আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যারাণী সাংমার গল্প
কলমাকান্দা, নেত্রকোনা থেকে গুঞ্জন রেমা
কলমাকান্দা উপজেলার প্রায় ১২ কিলোমিটার দূরে নাজিরপুর ইউনিয়নের নলছাপ্রা গ্রাম। গিয়েছিলাম একজন আদিবাসী নারী মুক্তিযোদ্ধার সাথে দেখা করার জন্য। ১২ কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শেষে পৌছলাম কাঙ্খিত বাড়িতে। বাড়িতে ঢোকার সময় লক্ষ্য করলাম বাড়ির পাশে কিছু ফুল, ফল ও সব্জির গাছ গাছালি। এর নিচেই হাতে একটি ঝাড়– নিয়ে উঠান পরিষ্কার করছেন একজন বৃদ্ধা নারী। কাছে গিয়ে চিনতে পারলাম তিনি আর কেউ নন তিনি বীর মুক্তিযোদ্ধা সন্ধ্যারানী সাংমা। বয়সের ভাড়ে এখন আর সোজা হয়ে দাঁড়াতে পারছেন না। কিন্তু মানসিক দিক থেকে এখনো অনেক শক্ত তিনি। কথাবার্তা শুনলে মনেই হবে না তিনি প্রায় ৭০ বছর বয়সী একজন নারী। বাড়ির সব কাজ করতে এখনো সক্ষম বলে জানান তিনি। এখনো তিনি ভোর সকালে উঠে রান্নাবান্না করা, উঠান ঝাড়– দেওয়া, চা বানানো সব কাজ করে থাকেন আপন মনে। ঘরের মধ্যে ঢুকতেই চোখে পড়লো শোকেসে সাজিয়ে রাখা বিভিন্ন ক্রেস্ট, সম্মাননাগুলো। প্রশ্ন করার আগেই শুরু করে দিলেন তাঁর মুক্তিযোদ্ধের গল্প। ট্রাঙ্কের ভেতর থেকে কাগজপত্র বের দেখাতে শুরু করলেন একে একে বিভিন্ন সদন ও পত্র পত্রিকাতে তাকে নিয়ে প্রকাশ হওয়া প্রকাশনাগুলো। তাঁর কাছে কিছু বিরল ছবিও চোখে পড়ল। তাদের ১১নং সেক্টর ফিল্ড হাসপাতালে কর্মরত সহকর্মীদেরও পরিচয় করে দিচ্ছিলেন একে এক ছবি দেখিয়ে। কার নাম কি, বাড়ি কোথায়, কে বাবুর্চি, কে মালি, কে ডাক্তার, কে এখনো জীবিত, ইত্যাদি ইত্যাদি।
উনার পুরো নাম হলো সন্ধ্যা রাণী সাংমা যদিওবা মৃ মাহারী কিন্তু কাগজে কলমে এখন তিনি সাংমা লিখেন। ১৯৫০ সালে মধুপুরের আউসনারা ইউনিয়নের বোকারবাইট গ্রামে একটি গারো আদিবাসী পরিবারে জন্মগ্রহণ করেন। ছোটবেলা থেকেই জীবনে একটা ভালো কাজ করার বা মানুষকে সেবা করার মানসিকতা নিয়ে বড় হয়েছেন। তাই তো প্রায় ১০ কিলোমিটার দূরে পায়ে হেটে গিয়ে লেখাপড়া করতেন ভূটিয়া নিম্নমাধ্যমিক বিদ্যালয়ে। কিন্তু লেখাপড়া করতে তেমন সুযোগ না থাকায় অষ্টম শ্রেণী পর্যন্ত লেখাপড়া করতে পেরেছিলেন। অষ্টম শ্রেণী পাশ করার পর সিদ্ধান্ত নেন নার্সিং প্রশক্ষণ গ্রহণ করার। যে কথা সেই কাজ। পাশের এক দুঃসম্পর্কের আত্মীয় ভেরুনিকা সাংমাকে (সিমসাং) নিয়ে দুজনে ভর্তি হলেন হালুয়াঘাটের জয়রামকুড়া খ্রিষ্টিয়ান হাসপাতালে ১৯৬৯ সালে সেপ্টেম্বর মাসে।
