কৃষিপণ্যের মূল্য কৃষককে নির্ধারণ করতে দিতে হবে
![](https://barciknews.com/wp-content/uploads/2020/06/Untitled.png)
ঢাকা থেকে ফেরদৌস আহমেদ উজ্জল:
উৎপাদক পণ্যের মূল্য নির্ধারণ করলেও কৃষিপণ্যের মূল্য কৃষক নির্ধারণ করে না। ফলে কৃষক পণ্যের নায্যমূল্যের সুযোগ থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। করোনাকালে দেশকে বাঁচাতে কৃষি ও কৃষক বাঁচাতে হবে। তাদের বাঁচাতে চাইলে কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণ তাদেরকেই করতে দিতে হবে। এমন দাবি জানিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক ও অর্থনীতিবিদ ড এম এম আকাশ।
আজ রোববার দুপুরে বেসরকারি গবেষণা সংস্থা বারসিক ও পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলন (পবা)র যৌথ উদ্যোগে করোনাকালীন কৃষি বাজেটের স্ট্রিমইয়ার্ডে এক আলোচনায় এসব কথা বলেন তিনি।
আলোচনার শুাতেই সূচনা বক্তব্য দেন বারসিকের পরিচালক ও গবেষক পাভেল পার্থ। এ সময় দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অনলাইনে সংযুক্ত হন কৃষি পদকবিজয়ী কয়েকজন কৃষক। আলোচনায় অংশ নেন পরিবেশ বাঁচাও আন্দোলনের চেয়ারম্যান আবু নাসের খান, সাংবাদিক তৈমুর ফারুক তুষার সহ আরও অনেকে।
ড এম এম আকাশ বলেন, ধান কেনার ক্ষেত্রে সরকার যে দাম নির্ধারণ করা হয়েছে। তা কম হলেও ভালো। কিন্তু সরকার ধান খুব কম কিনছে। চাল কিনছে রাইস মিল থেকে। এতে কৃষককে ধান বিক্রি করতে হচ্ছে রাইস মিলে। ফলে দাম পাচ্ছে না। ক্ষতিগ্রস্থ হচ্ছে তারা। তিনি বলেন, ধান উৎপাদকরাই হবে চাল কলের মালিক। সমবায় সমিতির মধ্য দিয়ে চাল কল স্থাপন করতে হবে। এতে করে চাল কলেই তারা ধান দিতে পারবে। চালের দামও তারা পাবে।
তিনি বলেন, কৃষি খাতে বৈচিত্র দরকার। বেশি দাম যেসব ফসলের, সেসব উৎপাদনের দিকে নজর দিতে হবে কৃষকের। কৃষক অর্থন না তার আর্থিক অবস্থার পরিবর্তন হবে না। এক্ষেত্রে বর্গা চাষীদের ব্যাংক লোন দিতে হবে।
আবু নাসের খান বলেন, কৃষক যাতে বাজারে সুবিধা পায় সেটা নিশ্চিত করতে হবে। অর্গানিক এগ্রিকালচারের এগিয়ে তাকে এগিয়ে নিতে সাহায্য করত হবে। অর্গানিক কৃষি হলে মানুষ পুষ্টি পাবে পরিপূর্ণভাবে। তিনি বলেন, সরকারের যে প্রকল্প- গ্রাম শহর হবে। এটা করা উচিত হবে না। বরং গ্রাম গ্রামই থাকবে। শহর শহরই থাকবে। গ্রামের ভালো মানের কৃষি পণ্য উৎপাদন করতে হবে। মার্কেটিং সিস্টেম নিশ্চিত করতে হবে।
ইনটেনসিভ কালটিভশেনের গুরুত্ব দিয়ে তিনি বলেন, ই মার্কেটিং, সমবায় সমিতি প্রভৃতি এগিয়ে নিতে হবে। সবচেয়ে জরুরি সংরক্ষণাগার। এটা সরকারকে গুরুত্ব দিতে হবে। বাজার নিয়ন্ত্রণ করতে এটা খুবই জরুরি। আলোচনা সভায় আরও উপস্থিত ছিলেন জাতীয় পদক প্রাপ্ত কৃষাণী আল্পনা রাণী, ফৌজিয়া নাসরিন, মো: ইমান আলী, মো: ইয়াবর প্রমূখ।
আলোচনায় বক্তারা বলেন, তবে বাজেটে শস্যবিমা, পণ্যভিত্তিক উৎপাদন এলাকায় সংরক্ষণ, হিমাগার, কৃষি পরিবহণের জন্য আলাদা পরিবহন ব্যবস্থা, রেলগাড়ীতে ফিজিং কম্পার্টমেন্টযুক্ত করা, জৈব সারের নিবন্ধন সহজ করা, নতুন দরিদ্র কৃষক পরিবারের খাদ্য সহায়তা, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের তালিকা প্রকাশ, ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের অনুদান প্রদান, নগরকৃষি, ছাদকৃষি, দেশীয় বীজ সংরক্ষণ উন্নয়নে সহায়তা, পারিবারিক কৃষির উন্নয়নে পরিকল্পনা গ্রহণ, জৈব বালাইনাশকের উপর ভর্তুকি প্রদান, কৃষি শ্রমিকদের পুনর্বাসন বিষয়গুলোতে কোনো নির্দেশনা নেই। করোনাসৃষ্ট উদ্ভুত সমস্যা ও খাদ্যশস্য উৎপাদনের বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে আগামী বাজেটে কৃষিখাতের বরাদ্দকে আরো বিস্তৃত করতে এবং এক কৃষিউৎপাদনমুখী ভবিষ্যতের জন্য নিম্নলিখিত প্রস্তাবগুলো তুলে ধরা হলো:
