাৎ বন্যা একদিকে যেমন তাদের অভ্যস্ত ফসল চাষকে ব্যাহত করছে অন্যদিকে তাদের উর্বর জমিগুলো বালুতে নষ্ট হয়ে যাওয়ায় বালু সহনশীল ফসল চাষ নিয়েও ভাবতে হচ্ছে। নতুন করে ঘুরে দাঁড়ানো তাঁদের জন্য একই সাথে দুঃসাধ্য কিন্তু অপরিহার্য। একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত অন্যদিকে মানবসৃষ্ট উন্নয়নের এ সংকট মানুষকে নানামূখী জটিলতার সামনে দাঁড় করাচ্ছে। যেহেতু জলবায়ু পরিবর্তন একটি বৈশি^ক সংকট এবং পাহাড়ি বালু একটি আন্তঃরাষ্ট্রীয় সমস্যা তাই খুব দ্রুত এ সমস্যার সমাধান হবে বলে আপাতদৃষ্টে মনে হচ্ছে না। এবং একই সাথে এ বিষয়টিও পরিষ্কার যে পরিষ্কার শুধুমাত্র ত্রাণ দিয়ে এ সমস্যার সমাধান আদৌ সম্ভব নয়। এ ধরণের সংকট মোকাবেলায় ‘অভিযোজন’কে একমাত্র কৌশল হিসাবে নেয়া যেতে পারে।
এ পরিস্থিতিতে বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা বারসিক পরিস্থিতি মোকাবেলায় কৃষকের পাশে দাঁড়ানোর চেষ্টা করছে। বালু সহনশীল ফসল চাষে কৃষকদেরকে উদ্বুদ্ধ করার পাশাপাশি, ধানসহ কি ধরণের ফসল এ অঞ্চলে চাষ করা যায় বারসিক সে বিষয়ে কাজ করে যাচ্ছে। পাশাপাশি পাহাড়ি ঢলের কারণে বিলুপ্তপ্রায় পাহাড়ি ছড়াগুলো পুনঃখনন এবং ছড়া রক্ষায় পাড়ে বাঁশ বাগান করার পরামর্শ দিয়ে যাচ্ছে। স্থানীয় মানুষের নানান অভিজ্ঞতা এবং লোকায়ত চর্চাকে মাথায় রেখেই এ সংকট মোকাবেলা করতে হবে বলে স্থানীয়রা মনে করছেন। একই সাথে সরকারি-বেসরকারি এবং আন্তঃরাষ্ট্রীয় পারস্পারিক সহযোগিতাই এ সংকট সমাধানে কার্যকরী ভূমিকা রাখবে বলে আমাদের বিশ^াস।