তিন মাস তাদেরকে থাকতে হলো হাসপাতালের বিভিন্ন পর্যবেক্ষণে তারপর ১৯৭০ সালের জানুয়ারি মাসে ১ম বর্ষে নার্সিং প্রশিক্ষণ শুরু হলো। এমন করে ১৯৭১ সালে যখন তারা দ্বিতীয় বর্ষে উত্তীর্ণ হলেন আর তখনই শুরু হলো মুক্তিযুদ্ধ। মুক্তিযুদ্ধের সময় দেশের মধ্যে যে অবস্থা বিরাজ করছিল তাতে আর হাসপাতালে থাকার মত পরিবেশ না পেয়ে ছুটে যান পানিহাটা মিশনে। সেখানেও আর থাকতে পারলেন না পরদিনই ছুটে গেলেন নালিতাবাড়ী উপজেলার বারোমারি মিশনে। এক সপ্তাহের পর চলে গেলেন মরিয়মনগর মিশনে। পরিশেষে আশ্রয় নেন ভারতের মহেন্দ্র গঞ্জ থানার ৩ মাইল দক্ষিণে চাপাহাতি গ্রামে এক আত্মীয়ের বাড়িতে। তারপর মহেন্দ্রগঞ্জ স্মরণার্থী শিবিরে গিয়ে নাম লিখান। এর কিছুদিন পর ডাক্তার পীযুষ কান্তি রায়ের সহযোগিতায় তাঁরা দুজন ১১নং সেক্টর হাসপাতালে যুদ্ধাহতদের সেবা করার সুযোগ পান। সেখানে তারা দুজনই ডা. প্রেমাংকর রায়, ডা: আব্দুল মান্নান, ডা. দুলাল এবং ডা: মেজবাহ উদ্দিনের সঙ্গে দিনরাত যুদ্ধাহতদের সেবা করেছেন। তাদের ৪৫ শয্যাবিশিষ্ট হাসপাতালটি তৈরি করা হয়েছিল বাঁশের বেড়া দিয়ে, বাঁশের বেড করা হয়েছিল রোগীদের জন্য। হাসপাতালের নাম ছিল ১১নং সেক্টর ফিল্ড হাসপাতাল। সেখানে ছিলনা চিকিৎসার কোন সুব্যবস্থা। দিনের বেলায় আলো থাকলেও রাতে হারিকেন জ্বালিয়ে কখনো বা টর্চলাইট জ্বালিয়ে সেবা করতে হয়েছিল। যুদ্ধাহত রোগীর চিৎকার আর্তনাদ দেখে কখনো বা সবার আড়ালে গিয়ে হাউমাউ করে কেঁদে মনটাকে শান্ত করতেন। দায়িত্ব পালন করতে করতে কখন যে রাত ঘনিয়ে আসতো টের পেতেন না। এমনও দিন গেছে যেদিন সারাদিন রোগীর সেবা দিতে গিয়ে না খেয়ে থাকতে হয়েছিল। মনটাকে সব সময় শক্ত করে রাখতেন। আর প্রার্থনা করতেন যেন এমন পরিস্থিতির দ্রুত অবসান ঘটে।
তারপর ১৯৭১ সালের নভেম্বর মাসে চলে আসেন জামালপুরের বক্সিগঞ্জে। সেখানের হাসপাতালেও যুদ্ধাহতদের সেবা করতে হয়েছিল। কারণ ১১নং সেক্টরের একটা টিম হিসেবে তাদের কাজ করতে হয়েছিল। বক্সিগঞ্জে থাকাকালীন সময়ে তাদেরকে লক্ষ্য করে মটারশেল নিক্ষেপ করা হয়। সেদিনের কথা মনে হলে আজও তাঁর গা সিউরে উঠে! সবাই মনে করেছিল আজই জীবনের শেষ দিন। কিন্তু ভাগ্য ভালো ছিল তাই ঐদিন বেঁচে গিয়েছিলেন। মটারশেলটি তাদের ক্যাম্পে না পরে লক্ষ্যভ্রষ্ট হয়ে অন্যখানে গিয়ে পড়ে। এমন পরিস্থিতি জেনেও তাদের সেবার কাজ থেমে থাকেনি। তাঁর মনে জীবনের শেষ নিশ্বাস থাকা পর্যন্ত সেবা করেই যাবেন বলে প্রতিজ্ঞা করেন। পরিশেষে সবার সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও আত্মত্যাগে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর দেশ স্বাধীন হলো।
দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ১১নং সেক্টর কমান্ডার কর্ণেল আবু তাহেরের সহযোগিতায় সন্ধ্যারাণী সাংমা (মৃ) ও ভেরুনিকা সাংমা (সিমসাং) নিজ বাড়িতে যেতে সক্ষম হন। বাড়িতে পৌছার পর আবেগঘন মুহূর্ত সৃষ্টি হয়। কারণ তাদের বাবা মা মনে করেছিল তারা আর বেঁচে নেই! সন্ধ্যারাণী সাংমার (মৃ) বাবা জলছত্র মিশনে ফাদারের কাছে ৩০ টাকা দিয়ে বলে গিয়েছিলেন ফাদার যেন তার মেয়ের আত্মার জন্য প্রার্থনা করেন। কিন্তু যখন দীর্ঘ ৯ মাস রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর মা বাবা যখন তাঁকে জীবিত দেখতে পান তখন কি যে একটা আবেগঘন পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল তা ভাষায় প্রকাশ করার মতো না! ১৯৭৩ সালে নলছাপ্রা নিবাসী চার্চিল কুবির সাথে বিবাহ বন্ধনে আবদ্ধ হয়ে নলছাপ্রা গ্রামে বসতি গড়ে তোলেন। বর্তমানে তার ২ জন ছেলে একজন মেয়ে ও নাতী নাতনীদের নিয়ে ভালোই দিন কাটাচ্ছেন। যখনই তিনি কোন লোক পান তখনই তিনি তাঁর এমন বিভীষিকাময় অভিজ্ঞতার ঘটনাগুলো সহভাগিতা করতে ভালোবাসেন।
এ পর্যন্ত তিনি মোট ১০ বারের মত সম্মাননা পেয়েছেন বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে। যেমন অনন্যা শীর্ষ দশ, ৭১ এর নারী, নারী মুক্তিযোদ্ধা সম্মাননা-২০১৬, গেরিলা ৭১, জালাল উদ্দিন ফাউন্ডেশন, মুক্তির উৎসব স্মৃতি চারণ সম্মাননা, থকবিরিম-২০১৭ ( আদিবাসী প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান), আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবসে বিশেষ সম্মাননা-২০১১ ও কারিতাস বাংলাদেশ এর সৌজন্যে মানবাধিকার দিবস ২০১০ সম্মাননা। এছাড়াও তিনি মুক্তিযুদ্ধ জাদুঘরে একটি কম্বল রেখে আসেন। যে কম্বলটি তিনি যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে পেয়েছিলেন। তার মনে আজও ভেসে উঠে সেইসব দিনের কথা যেদিন তিনি না খেয়ে না ঘুমিয়ে যুদ্ধাহতদের সেবা করেছিলেন। দেশটাকে ভালোবেসেই ৯মাস এমন কঠিন সময় পার করেছেন। যখন ১৬ ডিসেম্বর আসে তখন মনের মধ্যে এক ধরণের আনন্দ অনুভব করেন। খারাপ লাগে যখন খবরের কাগজে, টেলিভিশনে যখন কোন দ্বন্দ্ব সংঘাট দেখেন। তাঁর দেশ প্রেমটা যে কত গভীর সেটি তাঁর সাথে আলাপ না করে জানা সম্ভব না। সবাই যাতে দেশটাকে ভালোবাসে এটাই নতুন প্রজন্মের কাছে তাঁর প্রত্যাশা।