১. করোনাকালে খাদ্য উৎপাদক ‘খাদ্যযোদ্ধা’ কৃষকদের স্বাস্থ্য সুরক্ষা নিশ্চিত করে খাদ্য উৎপাদন প্রক্রিয়া নিরবচ্ছিন্ন রাখতে সকল প্রতিকূলতা দূর করা এবং কৃষিখাতকে বাজেটে অন্যতম প্রধান অগ্রাধিকার খাত হিসাবে বিবেচনা করা;
২. কৃষিউপকরণ যেমন পানি, সেচ, বীজ, শ্রমিকের মজুরি ইত্যাদির ভর্তুকি নগদ অর্থে ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের ব্যাংক হিসাব বা মোবাইল ওয়ালেটে প্রদান করা, বাজেটে অর্থবরাদ্দ রাখা যেন করোনায় ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকরা নির্বিঘেœ পরবর্তী মৌসুমে চাষাবাদ করতে পারেন;
৩. মহামারীতে সৃষ্ট নতুন দরিদ্র প্রাতিষ্ঠানিক ও অপ্রাতিষ্ঠানিক বেকার ও অভিবাসী শ্রমিকদের কৃষিতে কর্মসংস্থান তৈরি করা যেতে পারে। এজন্য সকল বেদখল খাস জমি উদ্ধার করা এবং কৃষি জমির সুরক্ষা নিশ্চিত করা। তরুণ ও ক্ষুদ্র কৃষিউদ্যোক্তাদের জন্য আর্থিক প্রণোদনা প্রদান করা;
৪. কৃষি বিপণন ব্যবস্থার উন্নয়ন ও যোগান শৃঙ্খলের পুুনঃস্থাপন করতে হবে। এজন্য গ্রামীণ হাটবাজারের ভৌতকাঠামো, কমিউনিটি গুদাম ও সংরক্ষণ, কোল্ড স্টোরেজ ব্যবস্থা নতুন করে নির্মাণ বা উন্নয়নের জন্য পর্যাপ্ত বরাদ্দ রাখা। কৃষিপণ্যের মূল্য নির্ধারণে একটি জাতীয় মূল্য কমিশন গঠন করা; ধানের আগাম মূল্য ঘোষণা করা, কৃষক ও ক্ষুদ্র উৎপাদককে ধান চাল ক্রয়ে ‘নুন্যতম মূল্য সহায়তা প্রদান করা’;
৫. কৃষিপণ্য যেমন শাকসব্জি, ফলমূল, দুধসহ পচনশীল খাদ্যপণ্য পরিবহনে ফ্রিজিং ভ্যানের ওপর শুল্ক হ্রাস করা। প্রক্রিয়াজাতকরণ উপকরণ ও কমিউনিটি হিমাগার তৈরিতে সহজশর্তে/সুদবিহীন আর্থিক সহায়তা /গ্রান্ট প্রদান করা;
৫. জাতীয়ভাবে ক্ষুদ্র কৃষকদের জন্য আবহাওয়া সূচকভিত্তিক শস্যবিমার মাধ্যমে জলবায়ু ও প্রাকৃতিক দুর্যোগজনিত ঝুঁকির কারণে ক্ষতিগ্রস্ত কৃষকদের আর্থিক ক্ষতি হ্রাস করা। আবহাওয়া কেন্দ্র হতে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্তের ওপর ভিত্তি করে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে এ বিমা পলিসি প্রস্তুত করা , প্রাপ্ত তথ্যের ভিত্তিতে বিমা দাবি পরিশোধ করা; নারীকৃষককে অগ্রাধিকার দেওয়া; জুমচাষীদের এর আওতায় আনা;
৬. গ্রামীণ কৃষকদের লকডাউনকালে ও পরবর্তীতে ৬ মাস খাদ্য সহায়তা চালু রাখা। কৃষি প্রণোদনার টাকা থেকে বর্গাচাষী ও কৃষিশ্রমিকদের নগদ সহায়তা প্রদান করা;
৭. কৃষিপণ্য পরিবহণে রেলের মালগাড়ী বগি ব্যবহারও ফ্রিজিং কম্পার্টমেন্ট চালু করা; উত্তরাঞ্চল ও দক্ষিণাঞ্চলের মধ্যে কৃষিপণ্য পরিবহণে সরাসরি সার্ভিস চালু করা;
৮. করোনাকালে কৃষিপণ্য পরিবহনে যে সকল বিকল্প ব্যবস্থা গড়ে উঠেছিল দেশের স্বাভাবিক পরিস্থিতিতেও এই সকল ব্যবস্থা চালু ও সম্প্রসারণ করা। সেজন্য ই-কমার্সের প্রসার ও অনলাইন এগ্রিকালচার মার্কেট প্লেস গড়ে তোলা এবং কৃষকদের সে বিষয়ে দক্ষতা বৃদ্ধি করা।
৯.করোনা দুর্যোগকালে ও দুর্যোগ উত্তর উদ্ভাবনমূলক কৃষিসম্প্রসারণ সেবা প্রদানের জন্য উদ্ভাবনী জ্ঞান সম্পন্ন্ কর্মকর্তাদের প্রণোদনা প্রদানের মাধ্যমে উৎসাহিত করা এবং এসব উদ্ভাবনী সম্প্রসারণ সেবা সারাদেশে ছড়িয়ে দেয়ার ব্যবস্থা করা।