ফিলিপাইনের কৃষকের উদ্ভাবিত M-394 ধানটি নেত্রকোণার কৃষকদের মন কেড়েছে

সাধুপাড়া, ময়মনসিংহ থেকে নূরল হক

কৃষি সংক্রান্ত নতুন কোন তথ্য ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণের দ্রুত মাধ্যম হলো আমাদের দেশের কৃষক। আমাদের দেশের কৃষকরা পরস্পরের সাথে কৃষি সংক্রান্ত বিভিন্ন তথ্য, প্রযুক্তি ও উপকরণ বিনিময়ের মাধ্যমে পারস্পারিক সম্পর্ক উন্নয়ন ও আন্তঃসম্পর্ক শক্তিশালীকরণের মাধ্যমে নিজেদের কৃষি বিষয়ক বিভিন্ন সমস্যার সমাধান করে থাকে। বর্তমান আধুনিক কৃষির যুগে কৃষকদের অন্যতম সমস্যা হল মানসম্মত বীজের অভাব, রাসায়নিক সার ও কীটনাশকের অত্যধিক ব্যবহার এবং ফসলে বিভিন্ন রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ। দেশে প্রতিবছর বিভিন্ন মৌসুমের জন্য উন্নত জাতের ধানসহ বিভিন্ন ফসলের জাত উদ্ভাবিত হচ্ছে। এর ফলে খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি পেলেও বাড়ছে কৃষি ফলের নতুন নতুন রোগ-বালাই। ফলে কৃষকরা ফলন বেশি পেলেও এসব রোগ-বালাই থেকে ফসল রক্ষায় পরিবেশ ও নিরাপদ খাদ্য উৎপাদনের জন্য ক্ষতিকর রাসায়নিক কৃষি উপকরণ ব্যবহার করায় উৎপাদন খরচও ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পেয়েছে। ফলে কৃষি ফসল চাষ করে কৃষকরা তেমন লাভবান হতে পাচ্ছেনা।

IMG_20181206_115439-W600
এসব সমস্যা সমাধানের লক্ষ্যে নেত্রকোনা অঞ্চলের কৃষকরা সংগঠিত হয়ে এলাকা উপযোগি ধান ও অন্যান্য ফসলের জাত নির্বাচনের জন্য কৃষক নেতৃত্বে গবেষণা কার্যক্রম পরিচালনা করে যাচ্ছেন। তারাকান্দা উপজেলার কামারিয়া ইউনিয়নের সাধুপাড়া গ্রামের ‘কৃষক ঐক্য সংগঠন’ বারসিক’র বীজ সহযোগিতায় ১৫টি ধানের জাত নিয়ে ২০১৬ সালের আমন মৌসুমে এলাকা উপযোগি ধানের জাত বাছাইয়ের জন্য একটি গবেষণা স্থাপন করে। কোন রকমের রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার না করে শুধুমাত্র জৈব উপায়ে পুরো গবেষণাটি সম্পন্ন হয়। গবেষণা প্লটের ধান কাটার সময় হলে সংগঠনটি একটি কৃষক মাঠ দিবস আয়োজন করে গবেষণা কার্যক্রমের উদ্দেশ্য ও পদ্ধতি সম্পর্কে পার্শ্ববর্তী ৬টি গ্রামের কৃষকদের সাথে সহভাগিতা করেন। মাঠ দিবসে কৃষকরা রোগ-বালাই প্রতিরোধী, হেলে পড়েনা, ফলন ভালো, দানা বেশি, সুগন্ধি, খরা সহনশীল ইত্যাদি বৈশিষ্ট্যের উপর ভিত্তি করে M-394 ধানের জাতটি এলাকার জন্য উপযোগি মনে করে পরবর্তী মৌসুমে চাষ করার জন্য নির্বাচন করেন। M-394 ধানের জাতটি মূলত ফিলিপাইন এর কৃষকদের ব্রিডিংকৃত ধানের জাত।

