প্রাণিসম্পদ পালনে অদিতি রানীর সাফল্য
শ্যামনগর, সাতক্ষীরা থেকে বিশ্বজিৎ মন্ডল
কৃষিনির্ভর বাংলাদেশের আর্থসামাজিক উন্নয়ন ও অগ্রযাত্রায় প্রাণিসম্পদের অবদান খুবই গুরুত্বপূর্ণ। বাংলাদেশের প্রাণিসম্পদ একটি সম্ভাবনাময় ও লাভজনক শিল্প হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। প্রাণিসম্পদ খাতকে আজ কর্মসংস্থান ও গ্রামীণ দারিদ্র্য বিমোচনের একটি অন্যতম প্রধান হাতিয়ারে পরিণত করেছে। দেশের বেকার জনগোষ্ঠী এবং নারীরা প্রাণিসম্পদ পালনে সম্পৃক্ত হয়ে আত্মকর্মসংস্থানের পথ খুঁজে পেয়েছেন। গ্রাম বাংলার অসংখ্য নারী ও পুরুষ এখনও প্রাণিসম্পদ পালনের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছেন। তেমনই একজন নারী শ্যামনগর উপজেলার শ্যামনগর সদর ইউনিয়নের কালমেঘা গ্রামের কৃষাণী অদিতি রানী (৪৪)।
অদিতি রানীর জমিজমা বলতে ৫ বিঘা। স্বামী রাধাকান্ত মন্ডল একজন দিনমজুর। সংসারে ছেলে মেয়েসহ ৪ জন সদস্য। নিজের জমিতে ধান চাষ-মাছ চাষ এবং মৌসুমভিত্তিক বিভিন্ন ফসল চাষাবাদ করেন। ফসল চাষের পাশাপাশি প্রাণিসম্পদ পালন করে অভাবনীয় সফলতা অর্জন করেন। বিয়ের পরে স্বামীর সংসারে এসে দেখেন যৌথ পরিবার। সকলেই কৃষি কাজের সাথে যুক্ত নিজের সাধ ও ইচ্ছা থাকলেও যৌথ পরিবারে তেমন কিছূ করতে পারতেন না। এরপর নিজের সংসার আলাদা হয়ে গেলে স্বামীর সাথে পরিকল্পনা করে সংসারের চাকাকে কিভাবে উন্নতির দিকে নিয়ে যাওয়া যায় সে বিষয়ে পরিকল্পনা করতে থাকেন এবং প্রাণিসম্পদ পালনসহ কৃষিকাজ করতে থাকেন। ছোট করে হাঁস-মুরগি নিয়ে শুরু করেন। এরপর হাঁস-মুরগি বিক্রি করে একটি ছাগল ক্রয় করেন। এভাবে কয়েক বছর যেতে না যেতে কয়েকটি ছাগল বিক্রি করে একটি গরু ক্রয় করেন। আর সেখান থেকে প্রতিবছর বিভিন্ন ধরনের প্রাণিসম্পদ সম্প্রসারণ করতে থাকেন।
বর্তমানে অদিতি রানীর বাড়িতে ৪টি গরু, ৯টি ছাগল, ২৫টি পাতিহাঁস, ২৬টি মেরিহাঁস, ৪টি রাজহাঁস, ২৩টি মুরগি, একটি শালিক, ১০টি কবুতর আছে, যা দিযে সংসারের পুষ্টি চাহিদা পূরণ করে বড় একটি অংশ আয় হয়।
প্রতিমাসে হাঁস-মুরগি ও ডিম বিক্রি করে প্রায় আড়াই হাজার টাকা, একইভাবে বছরে ছাগল বিক্রি করে প্রায় ৫০ হাজার টাকা এবং গরু বিক্রি করে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার মতো আয় হয় তাঁর। এছাড়াও সবজি চাষে বছরে প্রায় ২০ হাজার টাকার মতো আয় হয। গ্রামের অধিকাংশ পরিবার তার কাছ থেকে স্থানীয় হাঁস-মুরগি ও ডিম এবং ছাগল ক্রয় করেন।
