বরেন্দ্র প্রকৃতি যেন নতুন রুপে সেজেছে
রাজশাহী থেকে শহিদুল ইসলাম
প্রায় শত বছর বয়সের প্রবীণ কৃষক ইউসুফ আলী মোল্লা। বছরে পর বছর থেকে রাজশাহীর তানোর উপজেলার দুবইল গ্রামেই বসবাস করছেন। মিশে আছেন প্রকৃতির সাথে। প্রাণ প্রকৃতি আর বৈচিত্র্য সুরক্ষা করাই তাঁর একটি বড়ো কাজ। চারিদিকে মানুষ যখন তাঁর নিজের লাভের জন্য ছুটে চলেন ইউসুল আলী মোল্লা তখন নিজের এলাকার হারানো শস্য ফসলের জাত সুরক্ষায় ব্যস্ত সময় পার করেন। দেশী প্রায় বিলুপ্ত ধানের শত শত জাত ধরে রেখেছেন তিনি। শুধু ধানই নয়। তিনি বিভিন্ন রবিশস্যের জাতগুলোও সংরক্ষণ করেন। জীবিত করে রাখতে প্রতিবছর প্রতিমৌসুমে নিজে জমি চাষ করে সেগুলো ফলানোর চেষ্টা করেন। ধান আর শষ্য ফসলের প্রতি তাঁর ভালোবাসা সবকিছুকেই হার মানায়। এই অবদানের জন্য সরকার তাঁকে জাতীয় পরিবেশ পদকে ভূষিত করেছেন। একটি ধান সংগ্রহের জন্য তিনি বাংলাদেশের বিভিন্ন জেলায় চলে যান। ধান আর শস্য ফসলের জাত সংগ্রহ যেন তাঁর একটি বড়ো নেশা।
করোনাভাইরাসের কারণে বর্তমান সারাবিশ্বে এক ধরনের লকডাউন চলছে। গোটা পৃথিবীতে মৃত্যুর মিছিল শুরু হয়ে গেছে। কিছুতেই যেন থামছেনা। এখন আজ অবধি ১১ লাখের বেশী মানুষ করোনাভাইরাসের আক্রান্ত হয়ে মরে গেছেন। বাংলাদেশেও মহামারি করোনাভাইরাসে আক্রান্ত হয়েছে। কেউ ঘর থেকে বের হতে পারছেন না। বের হচ্ছেন না। শহরের মানুষগুলো ঘরের কোনায় বসে বসে দিন পার করছেন। কিন্তু গ্রামের মানুষগুলো ঘর থেকে জানালা দিয়ে চোখ মেললেও তাঁর চিরচেনা প্রকৃতির দিকে চোখ মেলে তাঁর রুপ ও বৈচিত্র্য দেখতে পান। রুপ আর বৈচিত্র্যে ভরা বরেন্দ্র অঞ্চল।
করোনাকালিন এই মহাদূর্যোগে বরেন্দ্র অঞ্চলের রুপ ও বৈচিত্র্য যেন আলাদা এক জীবন্ত রুপ পেয়েছে। প্রকৃতির প্রাণীগুলোর আচরণ আর বিচরণে এসেছে জীবন্ত এবং আনন্দময় এক রুপ। এমনটাই জানালেন প্রকৃতি প্রেমী ইউসুফ আলী মোল্লা। দীর্ঘ এই জীবনের অভিজ্ঞতা থেকে তিনি তাঁর আপন প্রকৃতি বরেন্দ্র অঞ্চলের এই সময়ের প্রাণ প্রকৃতির বর্তমান দিকগুলো নিয়ে কথা বলেন।
বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর পরেই বরেন্দ্র অঞ্চলের অনেক বড় বড় গাছগুলো কেটে ফেলা হয়। সে সময় পুকুর পাড়ে, রাস্তার ধারে বড় বড় গাছগুলো শোভা পেতো। নানাজাতের পাখি দেখা যেতো। হরেক রকমের বনজ লতাপাতা দেখা যেতো। শত শত রকমের প্রজাপতিরা ঘুরে বেড়াতো। ফুলে ফুলে মৌমাছি মধু আহরণ করতো। বনজ বহুফুলের সেই মধু ছিলো কতো সুমিষ্ট আর ঘ্রাণে ভরা। দিনে সেই মধুর সুমিষ্টতা আর গন্ধও যেন হারিয়ে গেছে। চারিদিকে রাসায়নিক সার, কীটনাশকের বহুবিধ ব্যবহারে আমাদের প্রকৃতিকে যেন শেষ করে দিতে ছিলো। নতুন করে শুরু হয়েছে এই এলাকায় কলকারখানা। প্রকৃতিকে তোয়াক্কা না করেই মানুষের উন্নয়নমুখী এই কার্যক্রম যেন সবকিছুকে শেষ করে দিতেছে।
করোনার কারণে প্রায় ১ মাস থেকে সবকিছু জঞ্জাল যেন বন্ধ হয়েছে। যেগুলো প্রকৃতির জন্য জঞ্জাল তা আর এখন নেই। এই সুযোগে প্রকৃতি যেন নতুন রুপে সেজেছে। নিমগাছগুলোতে দীর্ঘ ৩০ বছরের তুলনায় এতোটাই বেশী ফুল এসেছে যে, তার মধু সংগ্রহে মৌমাছিরা সারাদিন ব্যস্ত হয়ে গেছে। মৌমাছির আনাগোনাও যেন বেড়ে গেছে। পাখির বিচরণে এসেছ পরিবর্তন। ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, “পাখিরা মন খুলে গান গাচ্ছে।”
বিগত দিনগুলোর সেই গানের সাথে তিনি বর্তমান সময়ে গানের মধ্যেও তফাত খুজে পেয়েছেন। তাঁর কাছে মনে হচ্ছে পাখিরা প্রাণভরে সুখের টানে এখন গান গাচ্ছে। প্রায় ২০ থেকে ৩০ বছর থেকে কিছু পাখির দেখা পাওয়া যায়নি। এখন সেরকম কিছু পাখি গ্রামে দেখা যাচ্ছে। স্বাধীনতার সময়েও গ্রামে তিন ধরনের শালিক দেখা যেতো। স্থানীয় ভাষায় পোড়া শালিক, গাং শালিক আর আবলতি শালিক। প্রায় দশ-বিশ বছরে পোড়া শালিকের দেখা মেলেনি। ইউসুফ আলী মোল্লা বলেন, “তারঁ বাড়িতেই এক জোড়া পোড়া শালিক এসে বাসা বেঁধেছে। বাবুই পাখির আনাগোনা বেড়েছে। তালের গাছে এসে বাবুই পাখি বাসা বেঁধেছে। ডাহুক আর কোকিলের সুরেলা সুর আগের থেকে বেশী শোনা যাচ্ছে। মাঠের মধ্যে বাড়ীর আনাচে কানাচে আগের তুলনায় ফড়িং বেশী দেখা যাচ্ছে। সবমিলিয়ে প্রকৃতি যেন আগের তুলনায় নতুন করে সেজেছে।