মানুষ গড়ার কাড়িগর থেকে জনপ্রতিনিধি তাহেরা খাতুন
নেত্রকোনা জেলার কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের জনপ্রতিনিধি তাহেরা খাতুন (৫৮)। কলমাকান্দা উপজেলায় তিনিই প্রথম ও একমাত্র ইউনিয়ন পরিষদের নারী চেয়ারম্যান। স্বামী নজরুল ইসলামও একসময় এই ইউনিয়নের চেয়ারম্যান ছিলেন। তার স্বামী ২০০৯ সালে মারা যাওয়ার তিনি সংসারের হাল ধরেন। শুধু তাই নয় বিদ্যালয় শিক্ষকতা করেছেন দীর্ঘদিন ধরে। বর্তমানে রংছাতি ইউনিয়নের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব পালন করছেন। তিনি শিশুকাল থেকে শিক্ষাক্ষেত্রে মেয়েদের এগিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে যেমন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছেন, অপরদিকে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে ও বর্তমানে জনপ্রতিনিধি হয়েও গ্রামাঞ্চলের অনেক নারীদের জন্য সৃষ্টি করেছেন নব দিগন্ত। বারসিক নিউজডট কম এর পক্ষ থেকে এই সংগ্রামী নারীর জীবন ও সংগ্রামের চিত্র এই সাক্ষাৎকারের মাধ্যমে তুলে ধরেছেন অর্পণা ঘাগ্রা।
বারসিক নিউজ ডট কম: আপনাদের সময়ে মেয়েদের লেখাপড়ার পরিবেশ কেমন ছিল?
তাহেরা খাতুন: আমাদের সময়ে গ্রামাঞ্চলে বিশেষভাবে আমার বাবার বাড়ি ময়মনসিংহের ফুলপুর থানার ডাকুয়া গ্রামে মেয়েদের লেখাপড়া করানোর মত মানসিকতা অভিভাবকদের ছিলো না। কিন্তু আমার বাবা ডাকুয়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষক হওয়ায় আমার লেখাপড়া করার ক্ষেত্রে তেমন কোন বাধা আসেনি। কিন্তু আমাদের এলাকার অন্য কোন মেয়েকে তাদের পরিবার স্কুলে পাঠাতেন না। তাই আমি যখন বিদ্যালয়ে ভর্তি হই তখন কোন মেয়ে সহপাঠী পাইনি। অনেক ছাত্রের মাঝে আমি একাই ছিলাম ছাত্রী । প্রথম দিকে একটু খারাপই লাগতো। কিন্তু লেখাপড়া করার প্রচন্ড ইচ্ছায় আমি স্কুলে যেতে বাধ্য হতাম। ধীরে ধীরে ছাত্রদের সাথে যখন সখ্যতা বাড়ল, তখন ক্লাস করতেও ভালো লাগল। তারাই একসময় আমাকে স্কুল ক্যাপ্টেন বানিয়ে দিল। তখন মনের ভেতর নিজেকে নিয়ে গর্ব হতো।
বারসিক নিউজ ডট কম: মেয়েদেরকে স্কুলমূখী করার পেছনে আপনার কোন ভূমিকা ছিল কি?
তাহেরা খাতুন: এক সময় অনেক মেয়েদের অভিভাবক আমাকে স্কুলে যেতে দেখে নানা কথা বলতো। তারা বলতো পড়াশুনা করে মেয়েরা কিছুই করতে পারবে না, সেই রান্নাঘরেই কাটাতে হবে, শুধু শুধু পড়াশুনা করে সময় নষ্ট করার কোন প্রয়োজন নাই ইত্যাদি ইত্যাদি। তখন ছোট ছিলাম বলে কোন কথার জবাব দিতে পারতামনা। তবে সমবয়সীদের সবসময় বলতাম তোমরাও স্কুলে আস, অনেক কিছু শিখতে পারবে। কিছু কিছু অভিভাবকদেরও বলতাম তাদের মেয়েরা স্কুলে গেলে অনেক কিছু শিখতে পারবে। এভাবে এক বছর কেটে যাওয়ার পর ২-৩ জন মেয়ে স্কুলে ভর্তি হয়ে গেল। পরের বছর আরো বাড়লো। এভাবে প্রতিবছর বেড়েই চলল। বর্তমানে ঐ স্কুলে মেয়ে শিক্ষার্থীর সংখ্যাই বেশি। এখন ওই স্কুলের অনেক মেয়েরা শিক্ষিত হয়ে অনেক ভালো অবস্থানে আছে। এটি ভাবতেই ভালো লাগে।
বারসিক নিউজ ডট কম: কর্মক্ষেত্রে আপনার বিচরণ গ্রামাঞ্চলের নারীদের ক্ষেত্রে কেমন প্রভাব ফেলেছে বলে আপনি মনে করেন?
তাহেরা খাতুন: ১৯৭৪ সনে এসএসসি পাশ করার পর আমার বিয়ে হয়ে যায় কলমাকান্দা উপজেলার রংছাতি ইউনিয়নের নলুয়াপাড়া গ্রামে। পাঁচ সন্তানের মা হওয়ার পর ১৯৮৭ সালে চাকুরি হয় সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের সহকারী শিক্ষিকা হিসেবে। পরবর্তীতে আমগড়া সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ে দীর্ঘ ২০ বছর শিক্ষকতা করেছি। সেই সময় শিক্ষিত লোক খুঁজে খুঁজে চাকুরি দিয়েছে। এখনকার মত চাকুরি পেতে কষ্ট করতে হয়নি। আমি হেঁটে হেঁটে অনেকগুলো গ্রাম পাড়ি দিয়ে স্কুলে যেতাম। রাস্তায় অনেক নারীর সাথে কথা হতো, তাদের উৎসাহ দিতাম, বলতাম সংসারের বাইরেও নারীদের আলাদা জগৎ আছে। অনেক নারীই পরবর্তীতে চাকুরি ক্ষেত্রে এগিয়ে এসেছে।
বারসিক নিউজ ডট কম: শিক্ষকতা পেশা ছেড়ে জনপ্রতিনিধিত্ব করার বিষয়টিকে কিভাবে দেখছেন?
তাহেরা খাতুন: আগে মানুষ গড়ার কারিগর ছিলাম, এখন জনপ্রতিধি। ২০১৬ সালে ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান হওয়ার পর থেকে আমার বিচরণের জায়গা আগের তুলনায় অনেক বেড়ে গেছে। আগে শিশুদের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলেছি পাঠ্য পুস্তকের বিষয় নিয়ে। এখন সব বয়সের, সব শ্রেণী, পেশার মানুষের সামনে দাঁড়িয়ে কথা বলি মানুষের জীবনের সাথে সম্পৃক্ত প্রত্যেকটি বিষয় নিয়ে। আমি মনে করি সুযোগ পেলে নারীরা সব কাজই দক্ষতার সাথে পালন করতে পারে। তাই নারীদের আরো সক্রিয়ভাবে সকল কাজে এগিয়ে আসা উচিত।
বারসিক নিউজ ডট কম: আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ।
তাহেরা খাতুন: আপনাকেও ধন্যবাদ।