অদিতি রানী বাড়িতে সব ধরনরে দেশীয় প্রানিসম্পদ পালন করেন যেমন হাঁস (পাতি হাঁস, মেরী হাঁস, রাজ হাঁস), মুরগি (গলাছেলা, কবুতর, কাজলী), ছাগল ও গরু। হাঁস-মুরগির বাচ্চা উৎপাদনের জন্য লোকায়ত পদ্ধতি হাজল এবং ঝুড়ি ব্যবহার করেন। এছাড়াও জৈব পদ্ধতিতে ফসল চাষাবাদের জন্য ভার্মি কম্পোস্ট ও গর্ত কম্পোস্ট আছে। একই সাথে ফসলের পোকা দমনের জন্য জৈব বালাইনাশক ও সেক্স ফেরোমন ফাঁদ প্রযুক্তি ব্যবহার করেন।
অদিতি রানী জানান, ‘প্রাণিসম্পদ পালনে তেমন পুঁজি লাগেনা। কোনভাবে ছোট বা বড় উদ্যোগ নিয়ে শুরু করা যায়। একবার যে কোন প্রাণি হাঁস-মুরগি, ছাগল বা গরু পালন শুরু করলেই হয়। শুধু দরকার মনের শক্তি ও সাহস। ইচ্ছা থাকলে তাহলেই সব অসম্ভবকে সম্ভব করা যাবে। আমি যেমন ক্ষুদ্রভাবে শুরু করেছিলাম সেখানেই আমার সফলতা আসে। আমার বাড়িতে যেমন বিভিন্ন ধরনের ফসল চাষাবাদ হচ্ছে তেমনিভাবে প্রাণিসম্পদ পালন করছি।’
তিনি আরো বলেন, ‘আমার পরিবারের জন্য বাজার থেকে তেল ছাড়া তেমন কিছু কেনা লাগে না। বাড়িতে যে ফসল উৎপাদন হয় তা পরিবারের চাহিদা মিটিয়ে ভালো একটি অংশ বিক্রি করতে পারি। একটি পরিবারের যত রকম পুষ্টি দরকার আমি মনে করি তার সব কিছু আমার বাড়িতে আছে। সবজি আছে, ফল আছে, অচাষকৃত উদ্ভিদ আছে, হাঁস-মুরগি আছে, গরুর দুধ আছে, পুকুর ও ঘেরে নানান ধরনের মাছ আছে। মাঠের জমিতে ধান, ডাল, সূর্যমুখী, সরিষা ও গম চাষ করি। সব কিছু মিলিয়ে আমার বাড়ি একটি পুষ্টিবাড়ি। আর আমাদের এ বাড়িই হলো খাদ্য ও পুষ্টির উৎস।’
অদিতি রানী জানান, তিনি যেমন নিজে থেকে শুরু করেছিলেন তেমনিভাবে তাঁর কাজের সফলতা ও আগ্রহ দেখে বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারী প্রতিষ্ঠান তাঁকে বিভিন্নভাবে সহায়তা করে। গ্রাম থেকে প্রায় গলাছেলা মুরগি হারিয়ে যাওয়ার উপক্রম হয়েছিলো। গ্রামে যা পাওয়া যেতো তা পরিমাণে খুব কম ছিলো। তিনি বারসিক’র নিকট গলাছেলা মুরগির সহায়তা পেয়েছেন। এছাড়াও বাড়িতে যে প্রাণিসম্পদ পালন ও সার তৈরির কৌশল (গোবর দিয়ে ভার্মি কম্পোস্ট তৈরির প্রশিক্ষণ এবং তৈরির জন্য) ও উপকরণ সহায়তাও বারসিক থেকে পান। বারসিক’র সহায়তায় তাঁর বাড়িটি একটি ‘পুষ্টি ব্যাংক ’ শতবাড়ি তৈরি এবং উন্নয়নের কাজ চলমান রয়েছে।
উপকূলীয় এলাকায় প্রতিনিয়ত ঘন ঘন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, অপরিকল্পিত চিংড়ি চাষ এবং বাণিজ্যিক হারে কৃষি ফসল উৎপাদনের জন্য প্রাণিসম্পদ দিনকে দিন কমতে শুরু করেছে। তারই মধ্যে অনেকেই নিজস্ব জ্ঞান-দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে প্রাণিসম্পদ পালনে অর্থনৈতিকভাবে লাভবান ও সফল হয়েছেন। তারই এক দৃষ্টান্ত অদিতি রানী। অদিতি রানীর মতো যেসব নারীরা ঐকান্তিক প্রচেষ্টার মাধ্যমে সফলতা অর্জন করছেন তাদের কাজকে গতিশীল করার জন্য সম্মাননা প্রদান করা জরুরি। তাহলেই তাদের মধ্যে আগ্রহ-উদ্দীপনা আরও বৃদ্ধি পাবে।