নারী কৃষক সম্মেলনে নারীর প্রতিবাদী কণ্ঠস্বর
সিংগাইর থেকে শিমুল বিশ্বাস
“আমরা এহন থেইক্যা আর চুপ করে থাকুম না।” গত ১৬ ডিসেম্বর বারসিক সিংগাইর রিসোর্স সেন্টারে নারী কৃষক সম্মেলন অনুষ্ঠানে এমন কথা বলেন গাড়াদিয়া কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সদস্য মনোয়ারা বেগম। এ কথা শুধু মনোয়ারা বেগমের নয়, গ্রামের অধিকাংশ নারীর মনের কথা। যখন উপযুক্ত পরিবেশ পান তখনই মনের অজান্তে মুখ থেকে বেরিয়ে আসে এমন প্রতিবাদী ভাষা। মূলত এ উপলব্ধি থেকে বেসরকারি গবেষণাধর্মী প্রতিষ্ঠান বারসিক প্রথমবারের মত সিংগাইর এলাকার ১২ জনসংগঠনের প্রতিনিধি নিয়ে নারী কৃষক সম্মেলনের আয়োজন করে।
এতে মনোয়ারা বেগম ছাড়াও বায়রা, নয়াবাড়ি, নয়াবাড়ি আদর্শগ্রাম, জামালপুর, গাড়াদিয়া, ব্রী কালিয়াকৈর, ছোটকালিয়াকৈর, বাংগালা, নবগ্রাম, কাস্তা, সোলাই সংগঠনের আরো ৪২ জন নারী প্রতিনিধি অংশগ্রহণ করে নারীর প্রতি হওয়া বিভিন্ন ধরনের বৈষম্যের বিষয়টি তুলে ধরেন। পাশাপাশি নারীরা যাতে তাদের সমস্যাগুলো নিজেরাই তুলে ধরতে পারেন তার জন্য তারা গঠন করেন ২১ সদস্য বিশিষ্ট উপজেলা নারী উন্নয়ন আহব্বায়ক কমিটি। মূলত এ কমিটি নারী উন্নয়ন তথা নারীর ক্ষমতায়ন এবং আর্থসামাজিক উন্নয়নের পক্ষে কাজ করবে বলে তারা মন্তব্য করেন।
সম্মেলন উপলক্ষে আয়োজিত আলোচনা সভায় সভাপতিত্ব করেন বাংগালা কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সাধারন সম্পাদক সেলিনা বেগম। এ আলোচনা সভায় ১২টি কৃষক কৃষাণি সংগঠনের নারী প্রতিনিধিগণ নিজ নিজ অভিজ্ঞতার আলোকে বক্তব্য তুলে ধরেন। তারা বলেন পরিবার, ‘সমাজ এবং রাষ্ট্র সকল ক্ষেত্রেই নারীরা অবহেলিত। তাই এর প্রতিকার হওয়া দরকার। কিন্তু অধিকাংশ ক্ষেত্রে নারীরা তাদের মনের কথা বলতে সংকোচবোধ করেন। কারণ বাঙালি সমাজ ব্যবস্থায় অধিকাংশ নারীই লাজুক স্বভাবের।’ তারা পুরুষের পাশাপাশি বসে এ সমাজের দ্বারা তাদের প্রতি হওয়া বৈষম্যর কথা বলতে পারেন না। তাছাড়া অধিকাংশ সময় পুরুষরাই তাদের কথা বলে, নারীর কথা ঢাকা পরে থাকে। তাই নারীরা যাতে নিজেদের কথা বলতে পারে তার জন্য আলাদা ভাবে চর্চা করা দরকার আছে বলে মনে করেন।
এ বিষয়ে বায়রা কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সভাপতি রোকেয়া বেগম বলেন, ‘আমাগো সমাজে নারীরা, পুরুষের সামনে কোন কথাই কইবার চায়না। লজ্জা পায়। যার জন্য কোন হানে (কোন জায়গায়) কথা কইবার কইলে পলাইবার চায়। আমরা আজ যে সংগঠনডা করলাম সেইহানে (সেখানে) আমরা নিজেরা কথা কইবার অভ্যাস করবার পারুম। তাইলে বড় কোন হানে কথা কইবার কইলে আর পালাইতে অইবো না।’
নয়াবাড়ি আদর্শ গ্রাম কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সভাপতি কমলা বেগম বলেন, ‘এহন আমাগো কথা আমরাই কইবার পারবো। কারণ আমাগো ভালো মন্দ আমরাই বুঝি। পুরুষ মানুষতো আমাগো কথা বুঝবো না।’
নয়াবাড়ি আদর্শগ্রাম কৃষক কৃষাণি সংগঠনের সদস্য জয়তুন বেগম বলেন, ‘আজ থেকে আমরা সব জায়গাতেই প্রতিবাদ করুম। কারণ আমরা কি আমাগো সংসারে কম কাম করি? তাও সব সুময় শুনুন লাগে, আমরা কাম করি না। এইডার আগে পরিবর্তন আনা দরকার।’
নারী কৃষক সম্মেলনের মাধ্যমে নবগঠিত সিংগাইর অগ্রগামী নারী উন্নয়ন কমিটির আহব্বায়ক সেলিনা বেগম বলেন, ‘আমরা এ কমিটির মাধ্যমে আমাদের এলাকায় নারীর প্রতি হওয়া যে কোন ধরনের বৈষম্য ও নির্যাতনের বিরুদ্ধে ঐক্যবদ্ধ হয়ে কাজ করতে পারবো। সে জন্য আমাদের নিয়মিত প্রত্যেকের সাথে যোগাযোগ ও আলোচনা করার প্রয়োজন আছে।’
পরিশেষে তিনি আগামী বছরের জানুয়ারি মাসে নবগঠিত আহব্বায়ক কমিটির আলোচনা সভায় বসার আহব্বান জানিয়ে সভার সমাপ্তি ঘোষণা করেন।