আমন ২০১৭ মৌসুমে সাধুপাড়া গ্রামের তিনজন কৃষক M-394 জাতটি নিজেদের জমিতে চাষ করেন। তিনজন কৃষকের জমিতে ২০১৭ মৌসুমে এ ধানের ভালো ফলন হওয়ায় গ্রামের ৬ জন কৃষক বীজ সংগ্রহ করে নিয়ে যায়। সাধুপাড়া গ্রামের কৃষক মো. আব্দুল হেকিম ২০১৮ সালের আমন মৌসুমে নিজের ৮০ শতাংশ জমিতে এ ধানের চাষ করেন এবং গ্রামের আরও ৫ জন কৃষকের সাথে এ ধানের বীজ বিনিময় করেন। একই মৌসুমে ঐ ৫ জন কৃষক তাদের ১৭৫ শতাংশ জমিতে জাতটি চাষ করেন। পাঁচজন কৃষকের মোট ২.৫৫ একর (২৫৫ শতাংশ) জমিতে চাষকৃত M-394 জাতের ধানকে কেন্দ্র করে কৃষকরা এক মাঠ দিবসের আয়োজন করে। মাঠ দিবসে অংশগ্রহণকারী কৃষকরা জানান, মাঝারি উচ্চতা হওয়ায় এ ধান হেলে পড়েনা, রোগ-বালাই হয় না, লম্বা শীষ, কম সময় লাগে (বীজতলা থেকে-কাটা পর্যন্ত ১২৫ দিন), দানার সংখ্যা (প্রতি শীষে ২৫৩টি- পুষ্টদানা ২৩৯ ও চিটা ১৪টি), মাঝারি দানা, চালের রং সাদা, দেখতে ভালো, ফলন ভালো (কাঁচা মাপে প্রতি দশ শতাংশে ২৪০-২৬০ কেজি বা ৬-৭ মণ বা প্রায় ৭ টন/হেক্টর)। M-394 ধানের জাতটি কৃষকদের পছন্দ হওয়ায় তিনটি গ্রামের কৃষকরা আগামী মৌসুমে নিজেদের জমিতে চাষ করার জন্য বীজ নিয়ে যায়।

IMG_20181206_115445-W600
M-394 ধানের জাত সম্পর্কে কৃষক মো. আব্দুল বারী বলেন, ‘আমি বিগত তিনটি মৌসুম এ ধানটি চাষ করছি। কম খরচে, কোন ধরণের রোগ-বালাইয়ের আক্রমণ হয়না, ফলন অনেক ভালো হওয়ায় এবং ব্রি-২৮ ধানের মত দেখতে হওয়ায় এ ধানের জাতটি এলাকার কৃষকদের মন কেড়েছে। আগামী আমন মৌসুমে (২০১৯) সাধুপাড়া গ্রামের প্রায় সকল কৃষকই M-394 ধানটি চাষ করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করেছে।’ আমন ২০১৯ মৌসুমে এ ধানের জাতটি কামারিয়া ইউনিয়নের সকল গ্রামে ছড়িয়ে পড়বে বলে কৃষক আব্দুল বারী ও কৃষক আব্দুল হেকীমসহ এ ধান চাষকারী সকল কৃষকরা মনে করছেন।

আমন মৌসুমে নেত্রকোনা এলাকার কৃষকরা যেসব উফশী ধানের জাতগুলো বেশি চাষ করেন তার মধ্যে ব্রি-৪৯, ব্রি-৩২, ব্রি-৩৪, ব্রি-২৮ অন্যতম। কিন্তু ব্রি-৩২ ধানটি একটু বাতাসেই হেলে পড়ে, ব্রি-২৮ ও ব্রি-৪৯ ধানের রোগ-বালাই বেশি হওয়ায় এর উৎপাদন খরচ তুলনামূলক বেশি। বিশেষভাবে লিফ ব্লাস্ট, নেক ও নট ব্লাস্ট রোগ বেশি হওয়ায় ধানের শীষ বের হওয়ার মূূহুর্তে ধানের ব্যাপক ক্ষতি হয়। শীষ বের হওয়ার মূহুর্তে এ রোগটি হওয়ায় কৃষকরা কীটনাশকও ব্যবহার করতে পারেনা। ফলে এ রোগে ধানের ক্ষতি দেখা ছাড়া কৃষকদের আর কিছু করণীয় থাকেনা। M-394 ধানের জাতটি এক্ষেত্রে কৃষকদের নিকট আশার আলো নিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছে বলে আশা করা যায়, যদিও এ ধানের জাতটির ভবিষ্যত নিয়ে বিস্তারিত গবেষণার প্রয়োজন রয়েছে।

উল্লেখ্য, ধানের M-394 লাইনটি গঅঝওচঅএ নামক ফিলিপাইনের একটি বেসরকারি উন্নয়ন সংগঠনের কৃষক প্রজনক সংকরায়নের মাধ্যমে ২০১০ সালে উদ্ভাবন করেছেন।

happy wheels 2

Comments