একজন আদর্শ কৃষক লতিফ মিয়া
নেত্রকোনা থেকে মো: সুয়েল রানা
প্রকৃতি, পরিবেশ ও কৃষির সাথে রয়েছে কৃষকের নিবিড় সর্ম্পক। জীবিকায়নের জন্য প্রকৃতির ভালোমন্দ দুইয়ের সাথে সখ্যতা করে জীবনযাপন করেন। প্রকৃতির বিরূপ প্রভাবকে রুখতে না পারলেও নিজেদের চর্চার মাধ্যমে অর্জিত দক্ষতা, অভিজ্ঞতা ও সম্পদকে কাজে লাগিয়ে নিজের জীবিকা নির্বাহ করেন। কৃষক পরিবেশ রক্ষায় যে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন তা অস্বীকার করার উপায় নেই কারও। আধুনিক কৃষির আগমনের পর যেখানে সবাই উচ্চ ফলনশীল জাতের দিকে ঝুকছে, বাণিজ্যিক ভিত্তিতে ফসল চাষ রাসায়নিক সার, বিষ ব্যবহার, আধুনিক পদ্ধতির ব্যবহার, অধিক উপকরণ নির্ভরতা, বাজার থেকে বীজ কিনে চাষ করার প্রবণতা যেখানে প্রকটতা ধারণ করে সেখানে কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়া পরিবেশবান্ধব উপায়ে পরিবারের শতভাগ পুষ্টির চাহিদা ও নিরাপদ খাদ্য চাহিদা পূরণ করেন তার উৎপাদিত কৃষি ফসল থেকে। মো: আব্দুল লতিফ মিয়া (৪৪+) আটপাড়া উপজেলার কৃষ্ণপুর গ্রামে বাস করেন।কৃষি হবে কৃষকের এটাই স্বাভাবিক। কিন্তু যতই দিন যাচ্ছে কৃষি যেন কৃষকের নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। হারিয়ে যেতে বসেছে স্থানীয় জাতের ধানসহ সকল শস্যফসল। এছাড়া হাতছাড়া হয়ে যাচ্ছে কৃষকের নিজস্ব সম্পদ বীজ। কৃষক এখন বাজারমুখি হচ্ছেন। দিনকে দিন কমে যাচ্ছে কৃষক কৃষক আন্তঃনির্ভরশীলতা। কৃষক নির্ভরশীল হয়ে পড়ছেন মহাজন, বাজার ও কোম্পানির উপর। এই পরিস্থিতিতে নেত্রকোনার আটপাড়া উপজেলার স্বমুশিয়া ইউনিয়নের কৃষ্ণপুর গ্রামের আব্দুল লতিফ মিয়ার বাড়িতে গেলে চোখে পড়ে অন্যরকম এক দৃশ্য।
কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়া জন্ম গ্রহণ করেন ১৯৭৮ সালে, শৈশব থেকেই তার বাবার হাত ধরেই কৃষি কাজে মনোনিবেশ করে কৃষি কেন্দ্রিক জ্ঞান অর্জন শুরু করেন তিনি। দরিদ্র পিতার অভাবের সংসারে কষ্ট করে প্রাথমিক বিদ্যালয় পর্যন্ত পড়ালেখার পর তার পিতার পরিশ্রম সহভাগিতার মধ্য দিয়েই পুরোদমে কৃষি কাজের সাথে যুক্ত হন তিনি। সবতভিটায় সবজি চাষ, হাঁস-মুরগি, কবুতর ও গরু-ছাগল পালন করা ছিল তার নেশা আর এই নেশাই পরিণত হয়েছে পেশায়। প্রকৃতির প্রতি ভালোবাসাই কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়াকে করেছে প্রকৃত কৃষক। আর এই কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়াই তার নিজস্ব চিন্তা, দক্ষতা, পরিশ্রম, অভিজ্ঞতা ও সামর্থ দিয়ে তার বাড়িটি তৈরি করেছেন নানা জাতের বৈচিত্র্যময় ফসলের শস্যভান্ডার হিসাবে।
কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়া ১০ শতাংশ জমিতে সারাবছর বৈচিত্র্যময় ফসল চাষ করেন। উক্ত জমিতে চারপার্শে¦ সবজির মাঁচা এবং মাঝখানে ছোট ছোট প্লট আকারে মৌসুমভিত্তিক বারোমাস বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেন। তিনি সারাবছর বসতভিটা এবং জমিতে লাউ, বেগুন, আলু, সিম, লালশাক, ডাটা, মিষ্টিকুমড়া, চালকুমড়া, ধুন্দল, পুইশাক, কচ, মুখিকচু, পাটশাক, টমেটু, শসা, করলা, মূলা, সরিষা শাক, ঝিংগা, চিচিঙ্গা, সাজনা, পেঁপে, কাকরুল, আলুশাক, ঢেরস, কাচাকলা, বরবটি, চুকাই চাষ করেন। তিনি অবশ্য কালিজিরা, আইজং, রতিশাইল, বোরোআবজি চাষ করেন। এছাড়া মসলা জাতীয় ফসলও চাষ করেন, যার মধ্যে রয়েছে আদা, হলুদ, মরিচ,লইন ইত্যাদি। বাড়ির চারপাশে তিনি বিভিন্ন ধরণের ফলজ গাছ আম, জাম, কাঠাঁল, জলপাই,জামবুড়া,আতাফল,লিচু, বেল, আমড়া, কলা, সাজনা, চালতা, লেবু ইত্যাদি রোপণ করেছেন। কৃষক আব্দুল লতিফ একজন অচাষকৃত উদ্ভিদ সংরক্ষণকারী, তিনি চাষকৃত সবজির পাশাপাশি অচাষকৃত উদ্ভিদও পরিবারে খাবারের তালিকায় রাখেন। ছোটখাট রোগবালাইয়ের ক্ষেত্রে তিনি ডাক্তারের কাছে না গিয়ে বাড়ির আশপাশ থেকে ঔষধি উদ্ভিদ সংগ্রহ করে প্রাথমিক চিকিৎসা গ্রহণ করে থাকেন।
কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়া সকল স্থানীয় জাতের সবজি ও শস্য ফসলের বীজ সারাবছরের চাষের জন্য নিজেই সংরক্ষণ করেন। এসব বীজ তিনি অন্যদের সাথে বিনিময়ও করেন। নিজের প্রয়োজনীয় সবজির বীজ রোপণের পর অবশিষ্ট বীজ তিনি গ্রামের অন্যান্য কৃষকদের মধ্যে বিতরণ করেন। ফলে সবজির জন্য তাদের বাজারের উপর নির্ভরশীলতা হ্রাস পাচ্ছে। কৃষক আব্দুল লতিফ মিয়া তার পূর্ব অভিজ্ঞতার আলোকে নিজ বাড়িতে বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ এবং পরিবেশসম্মত নিরাপদ খাদ্য উৎপাদন অব্যাহত রাখতে চান।
একটি আদর্শবাড়ির গুণাবলী বিশ্লেষণ করলে যে তথ্য পাওয়া যায় তার ছাপ পাওয়া যায় তার বাড়িতে। সমাজে ভালো একজন কৃষক হিসেবে সবার কাছে গ্রহণযোগ্যতা পেয়েছে। গ্রামের আর পাঁচজন কৃষকদের থেকে আলাদা। কারণ তিনি সবার আগে সবজি ফলান এবং বৈচিত্র্যময় সবজি চাষ করেন। অন্য কৃষকরা তাঁর কাছ থেকে পরামর্শ নিয়ে থাকে।