আসুন প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষা করি, আন্তঃনির্ভরশীলতা বাড়াই
নেত্রকোনা রুখসানা রুমী
প্রাণ ও প্রকৃতি নেত্রকোনা অঞ্চলের মানুষকে করে তুলেছে বিখ্যাত কবি, সাহিত্যিক, সাধক, গায়ক, বউল, কবিয়াল ও গবেষক। নেত্রকোনার হাওর ও সীমান্ত পাহাড়ের অপরাপর সৌন্দর্য্যের সেই প্রকৃতি মানুষের নির্দয় আচরণে আজ বিপন্ন প্রায়। দিন দিন সৃষ্টি হচ্ছে মানুষ ও প্রকৃতির মধ্যে বিস্তর ফারাক। প্রাকৃতিক বৈচিত্র্যময় হাজারও প্রাণ আছে বলেই জীবন আমাদের এত সুন্দর। সচেতন মানুষ এসব প্রাণবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখার জন্য এককভাবে ও সংগঠিতভাবে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করে তা বাস্তবায়ন করে আসছে। নেত্রকোনা জেলার সদর উপজেলার ফচিকা গ্রামের এমনই একটি কিশোরী সংগঠন, যারা প্রাণবৈচিত্র্য সম্পর্কে জনসচেতনতা বৃদ্ধি এবং প্রাণবৈাচত্র্য সংরক্ষণে জনগোষ্ঠীকে উদ্বুদ্ধকরণে বিভিন্ন ধরণের উদ্যোগ (বৃক্ষ রোপণ, কিশোরী তথ্য কেন্দ্র, কুড়িয়ে পাওয়া খাদ্য ও ঔষধি উদ্ভিদের মেলা আয়োজন ও এসব উদ্ভিদ সংরক্ষণ) নিয়ে সেগুলো বাস্তবায়ন করে আসছে।
কিশোরী সংগঠনের উদ্যোগে গত সোমবার গ্রামীণ নারী-পুরুষদের ও যুবদের নিয়ে গ্রামের কিশোরী তথ্য কেন্দ্রে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় ‘প্রাণবৈচিত্র্য দিবস’ উপলক্ষে এক সমাবেশ অনুষ্ঠিত হয়। অনুষ্ঠানে গ্রামের নারী-পুরুষ, শিশু, বিশেষভাবে সক্ষম ব্যক্তি, প্রবীণ, কুমার, কামার, নরসুন্দর, যুব ও শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন পেশা ও বয়সের জনগোষ্ঠী অংশগ্রহণ করে। অনুষ্ঠানের আয়োজনের মধ্যে ছিল আলোচনা অনুষ্ঠান, গাছ চেনা, গাছ রোপই, প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় রচনা প্রতিযোগিতা এবং প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষণায় অংশগ্রহণকারীদের শপথ গ্রহণ। ফচিকা গ্রামের প্রবীণ কবিরাজ আবুল হামিদ অনুষ্ঠানটি উদ্বোধন করেন এবং অনুষ্ঠানের মূল আলোচক হিসেবে অংশগ্রহণ করেন, যিনি ২০১৮-২০১৯ মৌসুমে নেত্রকোনা অঞ্চলে প্রায় পঞ্চাশ হাজার বৈচিত্র্যময় প্রজাতির গাছের চারা বিতরণ করেছেন বিনামূল্যে।
অন্যান্য আলোচকদের মধ্যে ছিলেন গ্রামের প্রবীণ নারী হালেমা খাতুন, যুব প্রতিনিধি শাহীন মিয়া ও অপূর্ব। কিশোরী সংগঠনের নেতা লাবণী আক্তার তার আলোচনায় নিজ গ্রামের বৈচিত্র্যের চিত্র তুলে ধরেন। তিনি বলেন, ‘গ্রামে ফলদ ও ঔষধি গাছ আশংকাজনক হারে কমে গেছে, বিদেশেী কাঠ জাতীয় গাছের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। ফলদ ও ঔষধি গাছ কমে যাওয়ার ফলে এলাকায় পাখি, মৌমাছি ও প্রজাপতির সংখ্যা কমে গেছে। যার প্রভাব আমাদের কৃষি ফসলের ফলনের উপর, কৃষকের অর্থনীতির উপর ব্যাপক প্রভাব ফেলছে। দিন দিন কমে যাচ্ছে এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য। আগে আমাদের বাজার থেকে কোন ফল কিনে খেতে হত না, বছরের বারোমাসিই বৈচিত্র্যময় ফল খেতে পারতাম।’ তিনি আরও বলেন, ‘গাছের সাথে যেমন মানুষের আত্মার সম্পর্ক, তেমনি প্রাণী জগতের সাথেও মানুষের নিবিড় সম্পর্ক রয়েছে। আমাদের বাঁচতে হলে আশেপাশের প্রকৃতি ঠিক রাখতে বৈচিত্র্যময় গাছপালা বেশি বেশি লাগতে হবে। আসুন আমরা সবাই মিলে প্রকৃতিকে রক্ষার করি এবং এলাকার প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় শপথ করি। আমরা আগামী দিনের ভবিষ্য, আমরাই পারি গাছপালা, নদী, নালা, খাল-বিল, পুকুর ও জলাশয় রক্ষার মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে।’
যুব প্রতিনিধি শাহীন মিয়া বলেন,‘আসলে প্রাণবৈচিত্র্য কি সে বিষয়ে আমার তেমন কোন ধারণা নাই বললেই চলে। আজকে এই প্রাণবৈচিত্র্য দিবস উপলক্ষে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে এবিষয়ে জানতে পেরেছি। অভিজ্ঞ ব্যক্তিদের আলোচনা থেকে দিবসের তাৎপর্য সর্ম্পকে ধারণা পেয়েছি। আজ থেকে সকলের সাথে আমিও শপথ করলাম প্রাণবৈচিত্র্য রক্ষায় একযোগে কাজ করব। আমরা সবাই স্থানীয় জাতের ফলদ ও ঔষধি গাছ লাগাব এবং এলাকার অন্যদেরকেও স্থানীয় জাতের গাছের চারা রোপণে উদ্বুদ্ধ করব এবং সকলে মিলে সকল প্রাণ রক্ষা করব।’ অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণকারী ২০ জন কিশোর-কিশোরী, প্রবীণ সকলেই বিভিন্ন ধরণের প্রাণীর নাম লেখা কার্ড-মাছ, পাখি, ব্যাঙ, গাছ, মৌমাছি, কোচোঁ, মাটি প্রদর্শন করে অভিনয়ের মাধ্যমে প্রাণবৈচিত্র্য টিকিয়ে রাখতে সকল প্রাণের প্রতি সহিংসতা রোধ করবো বলে শপথ নেন।
বৈচিত্র্যময় উদ্ভিদ সংরক্ষক ও কবিরাজ আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের প্রত্যেকেই কমপক্ষে দু’টি করে ঔষধি গাছের চারা, দু’টি করে ফলের চারা লাগাতে হবে।’ তিনি ঔষধি গাছের গুণাগুণ বিষয়ে অংশগ্রহণকারীদের ধারণা দেন এবং অংশগ্রহণকারী যুব ও কিশোরদের পাশের জঙ্গলে নিয়ে বিভিন্ন ধরণের উদ্ভিদ ও গাছের সাথে পরিচয় করিয়ে দেন। অনুষ্ঠান শেষে তিনি প্রত্যক অংশগ্রহণকারীকে বিনামূল্যে একটি হরিতকি ও একটি করে আমলকি গাছের চারা বিতরণ করেন। বারসিক কর্মকতা প্রাণবৈচিত্র্য দিবসের তাৎপর্য ও পঁচিশ বছরের প্রাণবৈচিত্র্য অভিযাত্রা আমাদের দেখা অদেখা সকল বৈচিত্র্য নিয়ে সকল সদস্য সাথে বিস্তারিতভাবে আলোচনা করেন।
ফচিকা অগ্রযাত্রা কিশোরী সংগঠনের ন্যায় সকল গ্রামের কিশোর-কিশোরী ও যুব সমাজ সংগঠিত হয়ে এ ধরণের উদ্যোগ নিলে সকল এলাকার জনগোষ্ঠীকে সহজেই প্রাণবৈচিত্র্য বিষয়ে সচেতন করা সম্ভব। কিশোর-কিশোরী, যুব, প্রবীণ এবং সকল বয়সের একক ও সংগঠিত উদ্যোগেই রক্ষা পাবে আমাদের প্রকৃতি, সুরক্ষিত থাকবে হাজারো প্রাণবৈচিত্র্য। রক্ষা পাবে কৃষকবান্ধব সকল প্রাণী, বৃদ্ধি পাবে কৃষি ফসলের উৎপাদন এবং বৃদ্ধি পাবে আন্তঃনির্ভরশীলতা। আমাদের সমাজ পরিণত হবে সুখি, সমৃদ্ধি ও আন্তঃনির্ভরশীল একটি উন্নত সমাজে।