একজন আকবর আলীর জীবন সংগ্রাম ও সফলতা
মানিকগঞ্জ থেকে রাশেদা আক্তার
“আল্লাহ আমার দুই চোখ কাইড়া নিছে, কিন্তু আমার অন্তর্চক্ষু খুইলা দিছে।’’ এভাবেই শুরু করেন মো. আকবর আলী তার জীবনের গল্প। মানিকগঞ্জ জেলার জাগীর ইউনিয়নের দিয়ারা ভবনীপুর গ্রামের বাসিন্দা মো. আকবর আলী (৪৩)। ৩ বছর বয়সে আত্মঘাতী কলেরা কেড়ে নিয়েছে তাঁর দৃষ্টিশক্তি। তিনি বলেন, “শুনছি ছোটবেলায় কলেরা হইছিল। কলেরা সাড়লো কিন্তু আমার দুই চোখই অন্ধ কইরা দিয়া গেল। সেই থেকে শুরু হয় আমার সংগ্রামী জীবন। বড় হওয়ার সাথে সাথে আমি বুঝবার পারলাম পরিবার, আশে-পাশের লোকজন ও আত্মীয় স্বজনের কাছে দিন দিন আমার কদর কমতাছে। কেউ আমার সাথে ভালোভাবে কথা কয় না, আমারে দেখলে সইরা যায়। সবাই যে আমারে অবহেলা করতাছে আমি বুঝবার পারলাম। সবার ব্যবহার আমারে ভিতরে ভিতরে কষ্ট দিত।” তিনি বলেন, “আমি ভাবলাম আমি তো মানুষ। আমি কেন মানুষের দয়া নিয়া বাঁচুম। আমি নিজেই কিছু করুম। কীভাবে করলাম তাইলে শুনেন।”
জীবন সংগ্রামে টিকে থাকার জন্য প্রথম উদ্যোগ
২০ বছর আগে মাত্র ৫শ’ টাকার পুঁজি নিয়ে তিনি বাড়ির পাশে বেরীবাঁধে ছালা বিছিয়ে চানাচুর, চকোলেট ও বিস্কুট বিক্রি শুরু করেন। তিনি বলেন, “গ্রামের বাচ্চারা কিনতো এবং ভালোই বেচা-কিনা (বিক্রি) হইত। কিন্তু প্রতিদিন সবকিছু গুছিয়ে বাড়ি নিতে হইত, পরের দিন আবার আনতে হইত। এতে ঝামেলা হইত।” তিনি আরও বলেন, “এক বছর এভাবেই করলাম। পরে বাড়ির লোকজন কইলো (বললো) তাইলে (তাহলে) তুই একটা দোকান দিয়া বস। সুবিধা অইবো (হবে)। কিন্তু দোকান করার ট্যাকা (টাকা) কই (কোথায়) পাই। গ্রামের কেউ সাহায্য করে নাই।” তাঁর স্বপ্ন পূরণ করার জন্য তিনি একটি ব্যাংক থেকে দশ হাজার টাকা ঋণ নিয়ে শুরু করেন তাঁর দোকানের কাজ। দোকান করার পর থেকেই তিনি এই দোকানে বসেই বেচাকেনা করে নিজের জীবিকা নিশ্চিত করেন।
মো. আকবর আলীল জীবন সংগ্রাম
১২ বছর আগে আকবর আলী বিয়ে করে সংসার জীবন শুরু করেন। তিনি তিন কন্যা সন্তানের জনক। দুই মেয়ে লেখাপড়া করছে, ছোট মেয়েটি এখনও স্কুলের উপযোগী হয়নি। সংসার বড় হওয়ার সাথে সাথে তিনি তার দোকানটিও বড় করার উদ্যোগ নেন। ঋণ নিয়ে তিনি দোকানের জন্য একটি ফ্রিজ কেনেন এবং ফ্রিজ থাকার কারণে তিনি ঠা-া জাতীয় খাদ্য যেমন আইসক্রিম, জুস, পানি, দইসহ অন্যান্য পানীয় দোকানে রাখেন। দিনে দিনে তাঁর দোকানে মানুষের ভীড় বাড়তে থাকে। দোকানের মালামাল কোথা থেকে কীভাবে সংগ্রহ করেন জানতে চাইলে তিনি বলেন, “তেল, ডাল, ডিম এই জাতীয় জিনিস আমি নিজে মানিকগঞ্জ বাজারে যাইয়া নিয়া আসি। আর বেকারী ও পানীয় জিনিসপত্র এখানে ভ্যান গাড়ি কইরা আইসা তারা দিয়া যায়। বাজারে আমি একলাই যাই। আমার কোন সমস্যা অয়না। ট্যাকার হিসাবেও কোন সমস্যা অয়না। আমি ট্যাকা ধরলেই বুঝবার পারি এইডা কয় ট্যাকা। ওজনও ঠিকভাবেই দিতে পারি। কেউ কোনদিন কয়নাই তার কম অইছে।” তিনি আরও বলেন, “আমি কাউরে ঠকাইনা। গ্রামের কেউ আমারেও ঠকায় না। পাশেই আরেকটি দোকান অইছে যার কারণে বেচাকেনা একটু কমে গেছে।” দোকানে যা আয় হয় তাই দিয়ে ঋণ পরিশোধ, সংসার চালানো, সন্তানদের লেখাপড়ার খরচ মেটানোর পরও তিনি কিছু টাকা সঞ্চয় রাখকে শুরু করেন। সেই টাকা দিয়ে ২ টি গরু কিনেছেন। গরুর ঘাস কাটা ও দেখাশোনার কাজে তাঁর স্ত্রী (নাছিমা বেগম) তাকে সহযোগিতা করেন বলে তিনি জানান। নাছিমা বেগমের কাছে তার অনুভূতি জানতে চাইলে তিনি বলেন, “আমার স্বামী দৃষ্টি প্রতিবন্ধী হয়েও দোকান করতাছে, নিজে কাজ করতাছে এইডা আমার ভালো লাগে, আমার গর্ব অয়। আমার স্বামী দোকান করতাছে, বাড়িতে আমি গরু পালতাছি আমার স্বামীও আমারে সাহায্য করে। ম্যায়ারা স্কুলে যায়। সংসারে অভাব আছে তারপরও আমি ভালো আছি।”
সমাজে মো. আকবর আলীর মূল্যায়ন
আকবর আলী বলেন, “এই দোকান করার পর থেইকা (থেকে) আমার কারো দয়া নিতে অয়নাই। একসময় যে লোকজন, আত্মীয়-স্বজন আমারে দেখলে দূরে থাকতো আইজ তারাই আমারে তাদের কাছে ডাকে। গ্রামের লোকজন বিভিন্ন অনুষ্ঠানে আমারে দাওয়াত দেয়। যে কোন কাজে আমারে ডাকে এটা আমারও ভালো লাগে। আমি যদি কিছু না করতাম তাইলে কেউ আমারে গুরুত্ব দিত না।” আকবর আলী সম্পর্কে বলতে গিয়ে মো. শমসের আলী (৪৮) গ্রাম মহেশপুর বলেন, “আকবরের একটা ভালো গুণ আছে। ও যে কোন গাড়ির নাম্বার হাত দিয়েই (স্পর্শ করে) কইবার পারে। ট্যাকা ধইরাই শত শত ট্যাকার হিসাব কইরা দিতে পারে। অথচ ও কোন লেখাপড়াই জানে না। আইজ থেইকা অনেক দিন আগে ৮৮ সালে ইত্যাদিতে তারে দেহাইছিল। প্রতিবন্ধী অফিস থেকে কোন ভাতাও পায় না। যদি কিছু ভাতা পাইতো তার উপকার হইতো।” মানুষের মূল্যায়ন সম্পর্কে আকবর আলী বলেন, ‘‘আইজ ছোট একটা দোকান করতাছি তাতে কোন দুঃখ নাই। নিজে যে কিছু করবার পারতাছি এবং লোকজন আমারে কাজের মূল্য দিতাছে তাতেই আমি খুশি।’’
মো. আকবর আলীর স্বপ্ন
আকবর আলী একদিন স্বপ্ন দেখেছিলেন তিনি কারো দয়ায় নয়, নিজে কাজ করবেন। নিজের পায়ে দাঁড়াবেন। তাঁর সে স্বপ্ন আজ পূরণ হয়েছে। এখন তিনি স্পœ দেখেন তার সন্তানদের তিনি লেখা-পড়া শিখিয়ে মানুষ করবেন। তিনি বলেন, “কম কইরা হইলেও আমি আমার তিন ম্যায়ারে (মেয়েকে) ম্যাট্টিক পর্যন্ত পড়ালেখা শিখামু। ওরা যাতে কইতে না পারে আমার বাবায় অন্ধ বইলা আমাগো পড়ালেখা শিখায় নাই। আমি এই দোকান করে ভালোই আছি। এভাবেই দোকান করে কারো দয়ায় নয় নিজে উপার্জন করে ভালোভাবে বাঁচতে চাই। আমি চাই আমার মত যারা আছেন তারাও চেষ্টা করেন কিছু করার। মানুষের দয়া না নিয়ে নিজে কিছু করেন, মানুষের মত বাঁচেন।”
আমাদের গ্রামে-গঞ্জে, সমাজে এমন অনেকে আছেন যারা অন্যের দয়া নয়, করুণা নয়, নিজ সক্ষমতাবলে নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে অন্যদের দেখিয়ে দিয়েছেন তারাও ‘পারেন’। এই জন্য প্রয়োজন কেবল ইচ্ছাশক্তি ও চেষ্টা। তাদের এই স্বাধীনচেতা মনোভাব ও ইচ্ছেশক্তিকে কাজে লাগিয়ে তারা যাতে স্বাধীনভাবে কাজ করতে পারে সেসব আত্মপ্রত্যয়ী মানুষের স্বপ্নের সেই পথকে সুগম করা আপনার আমার সবার দায়িত্ব।